
সম্প্রতি সাইকেল চালিয়ে মাউন্ট এভারেস্টে ৪টি পিক সামিট, তিনটি পাস অতিক্রম ও এভারেস্ট বেজক্যাম্প জয় করে এসেছেন বাংলাদেশী তরুণ তাম্মাত বিল খয়ের। তাম্মাত বিল খয়েরের এ বিশ্ব রেকর্ডে মাসিক ফুলকুঁড়ি তাঁকে শুভেচ্ছা জানায় এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। মাসিক ফুলকুঁড়ির পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সহ-সম্পাদক আরিব মাহমুদ।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : অভিনন্দন! অনেক বড় একটি অর্জন করেছেন।
তাম্মাত : ধন্যবাদ।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : সাইকেলের সঙ্গে আপনার পথচলার শুরুটা কীভাবে?
তাম্মাত : আমার জন্ম চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে। শহরের মধ্যে হলেও এর পরিবেশটা ছিল অনেকটা গ্রামের মতো। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চলতা ও আউটডোর কার্যক্রমের সাথেই আমার বেড়ে ওঠা। সাইকেল চালানোর প্রতি ছিল আলাদা টান। আমার একটি শখ ছিলো বাংলাদেশের ৬৪ জেলা সাইকেলে করে ঘুরবো। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সাল থেকে সাইক্লিং করছি। ২০১৭ সালে একদিন রাত ২:৩০ টার দিকে বাসা থেকে পালিয়ে যাই এবং ৬৪ জেলা অর্থাৎ প্রায় ৪০০০ কি.মি. পথ ২৫ দিনে অতিক্রম করি। এভাবেই সাইকেলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা শুরু।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : আপনার জীবনের মাইলফলকগুলো কী ছিলো?
তাম্মাত : ২০১৭ সালে সাইকেলে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করি। এরপর ২০১৮ সালে পায়ে হেঁটে টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়া, অর্থাৎ প্রায় ১০০০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়েছিলাম ২৪ দিনে। ২০১৯ সালে একটি জাতীয় রেকর্ড অর্জন করি। ৬৪ জেলা ১৪ দিন ২০ ঘণ্টায় অতিক্রম করি। আমার আগে এতো কম সময়ে এ রেকর্ড কেউ করেনি।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : দেশের বাইরে আপনার প্রজেক্ট কী কী ছিলো?
তাম্মাত : আমি সাধারণত পরিকল্পনা করি প্রতিবছর ছোট ছোট প্রজেক্টের পাশাপাশি একটি বড় প্রজেক্ট রাখবো। দেশের বাইরে প্রথম নেপালের দীর্ঘতম জাতীয় সড়ক ইস্ট ওয়েস্ট হাইওয়ে অর্থাৎ ১০০০ কি.মি. পথ পাড়ি দিই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে। এছাড়াও ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত, অর্থাৎ কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী, প্রায় ৪০০০ কি.মি. পথ ৩০ দিনে সাইকেলে করে অতিক্রম করি।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : এভারেস্ট বেজক্যাম্পের প্রস্তুতি কখন থেকে শুরু হয়?
তাম্মাত : এভারেস্ট বেজক্যাম্পের স্বপ্ন ও প্রস্তুতি ছিলো অনেক দিনের। আমি পরিকল্পনা করি এভারেস্ট বেজক্যাম্পসহ চারটি পর্বতচূড়া ও তিনটি গিরিপথ অতিক্রম করবো। অর্থাৎ প্রায় ৫৫০০ মিটার উচ্চতায় ৮বার উঠা-নামা করা। এটা সত্যিই অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিলো!
আমি নেপাল গমন করি ১৫ অক্টোবর, ২০২৪। যেহেতু এর আগে এত উঁচু পর্বতে কখনো উঠা হয়নি, তাই প্রস্তুতি হিসেবে হেভিওয়েটসহ অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্পে ট্র্যাকিং করি।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : তারপর….

তাম্মাত : এরপর মূল প্রজেক্টের দিকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ২৯ অক্টোবর সাইক্লিং শুরু করি। বন্যায় প্লাবিত নেপালের রাস্তাগুলোয় সাইক্লিং করা বেশ কঠিন ছিলো। সফরের ৮ম দিন প্রজেক্টের প্রথম অর্জন পিকেপিক সামিট করি। এই দিনটি আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। ভোরের আলো-আঁধারীর মধ্যে পর্বতের সামিট পয়েন্টে পৌঁছানো, হিমালয়ের বাতাসের ফিসফিসানি, সবমিলিয়ে অন্যরকম এক অনুভূতি। আমার দ্বিতীয় অর্জন চুখুং রি পিক। এখানে প্রথম বাংলাদেশী সাইক্লিস্ট হিসেবে আমি পৌঁছাই। এই সফরের সবচেয়ে কঠিন ছিলো কংমা লা পাস। এ পাসটা এতোটাই রিস্কি যে, কোনোভাবে পিছলে গেলে সোজা পাঁচহাজার মিটার নিচে পড়ে যেতে হবে। এখানে গতবছর সিঙ্গাপুরের ৩জন মারা গেছে। আমি তার চূড়ায় পৌঁছাই বিকাল ৪:৪০ টায়। এটা ছিলো সবার জন্য আশ্চর্যের। সেদিন রাত ১১ টায় কংমালা পাস থেকে লবুচে গ্রামে পৌঁছাই। এ পথে পাড়ি দিতে হয় খুম্বু গ্ল্যাশিয়ার, অর্থাৎ বরফের নদী। দেখে মনে হয় বরফের চাক, কিন্তু আসলে চলমান বরফ এগুলো। পায়ে ক্র্যাম্পল পরে বরফে পা দিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে পার হতে হয়েছিলো।

লবুচে গ্রামে বিশ্রাম নিয়ে এরপরের অর্জন এভারেস্ট বেজ ক্যাম্পের জন্য গোরাকশেপে পৌঁছাই। বেজ ক্যাম্প সামিট করা ছিলো এই প্রজেক্টের সবচেয়ে সহজ কাজ। পরেরদিন কালাপাত্থার সামিট করি। বেজক্যাম্প ও গোরাকশেপ সামিট শেষ করে চোলাপাস ক্রস করে গোকিও গ্রামে চলে আসি। একদিনে গোকিও রি পর্বত সামিট করি। এরপরের দিন ছিলো ৩০তম দিন। ২৭ নভেম্বর আমি বিশ্ব রেকর্ড অর্জন করি- রেনজো লা পাস সামিট করি ৫৩৬০ মিটার উঁচুতে। এর আগে পৃথিবীর কোনো সাইক্লিস্ট একই সাথে ৮টি অর্জন করতে পারেনি। আমিই এই প্রথম করলাম। মজার বিষয় হচ্ছে, ২৭ নভেম্বর, মানে যেদিন আমি রেকর্ডটা অর্জন করি, সেই দিনটি ছিলো আমার জন্মদিন। নিজের জন্মদিনে এতো বড় একটা অর্জন, আসলেই দারুণ।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : আপনার প্রজেক্টের চ্যালেঞ্জ কী ছিলো?
তাম্মাত : হিমালয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অক্সিজেনের স্বল্পতা। আপনি যতই স্বাস্থ্যবান বা শক্তিশালী হোন না কেন, পাহাড়ের উচ্চতায় কম অক্সিজেনে আপনি আপনার সামর্থ্যরে সবটুকু কখনোই দিতে পারবেন না। আমার প্রজেক্ট দেখে যদিও মনে হয়, এখানে শারীরিক চ্যালেঞ্জটাই বেশি, কিন্তু আদতে মানসিক শক্তি ধরে রাখাটাই অনেক কঠিন এখানে। প্রতিমুহূর্তেই চারপাশের বৈরি পরিবেশ আপনার মস্তিস্ককে সিগন্যাল দিবে, ওকে ফাইন, যেটুকু হয়েছে ভালো, আর বাকিটুকু দরকার নেই। যেহেতু অক্সিজেন কম, ফিরে যাও। এখানে মূল যুদ্ধটাই নিজের সাথে।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : এভারেস্টে থাকাকালীন আপনার আম্মুর সাপোর্ট কীরকম পেয়েছেন?
তাম্মাত : আমার আসলে আম্মুর সাপোর্টের চেয়ে আম্মুকে কনভিন্স করাটাই বেশি কঠিন ছিলো। আম্মুর সাথে আমি প্রতিদিনই ভিডিও কলে কথা বলতাম। দেখা যেতো, আমি আম্মুকে বুঝ দিচ্ছি যে কোনো ভয় নেই, কিন্তু আম্মু সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিওতে দেখছেন যে তার ছেলে পাহাড়ের কোণা

দিয়ে দড়ি দিয়ে সাইকেল বেঁধে পার করছে। এরকম ভয়ংকর ভিডিও দেখে আম্মু বেশ ভয় পেয়ে যায়। এমনিতে আমার আব্বু-আম্মু যথেষ্ট সাপোর্টিভ। দেখা যায় আব্বু-আম্মু বসে বসে আমার পেজের লাইক, কিংবা ভিউ কত হয়েছে, গুনেন। তবে আম্মু একটু ভয় পান, এইতো। আসলে মায়ের মন…
মাসিক ফুলকুঁড়ি : আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী?
তাম্মাত : আমার বেশকিছু পরিকল্পনা আছে। তবে খুব সাম্প্রতিক পরিকল্পনার কথা যদি বলি, জানুয়ারি মাসে রংপুরে থাকবো পুরো একমাস। উত্তরবঙ্গে শীতের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে আছে। এরপর আন্তর্জাতিক রেকর্ডের উদ্দেশ্যে শ্রীলঙ্কার কোস্টাল রোড, যা শ্রীলঙ্কার চারপাশজুড়ে প্রায় ১৭০০ কি.মি. পথ, এখানে সাইক্লিং করার পরিকল্পনা আছে।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : সারাদেশে ফুলকুঁড়ি আসরের মোট ৩২টি সাইক্লিং ক্লাব আছে। সাইক্লিং ক্লাবের সদস্যদের জন্য আপনার কী পরামর্শ?
তাম্মাত : তোমরা যেহেতু ছোট এবং সাইকেলের সাথে যাত্রা কেবল শুরু করছো, তাই দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে একসাথে নিজ জেলা/উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করা দরকার। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে সবার আগে নিজের সুন্দর দেশটা ঘুরে দেখো। আগে জানো তারপর বিদেশে যাও।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : মাসিক ফুলকুঁড়ির ক্ষুদে পাঠকদের কিছু বলতে চান …
তাম্মাত : পড়াশোনার বিকল্প নাই। তবে এর পাশাপাশি মানসিক বিকাশের জন্য শারীরিক ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পড়াশোনার পাশাপাশি কমপক্ষে একটি আউটডোর অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত থাকো।
মাসিক ফুলকুঁড়ি : ধন্যবাদ আপনাকে।
তাম্মাত : মাসিক ফুলকুঁড়িকেও ধন্যবাদ।