মাসিক ফুলকুঁড়ির সাথে একদিন

জিহাদুর রহমান জিদান

0
15

বসে আছি বলাকা নামের এক লোকাল বাসে। বাস বোটকা একটা গন্ধে ভরপুর। বাসের সিটের কাভারগুলো দেখে মনে হচ্ছে, ইহকালে কখনো বুঝি আর পরিস্কার করা হয়ে উঠেনি। তেল চিটচিটে ভাব। সকালবেলা হওয়ায় যাত্রীদের চাপ আর ঘামের গন্ধ থেকে মুক্তি পেয়ে কিছুটা আনন্দিত আমরা। লোকাল বাসগুলোর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হলো মিনিটের পর মিনিট এক জায়গায় অসভ্যের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। হেল্পার পারেনা বাসা থেকে যাত্রী নিয়ে আসতে। এখানে ড্রাইভাররাও হেল্পারের পক্ষে। যাত্রীরা যতক্ষণ মুখ খোলা রাখবে, ততক্ষণই বাস চলবে। ‘এ্যই মিঞা! ফাইজলামি করেন? এ্যনে খাড়াইয়া আছেন ক্যা?’ লোকাল বাসে এগুলো নিত্যকার ব্যাপার। তবে বকাঝকার প্রক্রিয়া কিন্তু প্রথমেই শুরু হয় না। যাত্রীরা সবসময় একজন বিপ্ল­বী মানুষের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে থাকে। যে কিনা ড্রাইভারকে প্রথমে বকুনি দেয়া শুরু করবে। তারপর একে একে সবাই আড়মোড়া ভাঙবে। তবে আজ বাসে এই ধরনের বকাঝকা হচ্ছে না, কারণ এখন ফুটফুটে সকাল। তার চেয়েও বড় কথা, আমরা ছাড়া বাসে আর কোনো যাত্রীই নাই। হাহা, আজ বাসে আমাদেরই রাজত্ব। হ্যাঁ, একজন আছে। অবশ্য না থাকার মতোই। একদম পিছনে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। চোখ লাল। হয়তো ঘুম থেকে ওঠার কারণে, কিংবা তার চোখের বর্ণই লাল। কী জানি! অথচ চোখ লাল দেখেই একটা ধারণা আমার মাথায় চলে এলো। আসলে মানুষমাত্রই ধারণাপ্রবণ। কেউ হয়তো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, গভীর রাত। রাস্তায় একটা দড়ি দেখলো, অথচ ভাবলো এটা তো মস্তবড় সাপ! আবার কেউ সাপ দেখে ভাবে, ‘দড়ি নয় তো!’
আবার একেক মানুষের চেহারাও একেক রকম। কারো চেহারাই থাকে ‘মিথ্যুকের’ মতো। তারা নির্ভেজাল সত্য বললেও সবাই হাসে এবং মনে মনে বলে ‘মায়ের কাছে মাসির গল্প?’ কারো কারো চেহারা আবার চিরসত্যবাদী ‘সাদিক’ এর মতো। যতই মিথ্যা বলুক না কেন, মানুষ সেটা সত্য বলেই ভাববে। আবার কারো চেহারা চোর টাইপ। অথচ বেচারা হয়ত জানেই না চুরি কী জিনিস! যেমন আমাদের স্কুলের অংক স্যার! শুধু চেহারার কারণেই বাসে উঠলে অন্যান্য যাত্রীরা চট করে পকেটে হাত দিয়ে চেক করে, সব ঠিকঠাক আছে কিনা!

আজকে আমি অবশ্য একা না। আমরা ছয়জন। আজ মাসিক ফুলকুঁড়ির লেখালেখি কর্মশালা আছে। তাই আজ আমাদের এই যাত্রা। আমাদের বলাকা বাস চলছে বিদ্যুৎ গতিতে। এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। লোকাল বাস কখনো দ্রুতগতিতে চলে না। সকাল হওয়ায় এবং যাত্রী কম বিধায়, অন্যদিনের তুলনায় কিছুটা গতিতেই চলছে। বাসে উঠেছি গাজীপুর থেকে। গন্তব্য যাত্রাবাড়ী। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জ। একটা পার্কে। বাসে সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুমটা প্রায় চলেই এসেছে। এই মুহূর্তটা খুবই উপভোগ করছি। সাহিত্যের ছাত্ররা হয়ত কখনো বাসে ওঠেনি। বাসে উঠলে তারা কত কিছু লিখে ফেলতেন! যেমন:

‘এইতো আমি ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে চেয়েও পারছি না। নিজেকে জাগ্রত রাখার এক প্রগাঢ় যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। এই বুঝি গন্তব্যে পৌঁছালাম! বাহিরের দৃশ্যটাও মনোরম। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ভাব দেখে মনে হয় এই বুঝি এক্ষুণি তার বর্ষণের পালা। ধুলির শহর ঢাকায় ঝাঁপিয়ে পড়বে মেঘের ফোঁটা। তবে কখন বর্ষণ হবে এই বিষয়ে হিসাব নিকাশের প্রয়োজন বটেই। মেঘ বুঝি বুঝতে চেষ্টা করছে, কখন বৃষ্টি নামলে শহরের মানুষের সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হবে। মেঘেদেরও তো মন-মেজাজ আছে। তারাও রহস্য করতে পছন্দ করে। একদম আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মতন।’

যাক গে, আমি তো আর কবি-সাহিত্যিক নই। তাই তারা কী লিখতো সেটা নিয়ে ভাবার দুঃসাহস না করে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
কয়েকবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে এবং যান পাল্টে অবশেষে এসে পৌঁছালাম গন্তব্যে। একটা পার্ক বলতে যতটুকু বোঝানো হয় তা হলো কিছু প্রাকৃতিক গাছ, কয়েকটা বেঞ্চ, শিশু খেলনার সমাহার। সাথে কিছু চলমান চায়ের স্টল। কেরানীগঞ্জের পার্কটাও অনেকটাই সেরকমই হবে ভেবেছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে দেখি স্কুলগেটের মতোই মাঝারি সাইজের একটা গেট। উপরে বড় করে লেখা ‘গার্ডেন রিসোর্ট পার্ক’। আমরা পার্কে ঢুকলাম। পার্কটা আমার ভাবনার চেয়েও বেশি সুন্দর। এখানে সব কিছুই কৃত্রিম। কৃত্রিমতা আসলের মতো কভু সুন্দর হয় না। তবে এটা কীভাবে যেন সুন্দর হয়ে গেল কে জানে! সুন্দর বলা কি ঠিক? এটা সুন্দরের চেয়েও বেশি। বাংলায় সুন্দরের চেয়ে বেশি কিছু বুঝায় এমন শব্দ আমার জানা নেই। ইংরেজিতে যেমন Good থেকে Better, Better থেকে Best.
কর্মশালার অংশ হিসেবে আমরা সবাই নির্দিষ্ট স্থানে বসলাম। খানিক বাদেই সকালের খাবারও সারা হলো। এবার কর্মশালার পালা। শুরু হলো ধারাবাহিক আলোচনা। ধারাবাহিক আলোচনা হলেও আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র ক্লান্তির ছাপ আসলো না। এর অবশ্য কারণও আছে। কারণ এখানে আমরা সবাই যে একেকজন কবি। সবাই মিলে বানিয়ে ফেললাম তাই বহুলেখকের একটি বহুমুখী কবিতা

“আমরা এসেছি আজ, সুন্দর এক গ্রামে,
গার্ডেন রিসোর্ট পার্ক, আছে তার নামে।…”

কবি হবার সেশন শেষেই আজকের অন্যতম আকর্ষণ- সুইমিংপুলে গোসল করা। সুইমিংপুলটা বড় না হলেও বেশ সমৃদ্ধ। অনেকক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি করলাম। চোখ একদম লাল হয়ে গেছে। ঠিক একদম বাসের লোকটার মতন।
যথারীতি পুরোদিন চমৎকারসব আয়োজনে মুখরিত ছিল। ফুলকুঁড়ি ভাইয়াদেরকেও ভালো লেগে গেল। এই প্রথম আমি ফুলকুঁড়ির কোনো অনুষ্ঠানে আসলাম। সারাদিন খুব আনন্দে কাটলো। অনেক জানতে এবং শিখতে পারলাম।

সন্ধ্যে হতেই রওনা দিলাম গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। সিএনজির পালা শেষ করে আবারও ভরসা সেই বলাকাতেই। গোলাপবাগ থেকে বাস গুটি গুটি পায়ে শিশুর মতো জ্যাম ঠেলে সামনে এগুচ্ছে। শুরুতে লোকাল বাসের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বলছিলাম, তা এখন চাক্ষুষ অবলোকন করতে পারছি। দীর্ঘ যাত্রার পর ঢাকা পার হয়ে টঙ্গীতে প্রবেশ করলাম। কিন্তু বিধিবাম, চেরাগআলীতে এসে বাস আঁটকে গেলো ফেভিকল গামের ন্যায়। এই যে দাঁড়িয়ে আছে, এক চুল নড়ার ইচ্ছে কিংবা সম্ভাবনা- কোনোটাই নাই। ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ করে ড্রাইভার মামা হয়ত ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের গন্তব্য আর একটু সামনেই। এক-আধ কিলো হবে হয়ত। এটা তীরে এসে তরী ডুবলো টাইপের ব্যাপার। মনে হচ্ছে এই বুঝি ছাড়লো জ্যাম, ছুটলো গাড়ি। কালক্ষেপণ হচ্ছে, কিন্তু গাড়ি তো আর ছাড়ছে না। শেষমেশ বাস থেকে নেমে, দিলাম পায়ে হাঁটা। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে পিছনে তাকাচ্ছি আর ভাবছি এই বুঝি আমাদের বাসটা ছেড়ে গেল। ০