সাফল্য না আসার পেছনে আমরা নানান অজুহাত বের করে থাকি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অজুহাতগুলো হলো আমাদের শারীরিক অক্ষমতা কিংবা জন্মগত বা জাতিগত সমস্যা। যেমন- কেউ বলে তার ব্রেইন অন্যদের মতো ভালো না, কারো অভিযোগ হলো- সে দেখতে খারাপ। কারো অভিযোগ হলো সে ভালো কথা বলতে পারে না। কেউবা বলবে সে খাটো, মোটা কিংবা অন্ধ। আজকে আমরা এমন কিছু মানুষের গল্প শুনবো যারা তাদের অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই জীবনে সফল হয়েছিলেন।
ইংল্যান্ডের রোয়ান এটকিনসন পড়াশোনা করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। অভিনয়কে ভালোবাসতেন। নিজে নাটক লিখতেন, অভিনয় করতেন, প্রযোজনা করতেন। তবে তাঁর সমস্যা ছিল তোতলামির। অভিনয়ের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সমস্যা। ঠিকমতো ডায়ালগ ডেলিভারি দিতে না পারলে তো চরিত্রই ফুটিয়ে তোলা যাবে না। অভিনয়েও সফল হওয়া সম্ভব হবে না। তিনি একদিন আয়নায় নিজেকে দেখলেন। নিজের অভিনয় দক্ষতা নিজেই যাচাই করলেন। খেয়াল করলেন যে, তিনি খুব ভালো এক্সপ্রেশন বা মুখভঙ্গি দিতে পারেন। তাই পরবর্তীতে ‘মিস্টার বিন’ এর কমিক চরিত্রে আবির্ভূত হন টিভি পর্দায়। ১৯৯০-৯৫ সালের সেই টিভি সিরিজ তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। কথা না বলে শুধু এক্সপ্রেশন দিয়েই তিনি বিশ্বের কোটি মানুষকে হাসিয়েছেন, তাদের মন জয় করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ের খাবি লামের কথাই ধরা যাক। খাবির জন্ম সেনেগালে। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বয়স যখন এক বছর তখন তার পরিবার ইতালিতে পাড়ি জমায় ভাগ্যের অন্বেষণে। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে একটি কারখানার কাজে যোগ দিয়েছিল খাবি। করোনাকালীন ২০২০ সালে তার সেই চাকুরিও চলে যায়। খাবি সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও তৈরি করতে শুরু করে। তবে তার অযোগ্যতা ছিল ভাষায়। সে ইংরেজি জানতো না। তাই তার কনটেন্ট বিশ্বের মানুষ কীভাবে বুঝবে? কেনই বা দেখবে! কিন্তু খাবি এর সমাধান বের করে ফেললো। মিস্টার বিনের মতোই সে শুধু অঙ্গভঙ্গি দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। তার দু’হাত সামনের দিকে প্রসারিত করে মানুষকে ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিমা বিশ্বব্যাপী তার সিগনেচার পোজ হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে শত কোটি মানুষের মন জয় করে নিলো খাবি। বেকার অবস্থা থেকে শত কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেল খাবি লামে। সুতরাং ভাষা না জানা বা স্পষ্ট কথা বলতে না পারাটাও যোগ্যতা হয়ে উঠতে পারে।
তোমাকে বেঁটে বলে খোঁটা দেয় লোকে? তাতে তোমার মন খারাপ? কিন্তু বেঁটে হওয়াটাও যে আশীর্বাদ হতে পারে, ভেবেছো কখনো? মাইক টাইসনের নাম তো শুনেছ? বিশ্ববিখ্যাত বক্সার। তার উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। আমেরিকার হিসেবে এবং অ্যাথলেটিকসের হিসেবে সেটি কম উচ্চতা। কারণ সমসাময়িক অন্য বক্সারদের উচ্চতা ছিল গড়ে ছয় ফুটের উপরে। কিন্তু মাইক টাইসন তার বেঁটে হওয়াটাকেই বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। আশ্চর্য হচ্ছো? কীভাবে সম্ভব? মাইক টাইসনের নক-আউট টেকনিকের একটি বিশেষ ঘুষির নাম ছিল- আপার কাট। অর্থাৎ উচ্চতায় ছোট হওয়ায় তিনি নিচের দিকে থেকে প্রতিপক্ষের থুতনিতে কষে ঘুষি লাগাতেন। তাতেই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় জ্ঞান হারাতো। নক আউট করে চ্যাম্পিয়ন হতেন মাইক টাইসন। লম্বা হলে তিনি এই সুবিধা পেতেন না।
আবার ভেবে দেখো ঢাকার ছেলে শওকত আলী তালুকদার নিপুর কথা। নিপু সাইজে খাটো। অভিনয় শিখেছেন। বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করতেন। একবার এক অনুষ্ঠানে তাকে অভিনয় করতে দেখে ভালো লেগে যায় ইত্যাদির প্রযোজক-উপস্থাপক হানিফ সংকেতের। তিনি ভাবলেন সে যেহেতু বেঁটে এবং চেহারা শিশুসুলভ, সুতরাং তাকে দিয়ে ‘নাতি’ চরিত্র ফুটিয়ে তোলা যাবে। সেই থেকে ইত্যাদিতে শুরু হলো হাস্যরসাত্মক ‘নানা-নাতি’ পর্ব। খাটো হওয়ার সুবাদে তিনি দেশবিখ্যাত হয়ে গেলেন।
এই ‘মোটকা’ কিংবা এই ‘ভোটকু’ বলে তোমাকে টিজ করে বন্ধুরা? তুরস্কের ইয়াসিন সেঙ্গিজেরও একই অবস্থা ছিল হয়তো। তার আছে বিশাল বড় ভুঁড়ি। হাঁটতে গেলেও সেই ভুঁড়ি দোলে। সেঙ্গিজ কনস্ট্রাকশনের কাজ করতো। শখের বশে সে একটি গানের সাথে তার ভুঁড়ি নাচানোর ভিডিও পোস্ট করে সামাজিক মাধ্যমে। ভাইরাল হয়ে যায় সেই ভিডিও। এরপর তার সাথে ভিডিও বানাতে আসে অনেকে। কয়েক বছরের মধ্যে সে শুধু ভুঁড়ি নাচিয়ে ভিডিও বানিয়েই মিলিয়ন ডলার আয় করে নিয়েছে।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতার নাম তো তোমরা জানো। মার্ক জাকারবার্গ একজন সফল টেক-উদ্যোক্তা। শত শত কোটি মানুষকে তিনি এক ফেসবুক দিয়ে বুঁদ করে রেখেছেন। ফেসবুকের রঙ হলো নীল। কারণ কী? কখনো ভেবেছো? নীল রঙ দেখতে সুন্দর, আকর্ষণীয়, নজরকাড়া- এগুলোতো আছেই। তবে বড় কারণ হলো মার্ক জাকারবার্গের বর্ণান্ধতা। জাকারবার্গ লাল-কমলা রঙের শেডগুলো দেখতে পান না। তার কাছে নীলের শেডগুলো খুব পরিষ্কার দেখায়। তাই তিনি যখন ডিজাইন করেন, তখন ফেসবুকের রঙ নীল করেন। তার রঙ দেখতে পারার অযোগ্যতা সারা বিশ্বকে এক রঙে আসক্ত করে রেখেছে। আমাদের দেশে হলে তো তাকে প্রতিবন্ধী বলে ক্ষেপাতাম, তাই না! হয়তোবা হতাশ হয়ে সে সব কাজ ছেড়ে দিতো।
এবার আসো অন্ধের গল্পে। রাসুল সা. এর একজন সাহাবী ছিলেন- আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.। তিনি ছিলেন অন্ধ। তবে কুরআনের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ছিল। কুরআনের হাফেজ ছিলেন তিনি। অন্ধ হলেও তিনি প্রতি ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে আদায় করতেন। মদিনার মসজিদে হজরত বেলাল রা. এর সাথে তিনিও মুয়াজ্জিন ছিলেন। বেলাল রা. আজান দিলে তিনি ইকামাত দিতেন। আবার রাসুল সা. কোনো সফরে গেলে আব্দুল্লাহকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। একবার যুদ্ধে যাবার জন্য সাহাবিদের বাছাই করা হচ্ছিল। তখন আব্দুল্লাহ রা. যুদ্ধে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তাকে বলা হলো, তিনি অন্ধ, তাই তিনি যুদ্ধে যাবার অযোগ্য। তিনি সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, অন্ধ হওয়ায় তিনি যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে যোগ্য। কীভাবে? তিনি বললেন- প্রথমত, যুদ্ধে আমি শত্রুদের দেখবো না বলে তাদের ভয় পাবো না, সাহসের সাথে সামনে এগিয়ে যাবো। আর দ্বিতীয়ত, পালানোর পথ দেখবো না বলে আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবো না। অন্ধত্বও যে যোগ্যতা হতে পারে সেটি তিনি এই ইতিবাচক কথার মাধ্যমে বুঝিয়েছিলেন।
অক্ষমতাকে ব্যবহার করে আমাদের দেশেও কিন্তু মানুষ সফল হয়। কীভাবে? ভিক্ষুকদের দেখো। অন্ধ, খোঁড়া, বোবা হলে তাদের আয় বেশি হয়। তাদের প্রতিবন্ধিতাকে তারা ভিক্ষার আয়ের মূল পূঁজি বানিয়েছে। এমনকি ভিক্ষায় সফল হবার জন্য অনেকে কৃত্রিমভাবে খোঁড়া হয় এমনও অনেক ঘটনা আছে।
সুতরাং তোমাকে ভাবতে হবে কীভাবে তুমি তোমার যোগ্যতার বিকাশ ঘটাবে। মনে রাখবে সৃষ্টিকর্তা যদি তোমাকে কোনো অক্ষমতা দিয়েও থাকেন, একই সাথে তোমাকে এমন কিছু যোগ্যতা দিয়েছেন যা সেই অক্ষমতাকে বহুগুণে উতরে নিয়ে যেতে পারে। তোমার কাজ হলো ইতিবাচক ধারণা নিয়ে সৃষ্টিকর্তার উপরে ভরসা রেখে সাফল্যের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম করে যাওয়া। তখন দেখা যাবে তোমার অক্ষমতা, অযোগ্যতাগুলোই যোগ্যতা হয়ে ধরা দেবে তোমার সামনে। ০