গাজার শিশুদের আর্তনাদ শুনতে কি পাও? নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদ জানানোর কেউ কি নেই?

আহমদ মতিউর রহমান

0
22

৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা নিজ গৃহে পরবাসী। তাদের বাড়িঘর দখল করে আছে হানাদার ইসরাইলিরা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে হামাস ইসরাইলিদের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সেই হামলার পর থেকে ইসরাইল নতুন করে হামলা শুরু করে। হয়ে যায় আরও বেপরোয়া। গত দেড় বছরে তারা ৫১ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। মাস দেড়েকের যুদ্ধবিরতির পর আবার হামলা শুরু করে ইহুদিবাদী ইসরাইল। ফলে ফিলিস্তিনের গাজা হয়ে ওঠে এক মৃত্যু উপত্যকা। এই হত্যার প্রধান শিকার শিশুরা। কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না ইসরাইলি মৃত্যুদানবের হাত থেকে। ইসরাইলের বর্বর গণহত্যার শিকার হয়ে শহিদ হয়েছে গাজার হাজার হাজার শিশু। যেসব শিশু বেঁচে আছে; মৃত্যুভয়, অবর্ণনীয় দুর্দশা, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে তারাও যেন জীবণ্মৃত।
ইসরাইল এতটাই নির্দয় যে, ফিলিস্তিনে কোনো মানবিক সহায়তাও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কত শিশু বাবা হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে; কত শিশু মা, ভাইবোন হারিয়ে নির্বাক; ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে আছে কত শিশু; কেউ জানে না। তাদের শৈশব বলে কিছু নেই। শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই জানুয়ারিতে বলেছিলেন, ইসরায়েল গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা হামলা চালিয়েছে। ৯০ শতাংশের বেশি স্কুল ধ্বংস করেছে। এমনকি স্কুল ভবনে আশ্রয় নেওয়া নারী-শিশুরাও হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। পুরো গাজাই যেখানে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে; গাজাবাসীর জীবন বাঁচানোই যেখানে দায়; তাদের শিশুর শিক্ষার কথা চিন্তা করা অকল্পনীয়। বিশ^বাসী নীরবে তাকিয়ে দেখছে এসব। প্রশ্ন জাগে প্রতিবাদ জানানোর কেউ কি নেই?

২.
দিনে দিনে ইসরাইলিদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে গাজা নগরীর উপকণ্ঠে শুজাইয়া এলাকা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে অসহায় শিশুদের নিয়ে পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনি নারীরা। এ দৃশ্য দেখে বিশ্ব হতবাক। কিন্তু কেউ কিছু করছে না। এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় প্রায় ১৯ হাজার শিশু শহিদ হয়েছে। মা-বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে ৩৯ হাজার শিশু। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা ও দায়মুক্তির কারণে ইসরায়েলি দখলদারেরা ফিলিস্তিনি শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ করতে আরও উৎসাহী হচ্ছে। ইসরায়েলের অপরাধগুলো তুলে ধরার জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে আহ্বান জানায় হামাস।
গাজাস স্টোলেন চাইল্ডহুড বা গাজার চুরি হয়ে যাওয়া শৈশব শিরোনামে আলজাজিরা ২৬ মার্চ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখানো হয়েছে, ইসরাইল প্রতি ৪৫ মিনিটে গাজার একটি শিশুকে হত্যা করছে। তার আগের প্রায় সাড়ে পাঁচশ দিনে প্রতিদিন প্রায় ৩০টি শিশু হত্যা করেছে। সে হিসাবে ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে সাড়ে ১৭ হাজার শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইল। যার মধ্যে সাড়ে ১৫ হাজার শিশুকে চিহ্নিত করা গেছে, বাকিদের কবর হয়তো হয়েছে ধ্বংসস্তুপের নিচে। এর মধ্যেও কেউ বেঁচে আছে কি না, কে জানে!
ইসরাইলি বোমায় এমন হাজারো শিশু শহিদ হয়েছে, যারা প্রথম জন্মদিনও পালন করতে পারেনি। ১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর শহিদ হয়েছে মোহাম্মদ, যার গল্প তুলে ধরেছে আলজাজিরা। যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ১৮ মার্চ যখন ইসরাইল গাজায় পুনরায় বোমা হামলা শুরু করে, তার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ৩৩৬ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ১৮৩ শিশু, যেখানে ১ বছরের মোহাম্মদ তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সঙ্গে শহিদ হয়। আল মাওয়াসি ক্যাম্পে বিমান হামলায় তারা শহিদ হয়। এটি এমন ক্যাম্প, যাকে ইসরাইল বলেছিল ‘সেফ জোন’। এমন আরও বহু কথিত নিরাপদ পরিসরে ফিলিস্তিনি শিশু ও নিরীহ নাগরিক প্রাণ হরিয়েছে। এভাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ৫১ সহস্রাধিক মানুষকে শহিদ করেছে ইসরাইল। যেখানে এক-তৃতীয়াংশ শিশু ছাড়াও আছে নারী, সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মী, মানবিক সহায়তাকারী, শিক্ষক, চিকিৎসক। হামলা থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতাল, এমনকি রোগীরাও।
দেড় বছরের অধিক সময় ধরে ইসরায়েল গাজায় এমন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট কাফন মোড়ানো কফিন নিয়ে হাজারো পিতা-মাতা-স্বজনের আর্তনাদ আমরা দেখছি। সাধারণ বিবেকসম্পন্ন মানুষ এমন একটি হত্যাকাÐও মেনে নিতে পারে না। অথচ ইসরাইল একটি প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, কী করছে বিশ্ববিবেক? কেবল এই দেড় বছরই নয়; ইসরাইল নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে যুগ যুগ ধরে। গায়ের জোরে ফিলিস্তিনিদের ভ‚মি দখল করে সেই ফিলিস্তিনিদের ওপরেই গণহত্যা চালানোর পর ইসরাইলের কিছুই হচ্ছে না কেন? নিষ্পাপ, নিরীহ ফিলিস্তিনি শিশুরা প্রতিদিন শহিদ হচ্ছে, তাতে এমনকি মুসলিম বিশ্বেরও টনক নড়ছে না। মুসলমানদের কয়েকটি দেশ নামকাওয়াস্তে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অথচ ইসরাইল ঘিরে আছে মুসলিম বিশ্ব।

৩.
গাজার মোট ২৩ লাখ বাসিন্দার ৫১ শতাংশই শিশু। উপত্যকাটিতে ইসরাইলের হামলায় নিহত শিশুদের তথ্য আরও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছে ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাদের তথ্যমতে, গাজায় নিহত শিশুদের মধ্যে ২৭৪টি নবজাতক আর এক বছরের কম বয়সী ৮৭৪ শিশু রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, তখন থেকে উপত্যকাটিতে অন্তত ৫০ হাজার ৬৬৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত ১ লাখ ১৫ হাজার ২২৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে গত ১৮ মার্চ থেকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর নিহত ১ হাজার ২৪৯ জন রয়েছেন। এই সময় আহত হয়েছেন ৩ হাজার ২২ জন।
১৮ মার্চ থেকে গাজায় হামলার পাশাপাশি দখলও শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। রাফা ও খান ইউনিসে চলছে স্থল অভিযান। এক দিনে উত্তর গাজার বেইত হানুন, শুজাইয়া এবং দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের কিজান আবু রাশওয়ানসহ বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৩০জন নিহত হয়েছেন। আর আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজাজুড়ে প্রাণহানি হয় ৮৬ জনের। গাজায় ইসরাইলের বোমা হামলার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন উপত্যকাটির একজন সাংবাদিক। স্থানীয় সাংবাদিকেরা দাবি করেছেন, ওই ভিডিওতে বোমার আঘাতে মানুষের শরীর কয়েক তলা ভবনের সমান ওপরে ছিটকে পড়তে দেখা গেছে। ভিডিওটি শেয়ার করা সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘শিশুদের আত্মা ও শরীর স্বর্গে পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি রকেট ব্যবহার করছে দখলদার ইসরায়েলিরা।’ উল্লেখ্য গাজায় ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকেই দেশটিকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে উপত্যকাটি যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় আনার কথা বলেছে। গাজার ৮০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইল।

৪.
ফুটফুটে শিশু বানাত আল-আলোউত। আরেক শিশু হুর আল-সালোউত। হুরের বয়স এক বছর। কবে সে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা শুরু করবে, সে অপেক্ষায় ছিলেন মা-বাবা। আর ঈদ কবে আসবে, কী কেনাকাটা করবে তা নিয়ে ছোট্ট সালমাহ এসলিয়েহ যেন আরও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সালমাহের ঈদ আর আসবে না, আসেনি। হুর আল-সালোউতের প্রথম হাঁটা, আধো আধো বুলিতে কথা শোনার অপেক্ষা শেষ হবে না কোনো দিন। ইসরাইলের নির্মম হামলা মা-বাবার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে গাজার এই শিশুদের। এর পর থেকে মৃত্যুর মিছিল চলছেই। বিশ্বের দেশে দেশে এই হামলা ও নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে বাংলাদেশেও। এই মৃত্যুর মিছিল কবে থামবে? বিশ্ববাসীকে বলতে ইচ্ছে করে- গাজার শিশুদের আর্তনাদ শুনতে কি পাও? ০