আহমাদ আব্দুল হাই এর তৈরি প্রেজেন্টেশনটি ছিলো জার্মান ভাষায়। বারো বছর বয়সী এই ভদ্রলোক বাংলা বলতে কিছু পারেন, তবে লিখতে এখনো পারেন না তেমন। অচিরেই পারবেন আল্লাহ চাইলে। আহমাদের সাথে নিবিড় আলোচনার পর বাংলায় স্মৃতিকথাটি তৈরি করে দিয়েছেন একজন ঘোস্ট রাইটার।
সম্ভবত ২০২৩ সাল। রমাদানের প্রস্তুতি বিষয়ে আমার অনলাইন মাদ্রাসার এসাইনমেন্ট হিসেবে কুরআনের আয়াত এবং হাদিস কম্পাইল করছিলাম পাওয়ার পয়েন্টে। সে সময়ই জানতে পারি আমার হামবুর্গের বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটা প্রি রমাদান প্রোগ্রামের প্ল্যান করা হচ্ছে। ওই প্রোগ্রামের জন্য আমি দেশে দেশে শিশুরা কেমন করে রমাদান উদযাপন করে সেটার ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশনের স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছি। আমাকে সাহায্য করেছিলেন আমার মা বাবা। এমনকি আমার ছোট ভাই মুহাম্মাদও। কারণ, আমি যখন বাসায় প্র্যাকটিস করছিলাম তখন সে স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে সাময়িক বিরতি দিয়ে চোখ গোল করে দেখছিল, ‘কী বলছে ভাইয়া এত! কীইবা লেখা আছে স্ক্রিনে অত!’
প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে করতে সেসময় পৃথিবীর এই পাড়া সেই রাস্তা ওই মহল্লায় দারুণ ঘুরেও বেড়িয়েছি। আমরা ঠিক যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছিলাম রমাদানকে স্বাগত জানিয়ে মালয়েশিয়ার প্রাইমারি পড়া ছেলেমেয়েরা কেমন করে তাদের শ্রেণিকক্ষ সাজিয়ে তুলেছে। আরও দেখছিলাম পুলওয়ামার বইয়ের দোকানে একজন কিশোর সীরাত পড়ছিল। এই ব্যাপারটা আমাদের রাসুল স. এর জীবনী পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। কথা বলেছিলাম আমরা বাসার সবাই এটা নিয়ে।
আমরা আরও দেখতে পাচ্ছিলাম মসুলের আগরবাতির ধোঁয়া। জামা মসজিদ চত্বরে সবাই হাসি মুখে ইফতারে শামিল হয়েছে। তিউনিশিয়া, কেনিয়ার ছোট ছোট মানুষগুলোর দুলে দুলে কুরআন পড়ার ছন্দে আমরা আন্দোলিত হয়েছি।
আমি বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। রমাদানে যাওয়া হয়নি কখনো। যাব ইনশাআল্লাহ। শুনেছি বাংলাদেশে নিজেকে গড়ার জন্য বইপত্র পড়ে সেখানকার শিশুরা। রমাদানে আর একটু বেশি পড়ার চেষ্টা তারা করে। গরিব-ধনী নির্বিশেষে সাধ্যমত শিশুরা রোজা রাখার চেষ্টা করে, তারাবির নামাজের জন্য প্রস্তুতি থাকে তাদেরও। তবে বাংলাদেশে অনেক দরিদ্র পরিবার বাস করে। তাদের জীবন যাপন, চেষ্টা এবং সাধ্যের কথা আমি যত জানতে পারি, ততই ভেতর থেকে এক ধরনের শূন্যতা এবং কষ্ট অনুভব করি। যাকাত এবং সাদাকার সঠিক বণ্টন দেশের মানুষের দুর্দশা নিরসনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি জেনেছি।
একটা পর্যবেক্ষণ যোগ করি। রমাদান আমাদের আত্মশুদ্ধি এবং আত্মসংযমের কথা মনে করিয়ে দেয়। পানি ও খাবারের অপচয়, ভোজন বিলাস, অস্বাস্থ্যকর খাবার, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা, বিদ্যুতের অপব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে অনেক বেশি চিন্তা করার এবং সচেতন হবার দরকার সে কারণে। জলবায়ু, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজগুলো আমরা আসলে ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক কোনো দিক দিয়েই করতে পারি না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন ইকো ফ্রেন্ডলি রমাদান নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের ব্যাপারে সতর্কতা তৈরি হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার না করা এবং বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপায় উপকরণ নিয়ে মানুষের উদ্যোগ এবং সচেতনতা দেখা যাচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে খুতবায় অপচয় রোধ, পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে জেনেছি।
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তাসহ কিছু এলাকার অনেক মসজিদেই ইফতারের সময় আগতদের পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবারের পাত্র সাথে আনতে বলা হয়। অনেক সময় কলাপাতায় খাবার দেয়া হয় প্লাস্টিক এড়াতে। তুরস্কের মসজিদগুলোতে খাবারের অপচয় রোধে সুষমভাবে খাদ্য বিতরণ করা হয়। আরব আমিরাতের অনেক মসজিদ সৌরশক্তি ব্যবহার করে জ্বালানির ওপর চাপ কমায়। মালয়েশিয়ায় আরবান ফার্মিং প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিজেদের খাদ্য নিজেরা চাষ করতে পারে। একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রয়োজন এই পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।
জার্মানির অনেক মসজিদেই শিশুদের জন্য রমাদান ইভেন্ট হয়। আয়োজনগুলোতে শিশুরা কুরআন পড়ে, হাদিস শেখে, নবীদের গল্প বলে। মাঝেমাঝে কিছু ক্র্যাফটিং এর কাজ করে, ইফতারে বড়দের সাহায্য করে, তারাবিও পড়ে একসাথে। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কে রমাদানের সময় মসজিদে গিয়েছি আমি। অনেক মানুষ একসাথে তারাবি পড়েন সেখানে। বাচ্চারা নামাজের ভেতর ব্রেক নিয়ে খেলে কেউ কেউ। তাদের জন্য খাবারও রাখা থাকে কোথাও। প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম কসোভো, ফ্রান্স, কিভের মসজিদে মা বাবার কোলে চড়ে আসে ওরা। ইন্দোনেশিয়ার পার্কে ইফতার শেষে ছোট ছোট শিশুরা খেলছে। তারাবির আগ পর্যন্ত হয়তো ছোটাছুটি করে খেলবে তারা। ওদিকে লেবাননের চৌখুপী পথে সেহেরির সময় মোহাম্মদ ফাউনাস নামের এক ব্যক্তি আলতো হাতে ড্রাম বাজিয়ে হাঁটেন, শিশুরা তাকে ঘিরে জড়ো হয়। মোহাম্মদ ফাউনাসের পায়ের আওয়াজ কল্পনা করতে করতে যেন পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে ঘুরে বেড়াই। মিশরের অনেক পাড়া মহল্লায় শিশুরা ইফতারের পর তাকবির দিতে দিতে তারাবিতে যায়। এই ছবিটা আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল। ইচ্ছে করছিল সেই তাকবিরে শামিল হতে।
ফিলিস্তিনী শিশুদের রমাদান এবং ইফতারের দৃশ্যগুলো খুব কষ্টকর। বুক ভেঙে যাওয়ার মতো। সীমাহীন জুলুমের শিকার এই মানুষগুলোর প্রতিরোধ এবং বেঁচে থাকার যুদ্ধ আমাদের অনেক শেখায়। শেখায়, সমান্তরাল বিশ্বে এমন অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে, মানুষ হিসেবে যেন সেগুলো উপলব্ধি করি। জীবন সম্পর্কে অভিযোগের যেন লাগাম টানি। ধ্বংসস্তুপের ভেতরেও তাদের রমাদান, নামাজ, তারাবি, সুস্থ সুন্দর বেঁচে থাকার জন্য চমৎকার সব উদ্যোগ আমার অনুভবে প্রবলভাবে কড়া নেড়ে দেয়।
সিরিয়ার ইদলিবে। ইফতারের পর। মোহাম্মদ বারতাবি গল্প শোনান শরণার্থী ক্যাম্পের শিশুদের। কারো কারো ঘরবাড়ি হয়তো কবরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। বিষন্ন বাদামি চোখ, অলিভের ঘ্রাণমাখা ছোট্ট মানুষগুলো বারতাবির গল্পে মগ্ন হয়। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ভুলে যায় তাবৎ বারুদের স্মৃতি- রক্তাক্ত স্বজন, ভিটেমাটিহীন বেঁচে থাকা।
আমি দেখতে পেলাম গল্প শুনে শিশুরা তাদের বেশুমার দুঃখ দিন দুঃখ রাতকে দূরে সরিয়ে পরম আনন্দে হেসে উঠলো। ০