সাবিহার মন খারাপের গল্প

মহিউদ্দিন আকবর

0
167

সাবিহার আজ মন ভালো নেই। কিন্তু তার কী সমস্যাÑ তাও কারো কাছে বলছে না। আম্মু দুপুরের খাবার খাওয়ানোর জন্য ওর পেছনে অনেক্ষণ ঘুর ঘুর করেছেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। না খেয়েই পড়ার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওকে অনেক কষ্টে ঘুম থেকে জাগিয়ে জানতে চাইলাম, তোমার কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, স্কুলে কারও সাথে ঝগড়া হয়েছে কি না? নাকি আজ পড়া পারোনি বলে ম্যাডাম বকাঝকা করেছেন? নাকি কেউ কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তো তোমার খাতা, স্কেল, কলম এমনকি জ্যামিতি বক্সও স্কুল থেকে হাওয়া হয়ে যায়।

সাবিহাকে এত কথা বলার পরও সে একটা কথাও বলল না। তাই বললাম, ঠিক আছে তোমাকে কিচ্ছু বলতে হবে না, চলো ভাত খেতে চলো। সারা দিন চলে গেছে। আরেকটু পর আসরের আজান হবে।

আমার টানাটানিতে ও একটু রেগে গিয়ে বললোÑ যাও, আমার কিচ্ছু হয়নি।

তাই আমি আর ওকে কিছু বললাম না। আম্মুকে সব জানালাম। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। বিকেলে আব্বু অফিস থেকে ফিরলে আম্মু আব্বুকে জানালেন, শোনো, সাবিহামণির আজ কী যেন হয়েছে। স্কুল থেকে মুখ গোমড়া করে এসেছে। আর কিচ্ছু না খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। এখন তুমি তোমার আদরের মেয়েকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করো। আর ওর কাছ থেকে জানো তো, আসলে ওর আজ কী হয়েছে।

আম্মুর কাছে সব শুনে আব্বু অবাক হয়ে বললেন, খুব চিন্তার কথা তো! সাবিহা এখন কোথায় গেছে?

আমি বললাম, সাবিহা পড়ার ঘরে ভাইয়ার বিছানায় ঘুমোচ্ছে। আমি একবার জাগিয়েছিলাম বলে আমার ওপর রাগ করেছে।

আমার কথা শুনে আব্বু সাবিহার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন- সাবুমণি, এই যে দেখো আমি অফিস থেকে এসে গেছি। এখন তোমাকে সাথে নিয়ে ভাত খেতে বসবো। ওঠো, তাড়াতাড়ি ওঠো। হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে চলে এসো। আর খাওয়া দাওয়া হলে আমরা সবাই মিলে রসমালাই খাবো। বাসায় ফেরার পথে তোমার শহীদ চাচার মিষ্টির দোকান থেকে কুমিল্লার রসমালাই নিয়ে এসেছি।

রসমালাই সাবিহার খুব প্রিয়। আব্বুর মুখে রসমালাইয়ের কথা শুনে ও বিছানা থেকে নেমে ধীরপায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলো। আব্বু আমাদের বললেন, আর চিন্তা নেই, রসমালালাইয়ের কথা শুনে সাবুর মনটা ভালো হয়ে গেছে।

কিন্তু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই সাবিহা আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, জানো আব্বু, লালমণিরহাট থেকে আমার আগেকার ক্লাসমেট আফরোজা ফোন করেছিল।

আব্বু বললেন, বাহ! বেশ ভালো কথা। আফরোজাদের বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?

এবার সাবিহার মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল। ও দুঃখিতভাবে বলল, জানো আব্বু, বন্যায় ওদের বাড়িঘর সব তলিয়ে গেছে। তাই ওর আব্বু আম্মু আর ভাইবোনেরা বাড়ি ছেড়ে একটা স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ওদের এখন অনেক কষ্ট। ওর আব্বুর ঠা-া লেগে শরীর খুব খারাপ করেছে। ওরা তার ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারছে না। আবার নিজেরাও ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া পাচ্ছে না….।

ব্যাস সাবিহাকে আর কিছু বলতে হয় না। আব্বু সাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ও এইজন্যই বুঝি আমার টুনটুনি পাখিটার মন খুব খারাপ?

আব্বুর কথায় সাবিহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, আফরোজারা যখন ঢাকা ছিল, তখন ও ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। ওরা ঠিকমতো খাবার খেতে পারে না শুনে আমারও আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

আব্বু বললেন, হুম বুঝেছি। এজন্যই তুমি দুপুরে খাওনি। কিন্তু এভাবে তুমি না খেয়ে থাকলে তো আফরোজাদের কোনো উপকার হবে না। মাঝখান থেকে তুমিও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর বেশি অসুস্থ হয়ে তুমি যদি মরে যাও তাহলে আমি আমার টুনটুনি পাখিটাকে কোথায় পাবো। তখন তো কাঁদতে কাঁদতে আমিও মরে যাবো।

যেই আব্বু নিজের মরে যাবার কথা বলেছে, অমনি আবার আব্বুকে জড়িয়ে ধরে সাবিহা বলল, ইস্ বললেই হলো। তাহলে আমি আব্বু পাবো কোথায়?

এবার আব্বু সাবিহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আফরোজাদের কথা ভেবে তোমারও না খেয়ে মরার দরকার নেই। আমারও মরার দরকার নেই। তার চেয়ে একটা কাজ করা যাক। আমি তোমাকে কিছু টাকা দিচ্ছি। আর তুমি আগামীকাল স্কুলে গিয়ে তোমার ক্লাসটিচারের অনুমতি নিয়ে আফরোজার সব কথা খুলে বলে ক্লাসের বান্ধবীদের কাছে আফরোজাদের জন্য সাহায্য চাইবে। আফরোজা তো ওদেরও সহপাঠী ছিল। দেখবে সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। তখন সবটাকা একত্র করে তোমাদের ক্লাসটিচারকে দিয়ে দেবে। তিনি বিকাশ করে আফরোজার আব্বুকে টাকা পাঠিয়ে দেবেন। কী আমার আইডিয়াটা কেমন হলো?

আব্বুর কথায় সাবিহার সাথে সাথে আমিও বললামÑ দারুণ আইডিয়া আব্বু। সাবিহা তুমি আব্বুর আইডিয়াটা আগামীকালই কাজে লাগাবে। আর এখন খাবার টেবিলে এসো। আব্বুর সাথে খেতে বসবে।