হোসনা বানুর অ্যাডভেঞ্চার । পর্ব-৬

আহমাদ স্বাধীন

0
7
রক্ত নদীর ওপারে

একদল হাতি এলো রক্ত নদীর পাড়ে। হাতির পিঠে হোসনা বানু। ভয়ানক অন্ধকার ডাইনোসরের জঙ্গল পেরিয়ে এসেছে ওরা। যেতে হবে জাদুর পাহাড়ে। পেরোতে হবে এই রক্ত নদী এবং তার ওপারে সাপের গুহা।

হাতির পাল এগোতে পারবে না আর। রক্ত নদী পার হওয়া সম্ভব নয় হাতিদের। হাতি ওকে এটুকু সহযোগিতা করে ফিরে গেছে জঙ্গলে। এখন হোসনা বানুকে একাই যেতে হবে ওপারে। লাল পানির রক্ত নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইলো হোসনা বানু। হোসনা বানুর সাথে আছে বিশেষ ফুলের পাপড়ি। যা দিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটে চলা যায়। কিন্তু এতো বড়ো নদীতে সেটা ব্যবহার করতে পারবে না সে।  কারণ বাতাসের গতি যেকোনো সময় কমে গেলেই পড়ে যাবে নদীতে। আর তখন দানব কুমির কামড়ে খাবে ওকে। নদীতে কোনো নৌকা নেই। কী করে পার হওয়া যায় তাই ভাবছে হোসনা বানু। নদীর ধারে ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসছে কুমির। একটা দুইটা নয়, অসংখ্য কুমির। হঠাৎ একটা কুমির আসলো পেছন থেকে। এসেই ইয়া বড়ো হা করে হামলে পড়লো হোসনা বানুর উপর। একদম নিঃশব্দে আসায় হোসনা বানু বুঝতে পারেনি একদম। গাঢ় সবুজ রঙের দানব কুমিরের চোয়ালের শক্তি কম করে হলেও আট মণ। পেছন থেকে এসে কুমিরটা হোসনা বানুর পায়ে কামড় দিয়েছে। একটা কামড়ে হোসনা বানুর হাড় মাংস সব গুড়ো হয়ে যাবার কথা। অথচ ওর কিছুই হলো না! কিন্তু একটা ক্ষতি হয়ে গেল। কুমিরটা ওর পা ভেবে লাঠিতে কামড় দিয়েছে। হোসনা বানু এটা দেখেই লাঠি ফেলে দিয়ে খুব দ্রুত সরে গেল ওখান থেকে। আর কুমিরটা লাঠির অর্ধেকটা কড়মড় করে চিবিয়ে খেলো। তারপর পড়ে থাকা বাকি অর্ধেকটাও ছাড়লো না। কী আজব ব্যাপার!  এই দানব কুমির তো দেখছি সর্বগ্রাসী প্রাণী। ভাবলো হোসনা বানু। হোসনা বানু সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা দুটো নয়। অনেক অনেক কুমির হেঁটে আসছে ওর দিকে। এই উভচর দানব গুলো যে পানিতে-ডাঙায় সবখানেই চলতে পারে তা ভুলেই গিয়েছিলো হোসনা বানু। তাই তো! নদীর এতো কিনারে চলে আসা ঠিক হয়নি। কিন্তু এখন তো বাঁচতে হবে।

হোসনা বানু দৌড়াতে লাগলো নদীর উল্টো দিকে। কুমিরগুলোও পেছনে ছুটে আসতে লাগলো। হোসনা বানু সামনেই দেখতে পেলো একটি বটগাছ। সে দৌড়ে গাছটার কাছে গিয়ে উঠে পড়লো একটা উঁচু ডালে। গাছের নিচে এসে গিজগিজ করতে লাগলো অসংখ্য দানব কুমির। কপাল ভালো যে কুমির গাছে চড়তে পারে না। তাই হোসনা বানু বটগাছের ডালে নিরাপদেই থাকলো। আর অপেক্ষা করতে থাকলো কুমিরগুলোর ফিরে যাওয়ার। কিন্তু ক্ষুধার্ত এই দানব কুমিরগুলো খুব সহজে যাবে বলে মনে হয় না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সন্ধ্যা নামলো। তারপর নামলো রাত। কুমিরগুলো তখনো ফেরেনি নদীতে। ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত হোসনা বানু ভাবলো, এই রাতটা গাছেই কাটাতে হবে। অন্ধকার রাতে সবুজ পাথরের আলো জ্বেলে নিয়ে পোঁটলা থেকে শেষ খাবারটুকু বের করলো হোসনা বানু। এসময় ওর কানে এলো একটা অদ্ভুত শব্দ। মনে হচ্ছে কোনো বৃদ্ধ মানুষ ব্যথায় কাতরাচ্ছে। হোসনা বানু গাছের যে ডালে বসে ছিলো সেই ডালের একটা খোড়ল থেকে আসছে শব্দটা। হোসনা বানু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। উঁকি দিয়ে দেখলো যে, ওখানে একটা খরগোশ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে অসুস্থ। ওটাই কাঁদছে। মনে হচ্ছে কোনো এক বৃদ্ধ মানুষের কান্না। হোসনা বানু জানতে চাইলো, কী হয়েছে গো তোমার? এভাবে কান্না করছো কেন? খরগোশটি বললো, বয়স হয়েছে আমার। খাবারের জন্য বাইরে যেতে পারি না। এই গর্তে পড়ে আছি বেশ কয়েক দিন। ক্ষুধায় তেষ্টায় খুব কষ্ট হচ্ছে। হোসনা বানু ওর হাতের অর্ধেকটা রুটি এগিয়ে দিয়ে বললো, আমার কাছে এইটুকু খাবারই আছে। তুমি খেয়ে নাও। আর পানিও আছে কিছুটা। খরগোশটা খুব আগ্রহ নিয়ে রুটি আর পানি খেয়ে নিলো। তারপর সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। হোসনা বানুর মুখে হাসি ফুটলো। নিজের ক্ষুধা ও তেষ্টার কথা একদম ভুলে গেল। মেয়েটা সবসময়ই এমন। অন্য কারো কষ্ট দেখলে নিজের কষ্ট ভুলে যায়। খরগোশটা স্বাভাবিক হয়ে জানতে চাইলো হোসনা বানু এই মৃত্যুপুরীতে কেন এসেছে। আমি আমার মায়ের অন্ধ চোখ ভালো করতে চাই। এজন্য আমাকে যেতে হবে জাদুর পাহাড়ে। আনতে হবে মধু ঝরনার পানি। আমি পেরিয়ে এসেছি হিমালয় পর্বত ও আগুনমুখো ডাইনোসর-এর জঙ্গল। এখন আমাকে এই রক্ত নদী আর সাপের গুহা পেরোতেই হবে। এবং আমি সেটা করবোই। খুব আত্নবিশ্বাসের সাথে বললো হোসনা বানু।

খরগোশটা এবার নিজের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসলো। বললো, তুমিই পারবে মেয়ে। কারণ তোমার মধ্যে আছে সাহস আর অন্যের প্রতি ভালোবাসা। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কারণ তুমি অনেক ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার পরেও নিজের সর্বশেষ খাবার আর পানিটুকু দিয়ে দিয়েছো আমাকে। এই ভালোবাসার পুরস্কার তো তুমি পাবেই। শোনো ছোট্ট মেয়ে। যারা ভালো মানুষ, অন্যের উপকার করে, তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। আমি কোনো সাধারণ খরগোশ নই। আমি হলাম মায়া খরগোশ। আমি তোমাকে শেখাবো এক বিশেষ মন্ত্র। এ মন্ত্র পড়লে রক্ত নদীর সব পানি জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাবে। দানব কুমিরগুলো সব চাপা পড়বে বরফের নিচে। আর তুমি হেঁটে চলে যেতে পারবে সেই বরফের ওপর দিয়ে। তবে একটা ছোট্ট সমস্যা আছে। এই জমাট বরফের ভেতর হাঁটা সহজ হবে না। প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগবে তোমার। ঠান্ডায় খুব আস্তে হাঁটতে গেলে সময় লেগে যাবে অনেক। তখন বরফ গলে আবার পানি হয়ে যাবে। তাই হেঁটে যেতে হবে দ্রুত। যতটা সম্ভব জোরে দৌড়ে যেতে হবে নদীর ওপারে। হোসনা বানু বললো, আমার দ্রুত দৌড়ে যেতে কোনো সমস্যা হবে না। আর আমার ঠান্ডাও লাগবে না। কারণ, আমার কাছে আছে কাকের দেয়া একটা বিশেষ রসুন, যেটা হাতে নিলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। টিকে থাকা যায় সব ধরনের শীতল পরিবেশে। তাই বরফ জমা নদীতে হাঁটতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তবে তো হয়েই গেল, বললো মায়া খরগোশ। আমি তোমায় রক্ত নদীর পানি বরফ করা মন্ত্রটি কানে কানে বলছি। মন দিয়ে শোনো। ফিসফিস করে খুব গোপনে হোসনা বানুকে শিখিয়ে দিলো মন্ত্র। আর দিলো দুটো নীল রঙের গাছের পাতা। বললো, আমার শেখানো মন্ত্র পড়ে তুমি রক্ত নদী পেরিয়ে যাবে। তারপর নদীর ওপারেই দেখবে ফণা তুলে আছে অসংখ্য সাপ। গুহাতে তো আছেই; এছাড়াও ওপারে ছড়ানো-ছিটানো অনেক সাপ পাবে। ওরা কেউ তোমাকে ছোবল না দিয়ে ছাড়বে না। তবে তোমার ভয় নেই। এই নীল রঙের পাতা হচ্ছে সর্প বিষের জম। এই পাতা একটা খেয়ে নিলেই তোমার শরীরে কোনো সাপের বিষ বিষক্রিয়া ছড়াতে পারবে না। বরং যে সাপ ছোবল দেবে সেই মারা যাবে। তবে সাবধান। ওপারে গিয়েই তুমি এই পাতা খাবে। কারণ এটার কার্যকারিতা থাকে মাত্র ছত্রিশ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই তোমাকে পেরিয়ে যেতে হবে সাপের গুহা। না হলে সাপের কামড়ে মারা যাবে তুমি। হোসনা বানু ভীষণ খুশি হলো মায়া খরগোশের সহযোগিতা পেয়ে। রাতটা কেটে গেল। সকাল হলে খরগোশকে ধন্যবাদ দিয়ে রওয়ানা হলো হোসনা বানু।  মনে মনে নদীর পানি বরফ করার মন্ত্র কয়েকবার পড়ে নিলো যেন ভুলে না যায়। ততক্ষণে গাছের নিচে ও নদীর পাড়ের সব কুমির চলে গেছে পনিতে। এই সুযোগে খুব দ্রুত হোসনা বানু দৌড়ে গেলো নদীর ধারে। গিয়ে মায়া খরগোশের শেখানো মন্ত্র পড়লো –

“সুড়াং ফুড়াং জাং

ইকুর নিকুর নাং

হামকো হুকুমত শোনেলে

লোহিত্ লালে গাং

রক্ত নদীর রক্ত

তুমি আমার বশ মেনে হও

বরফ জমা ভক্ত”

ব্যস, মন্ত্রটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত নদীর সব পানি জমে গেল। জমে গিয়ে শক্ত বরফ হয়ে গেল একদম। হোসনা বানু হাতের মুঠোয় নিলো কাকের দেয়া রসুন। তারপর জমাট বরফের ওপর দিয়ে শুরু করলো দৌড়। বরফের নিচে আটকে পড়া কুমিরগুলো চোয়াল দিয়ে ঠক্ ঠক্ করে বাড়ি দিতে লাগলো বরফের আস্তরণে। কিন্তু এতো ভারী বরফের আস্তরণ ভাঙা সম্ভব না। শুধুমাত্র রোদের তাপেই ধীরে ধীরে গলবে এই বরফ। এদিকে ভীষণ জোরে দৌড়াতে লাগলো হোসনা বানু। দৌড়ে নদীর ওপারে পৌঁছে গেল হোসনা বানু। আর ভয় নেই। রক্ত নদীর কুমির এখন আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ওর। তবে ভয় এখন সাপের। হোসনা বানু যেই নদী পেরিয়ে পাড়ে উঠেছে ওমনি শত শত বিষধর সাপ ছুটে আসতে লাগলো ওর দিকে। হোসনা বানু সাথে সাথে খরগোশের দেয়া নীল রঙের একটা পাতা খেয়ে নিলো। ততক্ষণে দুটো সাপ একদম পায়ের কাছে এসে পড়েছে। এসেই টপাটপ ছোবল দিলো ওর পায়ে। তবে তাতে হোসনা বানুর কিছুই হলো না। উল্টো সাপদুটোই শরীর বাঁকিয়ে মরে পড়ে রইলো। হোসনা বানু থামলো না। হাজার হাজার সাপের উপর দিয়েই দৌড়াতে থাকলো। কোনো কোনো সাপ ওর পায়ের নিচে পিষ্ট হলো; কোনো কোনো সাপ ওকে কামড়ে দিয়ে নিজেরাই মারা পড়লো। এমন করে কত সাপ যে মরলো তার হিসেব কেউ রাখলো না। এই পিচ্ছিল সাপের শরীর মাড়িয়ে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো হোসনা বানুর। তবু সে থামলো না। থামলো একদম গুহার মুখে গিয়ে। সেখানে দেখলো আরো বড় বড় অসংখ্য সাপ গিজ গিজ করছে। হোসনা বানুকে দেখেই ফণা তুলে এগিয়ে আসছে ওরা। ছোবল দিচ্ছে হাতে পায়ে শরীরে। এতে অবশ্য কোনো ব্যথা অনুভব হচ্ছে না ওর। সাপগুলোই মরছে। হোসনা বানু বিষয়টি দেখে বেশ মজাই পাচ্ছে। এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে; ছত্রিশ মিনিট শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। এ কথা মনে হতেই হোসনা বানু ঢুকে পড়লো সাপের গুহায়। এমনিতেই ছোট্ট চিকন গুহা। তার উপর অসংখ্য সাপ কিলবিল করছে। এ গুহা পেরুনো মোটেও সহজ নয়। কিন্তু সময় নেই। খুব দ্রুত যেতে হবে গুহার ওই প্রান্তে। হোসনা বানু ওর সর্বশক্তি এক করে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে লাগলো। গুহার ওমাথায় যেতেই হবে। সময় চলে যাচ্ছে। ছত্রিশ মিনিট শেষ হয়ে গেলে এই অসংখ্য সাপের মধ্যে মাত্র একটা সাপের কামড়েই মারা পড়তে হবে। সমস্ত শরীর বিষে নীল হয়ে যাবে। খুব অল্প সময় আছে হাতে। জলদি চল্ হোসনা বানু। জলদি, আরো জলদি… নিজের ভেতর থেকে কেউ বলে চলছে ওকে। হোসনা বানু এই পিচ্ছিল ঠান্ডা সাপের শরীরের উপর হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে… যেতে যেতে শেষ হয়ে গেল নির্ধারিত ছত্রিশ মিনিট সময়। এবং শেষ মুহূর্তে পৌঁছে গেল সাপের গুহার ওই প্রান্তে। তখনো কয়েকটি সাপ তাড়া করছে ওকে। গুহা থেকে আরও বেশ কিছু পথ দৌড়ে সামনে গিয়ে পড়ে গেল হোসনা বানু। ততক্ষণে পেরিয়ে এসেছে সাপেদের নির্দিষ্ট এলাকা।

প্রচণ্ড ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে আর চলতে পারলো না হোসনা বানু। সামনে তাকিয়ে দেখলো ওই তো দেখা যাচ্ছে জাদুর পাহাড়। খুব বেশি দূরে নয়। পূর্ণোদ্যমে উঠতে চাইলেও আর পারলো না উঠতে। আবার পড়ে গেল মাটিতে। একটু পানি দরকার। তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি না পেলে এবার আর বাঁচা যাবে না। হোসনা বানুর চোখ বুঁজে আসছে ক্ষুধায় আর ক্লান্তিতে। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের মুখ। মায়ের অন্ধ চোখের কান্না। মানুষের শরীরের সব শক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও একটা শক্তি অবশিষ্ট থাকে। সেটা হলো ইচ্ছাশক্তি। সেই ইচ্ছাশক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়ালো হোসনা বানু। চলতে থাকলো আবার।

তবে জাদুর পাহাড়ে পৌঁছাতে পারলো কি সে? নাকি ঘটলো অন্য কোনো দুর্ঘটনা? হোসনা বানু ওর গন্তব্যের খুব কাছেই চলে এসেছে। সে কি চলে যেতে পারলো জাদুর পাহাড়ে? নাকি ফেঁসে গেল নতুন কোনো ঝামেলায়? সেটা জানার জন্য আমাদের যেতে হবে ওর সাথে পরের পর্বে। (চলবে..)