হোসনা বানুর অ্যাডভেঞ্চার । পর্ব-২

আহমাদ স্বাধীন

0
8

সমুদ্রের তলদেশে বিশাল প্রাসাদ। সেখানে বন্দি ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে হোসনা বানু। প্রাসাদের মালিক জাদুকর নীলুম্বাস। সে দৈত্যের মতো বিরাট একটা অক্টোপাস। নীল রঙের এই জাদুকর অক্টোপাসের ইয়া বড়ো পেট। তার পেটে যেন সারাক্ষণ ক্ষুধা লেগেই থাকে। সেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবার বানাতে হয় হোসনা বানুকে। ছোট্ট মোট্ট একটা মেয়ে এতো খাবার কী করে বানায় বলো তো?

ওর ভীষণ কষ্ট হয়। চুপি চুপি কান্না করে আর খাবার তৈরি করে। হোসনা বানু ওর মায়ের জন্য কান্না করে। ওর মা ওদের গ্রামের মিষ্টি জলের কূয়োর ধারে বসে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে আর কান্না করে। সেই কান্নার শব্দ মেয়ে শুনতে পায়। মায়েদের ভালোবাসার অনেক শক্তি। সেই ভালোবাসার শক্তিতেই মেয়েকে ফিরে পাবেন মা। এই বিশ্বাস নিয়েই মিষ্টি জলের কূয়োর ধারে মা বসে থাকেন। হোসনা বানু তো খুব সাহসী। অন্যের বিপদ দেখলেই মেয়ে স্থির থাকতে পারে না। ভীষণ একটা উপকারী স্বভাবের মেয়ে সে। মিষ্টি জলের কূয়োর হারিয়ে যাওয়া জল ফিরিয়ে আনার জন্য এসেছে সে। এসে জাদুকর অক্টোপাস নীলুম্বাসের কাছে বন্দি হয়ে গেছে। জাদুকর নীলুম্বাস খুব রাগি একটা অক্টোপাস। সে কারো কান্নার আওয়াজ শুনলে আরো রেগে যায়। তার সামনে মন খারাপ করেও থাকা যায় না। বুকের ভেতরে দুঃখ কষ্ট নিয়েও হাসি হাসি মুখে থাকতে হয়। তবে ভালো খাবার পেলে সে কিছুটা শান্ত থাকে।

অক্টোপাস নীলুম্বাসের ছিলো একটা জাদুর দণ্ড। যেটা সারাক্ষণ ধরে রাখতো একটা শুঁড়ের ডগায়। সেটা কখনো হাতছাড়া করতো না সে। সমুদ্রের তিমি হাঙর অথবা অন্য কোনো হিংস্রপ্রাণী নীলুম্বাসের কথা না শুনলে তাদেরকে পাকড়াও করে কাঁকড়া বানিয়ে দিতো সে। জাদুর দণ্ডটা তার দিকে ধরে মনে মনে একটা মন্ত্র পড়তো সে। এই প্রাসাদের ভেতরে বন্দি হয়ে আছে এমন অসংখ্য কাঁকড়া। যারা একসময় অন্য প্রাণী ছিলো। কিন্তু অক্টোপাস নীলুম্বাসের জাদুর প্রভাবে কাঁকড়া হয়ে বন্দি হয়ে আছে দীর্ঘদিন। হোসনা বানু মেয়েটা ছোট্ট হলে কী হবে, বেশ ভালো রান্না করতে পারে। আর সে কারণেই অক্টোপাসটা ওর উপরে খুব একটা রাগে না। তবে সারাক্ষণ সতর্ক নজর রাখে। যেন কোনোভাবেই পালাতে না পারে।  ওদিকে হোসনা বানু থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। কখন পালানোর সুযোগটা পাওয়া যায়। অক্টোপাস নীলুম্বাস চিংড়ি মাছ খেতে পছন্দ করতো খুব।

হোসনা বানু একদিন চিংড়িমাছ ভুনা করলো। একটা দুইটা নয়, সাত কড়াই চিংড়ি রান্না করলো মেয়েটা নীলুম্বাসের জন্য। খুব যত্ন করেই রান্না করলো সে চিংড়ি ভুনা। নীলুম্বাস বাইরে থেকে ফিরলো। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলো সে খুব। হোসনা বানু তাকে খাবারের কথা বলার সাথে সাথেই বসে পড়লো খেতে। তার কাছে চিংড়ি ভুনা এতোটাই মজা লাগলো যে, খেতে খেতে প্রায় পাঁচ পাতিল চিংড়ি ভুনা খেয়ে নিলো আর জানতে চাইলো আরো আছে কি না। হোসনা বানু তাকে বাকিটুকুও এনে দিলো। অক্টোপাস সবটুকু খেয়ে নিলো। এবার তার বিশ্রাম চাই। তবে তার আগে মেয়েটাকে একটু খুশি করা দরকার। এটা ভেবে অক্টোপাস নীলুম্বাস হোসনা বানুকে বলল,  তুমি তো আজ আমায় সেরা পছন্দের খাবারটা খাওয়ালে। একেবারে পেট ও মন ভরে গেল আমার। অনেক দিন পর আমি এতোটা তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। বলো কী চাই তোমার? শুধু মুক্তি ছাড়া যা খুশি চাইতে পারো। আমি দিয়ে দেবো। আজ আমি ভীষণ খুশি। আজ আমি একটা ডলফিনকে ধরে নিয়ে এসেছি যে আমার সাথে শত্রুতা করেছে। তাকে কাঁকড়া বানিয়ে দেবো খুব শীঘ্রই। সেইসাথে তোমার মজার চিংড়ি ভুনার স্বাদ গ্রহণ করে আমি খুবই খুশি। বলো আমার ছোট্টো রাঁধুনী, কী চাই তোমার। হোসনা বানু কিছু একটা ভাবলো। তারপর দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, আমি চাই এটা দেখতে যে তুমি কী করে যে কাউকে জাদু করে কাঁকড়া বানিয়ে দাও। তুমি এতোটা ক্ষমতাবান জাদুকর অক্টোপাস যে কত সহজে সেটা করে ফেলো তা আমার দেখার খুব সখ। কী এমন মন্ত্র পড়লে যে কেউ কাঁকড়া হয়ে যায় তা যদি একবার আমায় শোনাও তবে খুশি হবো আমি। আর হ্যাঁ, সেই সাথে কাঁকড়া হয়ে যাওয়া যে কাউকে আবার আগের মতো বানাতে পারো কী না সেটাও দেখার ইচ্ছে আমার।

জাদুকর অক্টোপাস নীলুম্বাস বলল, ব্যাস, এইটুকুই দেখতে চাও তো তুমি? ঠিক আছে মেয়ে। আমি দেখাচ্ছি আর শোনাচ্ছি সেই মন্ত্র তোমায়। এসো আমার সাথে। নীলুম্বাসের প্রাসাদের ভেতরে একটা ডলফিন ধরে আনা হয়েছে। সেখানে হোসনা বানুকে নিয়ে গেল নীলুম্বাস। তারপর জাদুর দণ্ডটা ডলফিনের দিকে ধরে এই প্রথম শব্দ করে পড়লো একটা মন্ত্র। মন্ত্রটা হলো এরকম,

“আকুড় বাকুড় পাখড়া।

চিকুর মিকুর মাখড়া।

নীলুম্বাসের হুকুমে হও,

ডলফিন থেকে কাঁকড়া”

এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ডলফিনটা ছোট্ট একটা কাঁকড়া হয়ে গেল। কী আজব! কী আজব!!  এতটুকু একটা মন্ত্রের এতো শক্তি। এবার এই কাঁকড়া থেকে আবার কী করে ডলফিন হয়ে যায় সেটাই দেখতে চায় হোসনা বানু। জাদুকর অক্টোপাস নীলুম্বাস বলল, দাঁড়াও মেয়ে। এটাকে এখনি আমি আবার ডলফিন বানিয়ে দিচ্ছি। জাদুর দণ্ডটা তাক করে আবার মন্ত্র পড়লো।

-আকুড় বাকুড় পাখড়া।

ঢিকুর মিকুর ডাবার।

নীলুম্বাসের হুকুমে হও

যা ছিলে তাই আবার।

কাঁকড়া থেকে ডলফিনটা আবার আগের মতো হয়ে গেল। নীলুম্বাস বললো, দেখলে তো আমার ছোট্ট রাঁধুনী। আমার জাদুর মন্ত্রের কত শক্তি। এই মন্ত্র শুধু তার কথাতেই কাজ করে যার হাতে এই জাদুর দণ্ড থাকে। তোমার দেখার ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলাম। এবার আমি বিশ্রাম নেবো। ডলফিনটাকে আবার মন্ত্র পড়ে কাঁকড়া বানিয়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে গেল নীলুম্বাস। ভরা পেটে খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে গেল সে। ঠিক এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলো হোসনা বানু।

খুব ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লো নীলুম্বাসের ঘরে। ঢুকেই দেখলো জাদুর দণ্ডটা পাশে রেখে ভুস ভুস করে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে অক্টোপাস নীলুম্বাস। ব্যাস। আর কিছু না ভেবেই হোসনা বানু জাদুর দণ্ডটা নিয়ে নিলো ওর হাতে। নিয়েই নীলুম্বাসের দিকে তাক করে মন্ত্র পড়লো-

আকুড় বাকুড় পাখড়া।

চিকুর মিকুর মাখড়া।

হোসনা বানুর হুকুমে হও

অক্টোপাস থেকে কাঁকড়া।

ঘুমিয়ে থাকা অক্টোপাসটা ততক্ষণে জেগে উঠেছে। উঠেই হুংকার দিয়ে উঠলো, কিন্তু তার হুংকারটা বেশি জোরালো হলো না। কারণ হোসনা বানুর মন্ত্রটা তখন কাজ করা শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বিশাল অক্টোপাস নীলুম্বাস পরিণত হলো কাঁকড়ায়। জাদুকর অক্টোপাস হয়ে গেল একটা ছোট লাল কাঁকড়া। এরপর হোসনা বানু করলো কি জানো? হোসনা বানু জাদুর দণ্ডটা নিয়ে গেল বন্দি করা অন্যান্য কাঁকড়াদের কাছে। যারা একসময় এক একটা তিমি হাঙ্গরসহ সমুদ্রের নানা প্রাণী ছিলো। জাদুর দণ্ডটা ধরে হোসনা বানু মন্ত্র পড়লো-

আকুড় বাকুড় পাখড়া।

ঢিকুর মিকুর ডাবার

হোসনা বানুর হুকুমে হও

যা ছিলে তাই আবার।

ধীরে ধীরে কাঁকড়াগুলো আবার যা ছিলো তাই হয়ে গেল। কেউ হলো হাঙর, কেউ হলো কাছিম, কেউ হলো তিমি, আরো কত কত সামুদ্রিক প্রাণী যে হলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সবাই কাঁকড়া থেকে আবার আগের রূপ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। হোসনা বানুকে সবাই অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালো। তারপর যে যার বাড়িতে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল কখনো যদি হোসনা বানু বিপদে পড়ে তাহলে ওকে সবাই সাহায্য করবে। আর যাবার বেলায় ওরা হোসনা বানুকে অনেক অনেক উপহারও দিলো। সেই উপহারগুলো ছিলো কি জানো? সেগুলো ছিলো সমুদ্রের নিচের মুক্তো মনিসহ নানা ধরনের দামি পাথর। জহরত। হোসনা বানু উপহার নিয়ে জাদু দণ্ডের সাহায্যে উঠে এলো সেই সমুদ্রের তলা থেকে। উঠে এলো একদম সেই মিষ্টি জলের কূয়োর উপরে। উঠে দেখতে পেলো তখনো তার মা সেখানে বসে আছে। অপেক্ষা করছে ওর ফিরে আসার। মেয়েকে দেখে মায়ের সে কী আনন্দ। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। হোসনা বানুর ফিরে আসার খবরে গাঁয়ের সবাই এসে জড়ো হলো ওকে দেখতে। সবাই ভীষণ খুশি হলো। হোসনা বানু নিজে কয়েকটা মনি মুক্ত জহরত রেখে বাকি সব বিলিয়ে দিলো গ্রামের গরিব মানুষদেরকে। সেই অল্প কিছু মনি মুক্তো মাকে উপহার দিলো হোসনা বানু। আর গাঁয়ের অন্য গরিব লোকরা দামি মনি মুক্তো বিক্রি করে ধনী হয়ে গেল। তাদের কোনো অভাব রইলো না। সেই লুলুশিয়া গ্রামে তখন সবাই খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকলো। তবে তাদের সুখ বেশিদিন থাকলো না। একদিন হঠাৎ করেই হোসনা বানু হারিয়ে গেল। কোথায় গেল হোসনা বানু। রাক্ষস পুরিতে গেল নাকি পরিদের রাজ্যে গেল নাকি অন্য কোনো অজানা দেশে গেল তা কেউ বলতে পারলো না। এই মুহূর্তে ঠিক আমিও বলতে পারবো না যে কোথায় গেল হোসনা বানু। এখন বলতে না পারলেও আশা করি পরের পর্বে আমরা জানবো যে কোথায় গেল সে। আর কী হয়েছিলো সাহসী ছোট্ট মেয়ে হোসনা বানুর। চলবে..