হোসনা বানুর অ্যাডভেঞ্চার । পর্ব-১

আহমাদ স্বাধীন

0
10

লুলুশিয়া গ্রাম থেকে শুরু হলো গল্প

বলছি সেই সময়ের গল্প। যে সময় ছিলো না আজকের মতো কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। ছিলো না কোনো টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেট। কত বছর আগের হতে পারে বলো তো?  আচ্ছা ধরে নাও কয়েকশ বছর আগে। একটা ছিলো দেশ।

সেই দেশে ছিলো ভীষণ সুন্দর আর শান্ত একটা গ্রাম। গ্রামের নাম লুলুশিয়া। লুলুশিয়া গ্রাম থেকে শুরু হচ্ছে এই গল্প।

অদ্ভুত সুন্দর গ্রাম থেকে শুরু হওয়া এ গল্প কোথায় শেষ হবে তা এখনি বলা যাচ্ছে না। হয়তো কোনো পাহাড়, মরুভূমি, সমুদ্র অথবা ভয়ানক জঙ্গলে গিয়ে শেষ হবে এই গল্প। কিংবা অচেনা কোনো রাজ্যে। অথবা তোমরাই হয়তো চাইবে না এই গল্পের শেষ হোক। তাই চলতেও পারে পথ শেষ না হওয়া গন্তব্যের মতো।

আবার হুট করেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে শব্দের গিঁট। কী হবে না হবে তা আমিও জানি না, বুঝলে তো। তাই এতো সব না ভেবে চলো আমরা গল্পের ভেতর ঢুকে যাই। অদ্ভুত সুন্দর লুলুশিয়া গ্রামের গল্প।

তখন কারো বাড়িতে টিউবওয়েল বা নলকূপ ছিলো না। জলের জন্য ছিলো কূয়ো। ভীষণ গভীর ছিলো সেই কূয়ো। বালতির আংটায় রশি বেঁধে তুলতে হতো জল। কখনো সেই জল এতো নিচে নেমে যেতো যে তুলতে অনেক লম্বা রশি লাগাতে হতো। তখন কষ্টও হতো বেশ। তেমনই গভীর এক কূয়ো ছিলো একই গ্রামে। মিষ্টি জলের কূয়ো ছিলো সেটা। গ্রামের সবার পানির ব্যবস্থা করতে হতো শুধুমাত্র সেই একটি কূয়ো থেকে। কূয়োর পানি যেমন ছিলো মিষ্টি তেমন ছিলো পরিষ্কার। সেই মিষ্টি জলের কূয়ো একদিন হঠাৎ করেই বদলে গেল! হঠাৎ করেই কূয়োর জল বেশ তলানিতে চলে গেল। এতোটাই তলানিতে গেল যে তা আর উঠানোই যাচ্ছিলো না। বালতিতে রশি বড় করে বাঁধা হলো। তবু জল পাওয়া গেল না। আরো বড় করা হলো। তবুও জল তোলা গেল না। জল নেই তো নেই। অনেক অনেক চেষ্টা করেও জলের ব্যবস্থা করা গেল না। কী হবে এখন?

গ্রামসুদ্ধ সব মানুষ ভাবতে বসলো। কেন এমন হলো? কোথায় গেল এই মিষ্টি কূয়োর জল? কী করে চলবে এখন জল ছাড়া? কূয়োর তলানিতে নিশ্চয় কোনো ঝামেলা হয়েছে। তা না হলে জল গেল কোথায়? এখন কেউ একজন যদি নেমে তলানিতে দেখতে পারে, তবেই হয়তো মিলবে সমাধান। কিন্তু কে যাবে এই অন্ধকার গভীর কূয়োর ভেতরে? ভাবতে থাকলো সবাই। ভাবতেই থাকলো আর ভাবতেই থাকলো। কিন্তু কোনো সমাধান পাওয়া গেল না। তখন এলো হোসনা বানু। এসে বলল- আমি যাবো এই কূয়োর তলানিতে। সকলেই অবাক হয়ে চাইলো হোসনা বানু নামের ছোট্ট মেয়েটার দিকে। গ্রামের  বড়োরা যেখানে অপারগ, সেখানে এই ছোট্ট মেয়েটা বলছে যাবে গভীর কূয়োর নিচে!

কী সাহসী মেয়েরে বাবা। হ্যাঁ, অবশ্যই সাহসী মেয়ে হোসনা বানু। তোমরা হোসনা বানুকে চেনো না তো? শোনো বলছি। এই গল্পের মূল চরিত্রের নাম হচ্ছে হোসনা বানু। হোসনা বানু হলো সেই লুলুশিয়া গ্রামের ছোট্ট মোট্ট এক মেয়ের নাম। ছোট্ট হলে কী হবে, ওর সাহস ছিলো অনেক বেশি। সারা গাঁয়ের সবাই ওকে চিনতো। আর ভালোও বাসতো খুব। কারণ সে ছিলো খুব দুষ্টু মিষ্টি একটা মেয়ে। মেয়েটার বাবা ছিলো না। সে যখন অনেক ছোট্ট তখন এক ঘূর্ণিঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে ওর বাবাকে। অথবা এক দৈত্য হানা দিয়েছিলো এই লুলুশিয়া গ্রামে। সেই দৈত্যকে তাড়াতে এক তুমুল লড়াই করেছিলো হোসনা বানুর বাবা।

এক পর্যায়ে সেই দৈত্য তাকে ধরে নিয়ে গেছে। হোসনা বানু তার বাবাকে নিয়ে এরকম দুইটি গল্প শুনেছে গ্রামের লোকজনের মুখে। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সে জানে না। তার মায়ের কাছে জানতে চাইলে কোনো জবাব পাওয়া যায় না। মায়ের কাছে জানতে চাইলেই মা কেমন বিমর্ষ হয়ে যান। তিনি শুধু বলেন যে, একদিন আমি নিজে থেকেই বলবো তোমার বাবার কথা। মা কষ্ট পাবে ভেবে আর কিছু জানতে চায় না হোসনা বানু। অপেক্ষা করে তার হারিয়ে যাওয়া বাবার সত্যি গল্পটা শোনার জন্য। মায়ের বড় আদরের মেয়ে ছিলো হোসনা বানু। তাদের ছিলো ভেড়ার একটা খামার। আর ছিলো একটা বাগান। কালো গোলাপের বাগান। সেই ভেড়ার খামার ও গোলাপ বাগান দেখা শোনা করেই কাটতো তাদের সময়।

গাঁয়ের কারো কোনো বিপদ দেখলেই সাহায্য করতে এগিয়ে যেতো হোসনা বানু। যদিও খুব বড় কোনো উপকার করতে পারতো না, তবু চেষ্টা করতো সবার উপকার করতে। গ্রামের কূয়োর জল না পাওয়ার খবর শুনে হোসনা বানু বসে থাকতে পারলো না। কূয়োর ধারে বসে যখন গ্রামের বয়স্ক লোকজন ভাবছে তখন হোসনা বানু এসে বলল- আমি নামবো কূয়োর ভেতর। নেমে দেখবো কী হয়েছে। আমি নিশ্চয় ফিরিয়ে আনবো আমাদের মিষ্টি কূয়োর জল। হোসনা বানুর কথা শুনে প্রথমে সবাই নিষেধ করলো তাকে। কিন্তু ছোট্ট সাহসী মেয়ে হোসনা বানু বললো- আমি যদি কূয়োর তলানিতে না যাই তবে কে যাবে বলো? কেউ তো একজন সামনে আসো যে তলানিতে গিয়ে জলের ব্যবস্থা করতে পারো। না হলে গাঁয়ের সবাই জল না পেয়ে মারা পড়বে। হোসনা বানুর ডাকে কেউ সাড়া দিলো না।

কী করে দেবে? গ্রামের সবাই ছিলো খুব শান্ত আর ভীতু স্বভাবের। তাই কারো সাহস হলো না কূয়োর গভীরে নামার। কাউকে না পেয়ে হোসনা বানু নেমেই পড়লো কূয়োর ভেতর। রশি ধরে টুপ করে নেমে গেল হোসনা বানু।

নামলো তো নামলোই। আর উঠে আসার নাম নেই। সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল গেল। রাতটাও পেরিয়ে গেল। এরপর আবার সকাল হলো। দুপুর হলো। বিকেল হলো। রাত নামলো। এমন করে কত দিন কত রাত যে গেল তার হিসেব কেউ রাখলো না। সেই অন্ধকার কূয়োর তলায় হোসনা বানুর কী হলো সেই খবরও কেউ জানলো না। জলের তেষ্টায় কাতর হয়ে সবাই শুধু অপেক্ষায় করতে থাকলো আর অপেক্ষায় করতে থাকলো।

একদিন হঠাৎ করেই জল উঠে এলো মিষ্টি জলের কূয়োয়। আগের মতো স্বচ্ছ টলটলে মিষ্টি জল। জল পেয়ে সবাই খুশিতে মেতে উঠলো। জল পান করলো ইচ্ছেমতো।

তবে ছোট্ট দুষ্টু মিষ্টি হোসনা বানুকে আর দেখতে পেল না কেউ। কত যে অপেক্ষা করলো কিন্তু হোসনা বানু উঠে এলো না কূয়োর জলের তলা থেকে।

ওদিকে হলো কী, হোসনা বানু কূয়োর তলানিতে গিয়ে দেখলো সেখানে অন্ধকার আর অন্ধকার।  নামতে নামতে কতটা গভীরে যে নামলো তা সে নিজেও জানে না। কত সময় যে কাটলো, সেই হিসাবও রাখলো না। কূয়োর শেষ যে কোথায় তা কেউ বলতে পারলো না। যেতে যেতে যেতে অনেক গভীরে যাওয়ার পর জলের ছোঁয়া টের পেল হোসনা বানু। তারপর ডুবতে থাকলো জলের গভীরে।

ডুবতে ডুবতে কত জল যে পেরোলো তা কেউ জানে না। যখন তলানিতে ওর পা ঠেকলো তখন দেখলো সেটা একটা সমুদ্রের তলদেশ। সেই সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেল অক্টোপাস এগিয়ে আসছে ওর দিকে।

বিরাট আকৃতির নীল একটা অক্টোপাস। দৈত্যের মতো ভয়ানক দেখতে সেই অক্টোপাস। তার সারা গায়ে অসংখ্য শুঁড়। বিদঘুটে রকমের শুঁড়গুলোর রং বিভিন্ন রকম। শরীরটা গাঢ় নীল রঙের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৈত্যাকার নীল অক্টোপাসটা হোসনা বানুকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো। আর নিয়ে চললো শৈবালের ফাঁক ফোকরের মধ্যে দিয়ে। নিতে নিতে কত দূর যে নিয়ে গেল তা কেউ বলতে পারলো না। হোসনা বানু দেখতে পেল সামনে একটা বিশাল প্রাসা। সেই প্রাসাদের মাঝে নিয়ে তবেই ছাড়লো ওকে। তখন হোসনা বানু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। এতটা সময় ওর নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

প্রাসাদে এসে জানতে চাইলো এটা কোন জায়গা, তাকে কেন এখানে ধরে আনা হলো? প্রকাণ্ড নীল অক্টোপাসটা বলল, তোমাকে আমার দরকার খুকি। এই যে দেখছো, আমার এতো বড় প্রাসাদ। এখানে কোনো কাজের লোক নেই। তুমি এখানে থেকে আমার সব কাজ করে দেবে। আমি এক জাদুকর অক্টোপাস। নীলুম্বাস আমার নাম। আমার অনেক ক্ষমতা। আমাকে সকলে ভয় পায়। যে আমার কথা না শোনে তাকে আমি কাঁকড়া বানিয়ে দেই। ছোট্ট বিশ্রী কাঁকড়া। এই সমুদ্রের তলদেশে সবাই আমার কথা শোনে বুঝলে ছোট্ট মেয়ে? তোমাকেও আমার কথা শুনতে হবে। তা না হলে তোমাকেও হয়ে যেতে হবে একটা পুঁচকে কাঁকড়া। হোসনা বানু নীলুম্বাসের কথায় একদম ভয় পেল না। ও অক্টোপাসটাকে বলল, আমার নাম হোসনা বানু। আমি এসেছি আমাদের কূয়োর জল ফিরিয়ে নিতে। জলের জন্য গাঁয়ের সকলে খুব কষ্ট পাচ্ছে।

আর তুমি আমাকে ধরে এখানে বন্দি করে রাখবে, এটা কেমন কথা অক্টোপাস ভাই? তুমি দেখতে কত সুন্দর। নীল নীল শরীর তোমার। অসংখ্য রঙিন শুঁড় তোমার গায়ে। চাইলে এতগুলো শুঁড় দিয়ে তুমি নিজেই তো কত কাজ করতে পারো। তোমার নামটাও কী দারুণ। নীলুম্বাস, বাহ্ ।

ও জাদুকর অক্টোপাস, তোমার কী এমনটা করা সাজে? তুমি তো আমাকে সাহায্য করতে পারো। তুমি চাইলেই আমাদের কূয়োর মিষ্টি জল ফিরিয়ে দিতে পারো। তা না করে আমাকে তোমার প্রাসাদে আটকে রাখবে? আমাকে ছেড়ে দাও না জাদুকর নীলুম্বাস। নীলুম্বাস হোসনা বানুর কথায় খুশি হলো খুব।

বলল, বাহ্, তুমি তো বেশ সুন্দরভাবে কথা বলো। আর খুব সাহসী একজন মেয়ে তুমি। তোমাকে আমার খুবই ভালো লেগেছে মেয়ে। শোনো আমি কী বলছি। তোমাদের গ্রামের কূয়োটা হচ্ছে একটা দারুণ মিষ্টি জলের কূয়ো। এই বিশাল সমুদ্রে এতো জল দেখছো, এইসব হচ্ছে লোনা জল। এখানে কোথাও একফোঁটা মিষ্টি জল নেই। তাই আমি তোমাদের মিষ্টি জলের ওই কূয়োর সাথে আমার প্রাসাদের একটা সংযোগ করে দিয়েছি। যাতে আমি সেই মিষ্টি জল পাই। অবশ্য তুমি চাইলে আমি সেটা ছেড়ে দেবো। তবে তোমাকে আমার প্রাসাদে থেকে যেতে হবে। আর করে দিতে হবে আমার সকল কাজ। একেবারে রান্নাবান্নাসহ সকল কাজ, বুঝলে? তুমি যদি আমাকে কথা দিতে পারো যে আমার কথা শুনবে, তবেই তোমার গ্রামের লোকেরা ফিরে পাবে কূয়োর জল। হোসনা বানু তার গ্রামের সকলের কথা ভেবে জাদুকর নীলুম্বাস এর প্রাসাদে থেকে যেতে রাজি হয়ে গেল। তখন জাদুকর অক্টোপাস নীলুম্বাস ছেড়ে দিলো মিষ্টি কূয়োর জল। যে জলের জন্য লুলুশিয়া গ্রামের সবাই কূয়োর ধারে অধীর অপেক্ষায় ছিলো।

গ্রামের সবাই কূয়োর জল ফিরে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। তবে কেউ ভুলে গেল না দুষ্টু মিষ্টি সাহসী মেয়ে হোসনা বানুকে। গ্রামবাসীরা যখনই কূয়োর জল নিতে আসতো, তখনই ডাকতো ওকে। কারো ডাক হোসনা বানু শুনতে পেতো না। শুধু তার মায়ের ডাক ছাড়া। তার মা রোজ কূয়োর ধারে বসে কেঁদে কেঁদে তাকে ডাকতো। তার মায়ের সেই ডাক কূয়ো সমুদ্র ও জাদুকর অক্টোপাস এর প্রাসাদ ভেদ করে পৌঁছে যেতো হোসনা বানুর কানে। কিন্তু সে জবাব দিতে পারতো না। আর ফিরতেও পারতো না। সারাদিন রান্নাবান্নাসহ এতো এতো কাজ করে বেচারি হোসনা বানুর খুব কষ্ট হতো। কিন্তু কী করা যাবে, কাজ না করলে যে অক্টোপাস ভীষণ রেগে যেতো, আর কাঁকড়া বানিয়ে দেয়ার হুমকি দিতো। তাই মুখ বুজে সব কাজ করতো সে। জাদুকর অক্টোপাস নীলুম্বাস উঁচু দেয়ালের প্রাসাদে তাকে আটকে রাখতো।

অক্টোপাস কোথাও বের হলে প্রাসাদের সমস্ত দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে তবেই বেরোতো। কিন্তু একদিন বুদ্ধিমতী হোসনা বানু ঠিকই বেরিয়ে গিয়েছিলো প্রাসাদ থেকে। জাদুকর অক্টোপাস নীলুম্বাসকে ফাঁকি দিয়ে সে পৌঁছতে পেরেছিলো নিজের গ্রামে। নিজের মায়ের কাছে। সেটা কীভাবে হয়েছিলো জানো? সেটা হচ্ছে আর এক গল্প। সেই গল্প জানতে হলে তোমায় যেতে হবে এর পরের পর্বে। (চলবে)