হোসনা বানুর অ্যাডভেঞ্চার । পর্ব-১১

আহমাদ স্বাধীন

0
22

অভিযান পাতালপুরী

হোসনা বানু যাবে পাতালপুরীতে। ডাইনি জাদুকরের কাছে বন্দি আছে ১০০জন নিষ্পাপ ছেলে-মেয়ের একটা দল। আসছে অমাবস্যার রাতেই জবাই করা হবে ওদেরকে। তার আগেই সেখানে পৌঁছতে হবে হোসনা বানুকে। তবে সেখানে পৌঁছানোটা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে ওর জন্য। যাত্রার শুরুতে ও পূন্যবান ব্যক্তির কাছ থেকে  পেয়েছিলো একটা বিশেষ বাটি। যেটাতে দেখা যাবে পাতালপুরীর রাস্তা। এ ছাড়াও ওকে দেয়া হয়েছিলো একটা শেষ না হওয়া ফলের রসের পাত্র। কিন্তু ওগুলো হারিয়েছে সমুদ্রের ঝড়ে। আর এখন ভয়ানক নরখাদকের দ্বীপ থেকে পালিয়েছে। আল্লাহর দয়ায় এক শকুনের পরামর্শ নিয়ে বয়স্ক কাছিমের সাথে দেখা করতে ছুটছে ও। পেছনে ছুটে আসা ছয়জন জংলীর দুইজনকে ঘায়েল করেছে হোসনা বানু। বাকি চারজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সমুদ্রের কিনারায় এসে পৌঁছলো হোসনা বানু। মাত্র সূর্য উঠেছে আকাশে। সূর্যের নরম রোদ গায়ে মেখে সমুদ্রের পাড়ে বসে আছে বয়স্ক কাছিম। কাছিমের বিশাল বড়ো শরীর। তার থেকে বড়ো খোলস। খোলসের রং গাঢ় কমলা। শরীরের রং সবুজ। শরীরে বয়সের ভাঁজ স্পষ্ট। চোখের চামড়া ঝুলে পড়ে চোখদুটো প্রায় ঢেকে গেছে। কাউকে দেখতে হলে মাথা সামান্য উঁচু করে দেখতে হয়। বয়স্ক কাছিমের কাছে গেলো হোসনা বানু। প্রথমেই নিজের পরিচয় দিলো। তারপর বললো- আমি এসেছি অনেক দূর থেকে। আমার গ্রামের নাম লুলুশিয়া। আপনার সাহায্য দরকার খুব। আমি এক বুড়ো কাছিম। আমি আর কী করতে পারি বলো। তবু যখন এতোটা দূর থেকে এসেছো বলো, কী সাহায্য চাও তুমি খুকি? গম্ভীর গলায় বললেন বয়স্ক কাছিম। আমি যাবো পাতালপুরীতে। অনেক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছি আমি। মরুভূমি আর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নরখাদকের দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসেছি। সমুদ্রের পথে আমার নৌকা ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে গিয়েছিলো। বললো হোসনা বানু। তারপর আরো কী ঘটেছে সেই সব দুর্দশার কথা খুলে বললো বয়স্ক কাছিমকে। আরও বললো- ডাইনি জাদুকরের গোপন ঘরে বন্দি আছে ১০০জন ছেলে-মেয়ে। সব শুনে বয়স্ক কাছিম বললেন- চিন্তা করো না হোসনা বানু, আমি তোমায় নিয়ে যাবো পাতালপুরীতে। পাতালপুরীর সেই গোপন পথ আমি ছাড়া আর কেউ চেনে না। অমাবস্যার যদিও আর বেশি দিন বাকি নেই তবু আমরা তার আগে সেখানে পৌঁছাব আশা করছি। তুমি ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। আগে তোমার খাদ্য চাই। দাঁড়াও এখানে। বয়স্ক কাছিম হোসনা বানুকে বেশ কিছু তাজা ফল এনে দিলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তা খেলো হোসনা বানু। বেশ ভালো লাগছে এখন ওর। বয়স্ক কাছিম বললেন- বুঝলে মেয়ে, আমি কিন্তু তোমার এর আগের বারের সমুদ্র অভিযানের গল্পটাও জানি। যেখানে তুমি জাদুকর অক্টোপাসকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলেই হয় না। কিছু কাজ করতে হয়। যে কাজে অন্যের উপকার হয়। জীবনে দেখা, জানা, শোনা তো কম হলো না। কিন্তু সেসবের কতটুকুন কাজে লাগলো বলো। তুমি অনেক কিছু জেনে বুঝেও যখন কাজে লাগাতে পারবে না, তবে সেটা তোমার জন্য এক যন্ত্রণা হবে। জানো তো? শোনো মেয়ে মনে রাখবে। বেঁচে থাকার সব থেকে খারাপ ও বিরক্তিকর দিক হচ্ছে অলস সময় কাটানো। আর সব থেকে ভালো ও পরিতৃপ্তির দিক হচ্ছে- অন্য কারো উপকারে সময় ব্যয় করা। আমি তো এই সমুদ্রের পাড়ে কাটিয়ে দিলাম জীবনের খুব লম্বা একটা সময়।

আচ্ছা কাছিম দাদু, আপনি জীবনের ঠিক কত বছর সময় পার করেছেন, বা বেঁচে আছেন বলতে পারেন? কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো হোসনা বানু। বয়স্ক কাছিম বললো- তা সঠিকভাবে বলতে পারবো না রে। তবে আজ থেকে পনেরশত বছর আগের ঘটনার কথাও আমার মনে আছে। সেই হিসেবে বলা যায় আমার বয়স পনেরশ বছর থেকেও বেশি। বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো হোসনা বানুর মুখ। বয়স্ক কাছিম বললেন- অবাক হবার কিছু নেই। এর থেকে আরও অনেক বেশি অবাক করা ঘটনা আছে হয়তো তোমার সামনে। এখন আমাদের রওয়ানা হতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় নেই। হোসনা বানু বয়স্ক কাছিমের দেয়া বেশ কিছু ফল পোঁটলা করে নিলো। নিয়ে উঠে বসলো বয়স্ক কাছিমের পিঠে। বয়স্ক কাছিম নেমে পড়লো সমুদ্রে। অতল সমুদ্রের ঢেউয়ে বাতাসে ভর করে ভেসে চললো ওরা। সাঁতরে যাচ্ছে বয়স্ক কাছিম। সমুদ্রের নীল পানি এখন বেশ শান্ত আর সুন্দর হয়ে উঠেছে যেন। সূর্যের সোনালি ছায়া পানির মধ্যে। বেশ মোহনীয় সুন্দর এক চিত্র। এগিয়ে চলছে ওরা পাতালপুরীর দিকে। চলতে চলতে কতটা পথ যে পেরোলো, সে হিসেব কেউই রাখলো না। একসময় বয়স্ক কাছিম বললেন- এখন খুব শক্ত করে ধরে রাখবে মেয়ে। আমরা এখন সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাবো। বলেই হোসনা বানুকে নিয়ে ডুবে গেলো সমুদ্রের নিচে। পানির নিচের এই জগৎটা হোসনা বানুর কাছে ভীষণ সুন্দর লাগে। এটা এক অন্য জগৎ। স্বচ্ছ কাচের মতো পৃথিবী। নীল পানির একটা মায়াময় জগৎ এটা। এখানে হোসনা বানু এর আগেই এসেছে। তাই সমুদ্র ওর অচেনা নয়। কিন্তু এবার ও এসেছে সমুদ্রের অনেক বেশি গভীরে। যেখান থেকে যেতে হবে পাতালপুরীতে। এই গভীর তলদেশের অবাক সৌন্দর্য ওকে মুগ্ধ করছে। মুগ্ধতার চোখে দেখছে পানির তলদেশের সব নাম না জানা প্রাণীদের। চিংড়ি মাছের মতো দেখতে একটা প্রাণীর দেখা পেলো হোসনা বানু। কী সুন্দর গায়ের রং। লাল নীল হলুদ সবুজ বেগুনী। কতশত রং দিয়ে যে ওটা তৈরি কে জানে। অদ্ভুত সুন্দর প্রাণীটা ওদের দিকেই আসছিলো। ওটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারলে ভালো হতো। প্রথমে যতটা ছোট মনে হচ্ছিল ওটা আসলে ততটা ছোট নয়। যত কাছে আসছে ততই বিশাল আকৃতি নিচ্ছে। নিজের শরীরের রং পাল্টাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। কী আজব সুন্দর ওটা! ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়ালো হোসনা বানু। বয়স্ক কাছিম চিৎকার করে নিষেধ করতে করতে ওটা কাছে চলে আসলো। এসেই ওর মাথার ধারালো অস্ত্রের মতো শিং দিয়ে গুঁতো দিলো হোসনা বানুকে। শেষ মুহূর্তে সরে না গেলে শিং গেঁথে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতো হোসনা বানু। বয়স্ক কাছিম বললেন- সরে যাও। এটা সমুদ্রের ভয়ংকর প্রাণী ম্যান্টিশ। ওটা ভীষণ বিষাক্ত আর ভয়ানক। ওটা তোমাকে মেরে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। হোসনা বানু কাছিমের পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিলো। আবার উঠে বসলো পিঠে। বিশাল ম্যান্টিশ আবার এলো ওকে গুঁতো দিতে। বয়স্ক কাছিম খুব দ্রুত সাঁতরে যেতে লাগলো। পেছনে ধাওয়া করে আসতে লাগলো ভয়ানক ম্যান্টিশ। হোসনা বানু পিছনে তাকিয়ে দেখলো একটা নয়, অনেক ম্যান্টিশ ছুটে আসছে ওদের দিকে। হোসনা বানু দেখলো ঘোর বিপ। হঠাৎ ওর মনে হলো হাঙরের কথা। সাদা হাঙর ও সমুদ্রের নীলতিমি ওকে বলেছিলো কখনো সমুদ্রে বিপদ হলে যেন ওদেরকে ডাকে। হোসনা বানু চিৎকার করে ডাকলো নীল তিমি ও হাঙরকে। হোসনা বানুর ডাক শুনে খুব দ্রুত ছুটে এলো তিমি। হাঙর এলো ওর ঝাঁক নিয়ে। এসেই বুঝে গেলো ম্যান্টিশ হোসনা বানুকে আক্রমণ করেছে। ব্যস, সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লো ম্যান্টিশ এর উপর। তিমির বিশাল চোয়ালের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে গুঁড়ো হয়ে গেলো ম্যান্টিশ। হাঙরের ধারালো দাঁতের কামড়ে ম্যান্টিশগুলো থেতলে গেলো একেকটা। বাকি থাকা কয়েকটা ভয়ে উল্টো দিকে পালিয়ে বাঁচলো। তিমি ও হাঙরকে অনেক ধন্যবাদ জানালো হোসনা বানু। ওরা জানতে চাইলো বয়স্ক কাছিমকে নিয়ে কোথায় যাবে হোসনা বানু। হোসনা বানু ওদেরকে বললো ওর পাতালপুরী অভিযানের কথা। ১০০জন নিষ্পাপ ছেলে-মেয়ের জীবন বাঁচাতে যাচ্ছে সেই পাতালপুরীতে। তিমি বললো- অবশ্যই সেখানে তোমার সাহায্য লাগবে। বয়স্ক কাছিম তোমায় শুধু সেখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো সাহায্য করতে পারবে না। কারণ এখন তার গায়ে এতো শক্তি নেই। তার অনেক বয়স হয়ে গেছে। তাই আমাদেরও তোমার সাথে যাওয়া রকার। হাঙর বললো- তিমি ভাই, তোমার এই শরীর নিয়ে পাতালপুরীর গুহায় যাওয়া সম্ভব হবে না। তারচে বরং আমি আমার দল নিয়ে যাই আর তুমি এমন কাউকে দাও যারা এই যাত্রায় আমাদের উপকারে আসে। বয়স্ক কাছিম বললেন- হাঙর ঠিক বলেছে। এক কাজ করো তিমি। তুমি আমাদের সাথে কিছু টারডিগ্রেট দিতে পারো। এরা হচ্ছে পানির ভালুক। ক্ষুদ্র কিন্তু অনেক শক্তিশালী প্রাণশক্তি এদের। যদি পানিতে জীবন্ত সিদ্ধ করা হয় বা বরফের ভিতরেও রাখা হয় তবু এদের কিছুই হবে না। পানির নিচের এই প্রাণীটি যেকোনো পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে। এই প্রাণীটি এতই ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। ওকে দিয়ে জাদুকর ডাইনির সাথে লড়াই করতে কাজে লাগবে। আর দিতে পারো, এটলান্টিকাসকেও। এটলান্টিকাস দেখতে সুন্দর হলেও খুবই চতুর একটি সামুদ্রিক প্রাণী। এবং এর পুরো শরীরে বিষ বহন করে।  এটলান্টিকাসের নিজের বিষ নেই। তবে সমুদ্রের অন্যান্য যাদের বিষ আছে এমন প্রাণী যেমন অক্টোপাস স্প্রে থেকে চুরি করে সে নিজের কাছে জমা করে। তার শরীরের রং দুদিকে দুরকম। শিকারীকে ধোঁকা দিতেও বেশ পটু এটলান্টিকাস। ছোট্ট গিরগিটির মতো দেখতে এই এটলান্টিকাস বেশ কাজে আসবে আমাদের। আর কিছু জেলি মাছ দিতে পারো। আমরা অন্ধকার গুহা পেরিয়ে যাবো তাই লাগতে পারে ওদের। তিমি বললো-আপনাকে আমরা জলজগতের জ্ঞানী প্রাণী হিসেবেই জানি। তাই আপনি যা ভালো বোঝেন তাই হবে। হোসনা বানুর সাথে আপনাদের সফর সঙ্গী হবে হাঙর, এটলান্টিকাস টারডিগ্রেট ও জেলি মাছ। তিমি এটলান্টিকাস টারডিগ্রেট ও জেলি মাছের এর তিনটা দলকে ডেকে ওদের সাথে দিয়ে বললো, আপনাদের লক্ষ্য সফল হোক। বিজয় হোক পাতালপুরী অভিযানে। এই বলে বিশাল নীল তিমি চলে গেলো। এদিকে হোসনা বানু কাছিমের পিঠে চড়ে আবার চলতে থাকলো পাতালপুরীর দিকে। সাথে চললো হাঙর, এটলান্টিকাস টারডিগ্রেট ও জেলি মাছের ঝাঁক। ওরা চলতে চলতে পাতালপুরীর সন্ধানে সমুদ্রের কত নিচে যে গেলো সে হিসেব কেউ রাখলো না। যেতে যেতে যেতে একটা সময় পেয়ে গেলো সেই অন্ধকার গুহা। এই গুহার মুখে পাহারা দিচ্ছিলো একদল সমুদ্র ঘোড়া। এরা সাধারণ সমুদ্রঘোড়া নয়। এক একটা বিশাল আকৃতির সমুদ্রঘোড়া। ঘোড়াগুলো গুহার পথ আগলে রেখেছে। ঘোড়াগুলোর মাথার মাঝে একটা করে চোখা শিং। বয়স্ক কাছিম ঢুকতে চাইলে ওরা সব শিং উঁচিয়ে বাধা দিলো। তখন হাঙরের দল একযোগে সব ধেয়ে গেলো ওদের দিকে। কয়েকটাকে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো একদম। ভয়ে বাকিগুলো সরে দাঁড়ালো গুহার মুখ থেকে। ওরা ঢুকে গেলো অন্ধকার গুহায়। ভীষণ রকম অন্ধকার সেই গুহায় কিচ্ছু দেখা যায় না। বয়স্ক কাছিম জেলি মাছদের বললেন- আলো দাও তোমরা। জেলি মাছের দল নিজেদের শরীর থেকে আলো ছড়িয়ে দিলো। দূর হলো অন্ধকার। তখন আর কারো চলতে কষ্ট হলো না। ওরা চলতেই থাকলো অন্ধকার গুহার পথ ধরে। চলতে চলতে কতটা দূর যে গেলো সে হিসেব কেউ রাখলো না। একটা সময় ওরা গিয়ে পৌঁছালো একটা বন্ধ ফটকের সামনে। এটাই ডাইনি জাদুকরের বাড়ি। এখানেই কোনো এক গোপন ঘরে বন্দি আছে ১০০ জন ছেলেমেয়ে।

ফটকের পাহারায় নেই কেউ। তবে ভেতর থেকে বন্ধ করা আছে। হোসনা বানু বয়স্ক কাছিমকে বললো- এখন ভিতরে কী করে যাওয়া যায় কাছিম দাদু? বয়স্ক কাছিম বললেন, চিন্তা করো না। আমরা ভিতরে ঢুকবোই। শোনো মেয়ে, অমাবস্যা আজ রাতেই। তাই হয় তো ডাইনি আয়োজনের জন্য ব্যস্ত আছে। এই সুযোগে আমাদের ঢুকতে হবে ভিতরে। বয়স্ক কাছিম টারডিগ্রেটকে বললেন- শোনো, তোমরা ফটকের ফাঁকা দিয়ে ঢুকে ওপাশে যাবে। তারপর ভিতর ঢুকে আলগা করে খুলে দেবে তালা। তবেই আমরা ঢুকতে পারবো। ঠিক পারবো আমরা, এই বলে ক্ষুদ্র টারডিগ্রেট এর একটা দল ঢুকে গেলো ফটকের ভিতরে। তারপর খুব অল্প সময়েই খুলে ফেললো তালা। হোসনা বানু দলসহ ভিতরে ঢুকে গেলো। ঢুকে দেখলো একদম ফাঁকা বাড়ি। কোথাও কেউ নেই। বয়স্ক কাছিম জেলি মাছদের দায়িত্ব দিলো সেই গোপন ঘর খুঁজে বের করার। জেলি মাছের দল বাড়ির সব ঘর খুঁজে দেখলো। কোথাও পাওয়া গেলো না ওদের। তবে একটা ঘরে পাওয়া গেলো একশোটা জবাফুল। একথা এসে বললো ওরা বয়স্ক কাছিম ও হোসনা বানুকে। বয়স্ক কাছিম বুঝে গেলো যে ডাইনি জাদুকর ওদেরকে জবাফুল বানিয়ে রেখেছে। সেই গোপন ঘর থেকে একশ টি তাজা লাল জবাফুল তুলে আনলো হোসনা বানু। তারপর খুঁজতে লাগলো ডাইনিকে। খুঁজতে খুঁজতে দেখলো বাড়ির পাশে একটা কালী মন্দির। সেখানেই শয়তানের পূজা করছিলো সে। সামনে ধারালো বড়ো এক রামদা। কাছিম শুধু হোসনা বানুকে নিয়েই গেলেন সেখানে। বাকিদের আড়ালে রাখলেন। বললেন প্রয়োজনের সময় যেন এগিয়ে আসে ওরা। বয়স্ক কাছিম হোসনা বানুকে বলে দিলেন- কালী মূর্তি যে সিংহের মূর্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, ওটার ডান চোখের মনির ভিতরে আছে একটা ছোট্ট নীল টিকটিকি। সেই টিকটিকির ভিতরেই আছে ডাইনি জাদুকরের প্রাণ এবং ওর জাদুশক্তি। তাই ওটাকে হাত করতে হবে। ওটা হাতে পেলে আমরা ওকে দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারবো। আর ওর জাদুশক্তিও এসে যাবে আমাদের হাতে। হোসনা বানুকে দেখেই ডাইনি চেঁচিয়ে উঠলো- কে রে তুই? কী করে আসলি আমার এই গোপন স্থানে? আমি আমার বন্ধুদের মুক্ত করে নিয়ে যেতে এসেছি, বললো হোসনা বানু। সে সুযোগ হয়তো পাবি না তুই খুকি। আমার একশো জবাফুল নিয়ে নিয়েছিস? কত বড়ো সাহস তোর! ওটা এক্ষুণি আমাকে দিয়ে দে বলছি। আজ রাতেই আমার সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ। ওদের বলি দেয়া হবে এখানেই।  একথা বলেই ডাইনি জাদুকর জাদু দিয়ে একটা খাঁচায় আটকে দিলো হোসনা বানুকে। তারপর ওর দিকে এগিয়ে গেলো ফুলগুলো নেয়ার জন্য। হোসনা বানু বয়স্ক কাছিমের দিকে ফুলগুলো ছুঁড়ে দিয়ে বললো- ধরো কাছিম দাদু, এগুলো যেন ডাইনি কিছুতেই না পায়। ডাইনি ছুটলো কাছিমের দিকে। আর জাদু দিয়ে তৈরি করলো কতগুলো হিংস্র কুকুর। কাছিম ডাকলো হাঙরদের। হাঙরের দল এসে কুকুরের সাথে লড়াই করতে লাগলো। আর দুটো হাঙর ধারালো দাঁত দিয়ে ভেঙে ফেললো হোসনা বানুর খাঁচা। হোসনা বানু বেরিয়ে আবার দৌড়ে গেলো কাছিমের দিকে। লাল জবাগুলো নিয়ে নিলো নিজের কাছে। বয়স্ক কাছিম হোসনা বানুকে বললেন- তুমি সিংহের চোখের মনিটা নেয়ার চেষ্টা করো। একথা শুনেই ডাইনি ওর দিকে কতগুলো বিষধর সাপ ছেড়ে দিলো। সাপগুলো ছুটে গেলো হোসনা বানুর দিকে। কাছিম তখন ডাকলো এটলান্টিকাসদের। এটলান্টিকাসরা এসে সাপদের কামড়াতে লাগলো। সাপ আর এটলান্টিকাস তুমুল লড়াই বেঁধে গেলো। এসময় হোসনা বানু দৌড়ে গেলো কালী মূর্তির পায়ের নিচের সিংহের মূর্তির কাছে। গিয়েই ওর ডান চোখের মনিটা খুবলে নিলো। এরপর যেই মনিটা থেকে ছোট্ট টিকটিকিটাকে বের করতে যাবে, তখনি ডাইনিটা প্রায় উড়ে আসলো ওর কাছে। এসে হোসনা বানুর হাত থেকে টেনে নিতে চাইলো মনিটা। এর মধ্যেই কুকুর আর সাপেদেরকে জব্দ করেছে হাঙর ও এটলান্টিকাস। হোসনা বানুকে বাঁচানোর জন্য ওরা যেই এগিয়ে গেলো ওদিকে তখন ডাইনি জাদু দিয়ে নিজের চারপাশে একটা আগুনের বলয় তৈরি করলো। আগুনের বলয়ের ভিতরে হোসনা বানু ও ডাইনি মনিটা নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে। অন্য সবাই বাইরে। বয়স্ক কাছিম তখন ডাকলো টারডিগ্রেটদের। বললো- যাও এবার তোমাদের কাজ করো। টারডিগ্রেটের দল আগুনের ভেতর দিয়েই ছুটে গেলো ডাইনির কাছে। গিয়ে ডাইনির নাকে কানে ঢুকে একদম সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এরপর ছড়িয়ে দিলো বিষ। কাবু হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ডাইনি। হোসনা বানু মনিটা ভেঙে বের করে নিলো জাদুর টিকটিকিটাকে। ডাইনি ততক্ষণে কুপোকাৎ। ওর সারা শরীরে আগুন লেগে ঝলসে গেলো একদম। ডাইনির সব জাদু ক্ষমতা চলে গেলো হোসনা বানুর কাছে। হোসনা বানু জাদু দিয়ে ১০০টা লাল জবাকে বানিয়ে ফেললো একশো জন ছেলেমেয়ে। যেই ছেলে-মেয়েদের কে ডাইনি নিয়ে এসেছিলো বলি দেয়ার জন্য। এদের মধ্যে দেখা গেলো হোসনা বানুর বন্ধুরাও আছে। ওরা মুক্তি পেয়ে কী যে খুশি হলো, তা আর বলে বোঝানো যাবে না। ভীষণ আনন্দে হোসনা বানুকে ওরা জড়িয়ে ধরলো। হোসনা বানু ধন্যবাদ জানালো হাঙর, এটলান্টিকাস  টারডিগ্রেট ও জেলি মাছদের। বললো- তোমাদের সাহায্য না পেলে আমি কিছুতেই ডাইনির সাথে পেরে উঠতাম না। আর ওদেরকে উদ্ধার করতেও পারতাম না। আমি আজ বিদায় নেবো এই পাতালপুরী থেকে। আবার দেখা হতে পারে অন্য কোনো অভিযানে। নিশ্চয়ই, বললো হাঙর ও বাকিরা। বয়স্ক কাছিম বললেন- মুক্ত ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখন বাড়ি ফিরে যাও আনন্দে। ডাইনির এই জাদুর টিকটিকি শুধু এই পাতালপুরীতেই কার্যকর। তাই তুমি এটা ব্যবহার করে একটা ডুবো জাহাজ তৈরি করতে পারো। সেটা দিয়ে এই পাতালপুরী ও সমুদ্র পেরিয়ে যাবে। আর কিছু সমুদ্রের রত্ন পাথর নিয়ে যাও মেয়ে। কাজে লাগবে তোমাদের। তোমার জন্য রইলো আমার আশীর্বাদ ও ভালোবাসা। জীবনের সকল অভিযানে জয়ী হবে তুমি। ভালো থেকো মেয়ে। আর যদি বেঁচে থাকি তবে হয়তো দেখা হবে আবারও।

হোসনা বানু জাদু দিয়ে একটা ডুবো জাহাজ বানিয়ে নিলো। আর নিলো ডাইনির ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু রত্ন পাথর। সবাইকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলো। ডুবো জাহাজে চড়ে সমুদ্র পেরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ওরা চলে আসলো মরুভূমিতে। সেখানে ওদের জন্য একশো একটি উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো এক সওদাগর। যাকে পাঠিয়েছেন সেই পূন্যবান পুরুষ। যিনি স্রষ্টার সাধনা করে চোখ বুঁজেই দেখতে পান অনেক কিছু। তিনি দেখেছেন হোসনা বানু পাতালপুরী অভিযান বিজয় করে ফিরে আসছে। তাই তিনি ওর সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছেন এই উট। হোসনা বানু সেই উটে চড়ে সবাইকে নিয়ে ফিরে এলো বাড়িতে। বারোটা গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া ছেলে-মেয়েরাও ফিরে গেলো নিজেদের গ্রামে। হোসনা বানুর মা ও গ্রামের সবাই ভীষণ আনন্দে বীরের মতো বরণ করে নিলো হোসনা বানুকে। সকল ছেলে-মেয়ের মা বাবা তাদের সন্তানদের ফিরে পেয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন ওকে। লুলুশিয়া গ্রাম আবার মেতে উঠলো হাসি আর আনন্দে। কিন্তু জানো তো, শুধু হাসি আনন্দের মাঝে জীবন কাটানো একঘেঁয়ে। এই একঘেঁয়ে জীবন ভালো লাগে না হোসনা বানুর। তাই সে অপেক্ষা করে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারের। যদি সুযোগ হয় তো আবার সে বেরিয়ে পড়বে নতুন কোনো অভিযানে। যাবে নতুন কোনো রাজ্যে।

বাবাহারা এই ছোট্ট মেয়েটা সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করে সবসময়। কিন্তু নিজের মনে একটা ছোট্ট প্রশ্ন সবসময় থাকে। কোথায় হারিয়ে গেছে তার বাবা? সে কী মরে গেছেন নাকি বেঁচে আছেন? থাকলে কোথায় আছেন? জানে না হোসনা বানু। ওর মা কোনো এক রহস্যময় কারণে এই ব্যাপারে কিছুই বলেন না। তবে হয়তো বলবেন একদিন। হোসনা বানু নেই অপেক্ষায় থাকে। আর থাকে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে যাবার সুযোগের অপেক্ষায়। যদি তোমাদেরও একঘেঁয়ে লাগে এই গৎবাঁধা জীবন আর যেতে মন চায় রহস্য রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চারের জগতে তবে জানিয়ে দিও। তাহলেই ছোট্ট ভালো মেয়ে হোসনা বানুকে নিয়ে আমরা আবার যাবো নতুন অ্যাডভেঞ্চারে। (সমাপ্ত)