বাংলা সন: আমাদের ঐতিহ্য

চঞ্চল শিহাব

0
53

আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে ক্যালেন্ডারের ভূমিকা অনেক। দিন তারিখ জানতে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করতে লাগে এই ক্যালেন্ডার। বাংলায় যাকে বলে বর্ষপঞ্জি। আমরা সাধারণত যে বর্ষপঞ্জি দিয়ে হিসাব রাখি সেটা ইংরেজি সালের। সব কাজেই এই সালের দিন তারিখগুলো ব্যবহার করা হয়। আমাদের নিজেদের একটা সন আছে, যার নাম বাংলা সন, তার ব্যবহার কম। শহরের অনেকেই তো জানেও না বাংলা সনের দিন তারিখ। কিন্তু পহেলা বৈশাখ নববর্ষের দিনটি এসে আমাদের জানান দিয়ে যায় বাংলা সন যে আছে। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সন ইসলামের উত্তরাধিকার বহন করছে। হিজরি সন থেকে এর উদ্ভব বলে এমনটা হয়েছে। ফলে এই সন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে।
আজ তোমাদের বলবো এই সনের কথা। বাংলা সনের শুরু কোথা থেকে অথবা কেনো বাংলা সন প্রবর্তন করা হলো, এইসবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যে ১৪৩২ সনকে আমরা আমন্ত্রণ জানাতে যাচ্ছি, বরণ করতে যাচ্ছি- এর গণনা কিন্তু এক, দুই থেকে শুরু হয়নি। বাংলাদেশে প্রচলিত তিনটি সনের মধ্যে হিজরি সনই হচ্ছে প্রাচীন সন। এখানে ইসলাম প্রচার প্রথম ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর চল্লিশ দশকের দিকে। তখন থেকেই এখানে হিজরি সনের আগমন ঘটেছে। আর মোগল বাদশাহ আকবরের আমলে হিজরি সনকে সৌর গণনায় এনে যে সন এখানে প্রচলিত হয়েছে সেটাই বাংলা সন।
বাংলা সনের প্রবর্তনের সময় ধরা হয় ১৫৫৬ সাল থেকে। প্রবক্তা ছিলেন মোগল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীকে একটি সৌরসন প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। তিনি ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। সে সময়ের কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চান্দ্রসন হওয়ায় প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। খাজনা আদায়ে সমস্যা হতো।
এ কারণে সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যার কৃষকদের ফসল উৎপাদনের সময়ের সঙ্গে মিল থাকবে। নতুন এই সাল আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে।
আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ তথা ৯৬৩ হিজরিতে বাদশাহ্ আকবর তাঁর পিতা বাদশাহ্ হুমায়ূনের মসনদে বসেন। তিনি বহু সংস্কারমূলক কাজ করেন। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ হওয়ায় ঋতুর সাথে এর মাসগুলো স্থির থাকতে পারে না, ফলে রাজস্ব আদায়ে কয়েক বছর পরপর দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হওয়া দেখে বাদশাহ্ আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে একটি নতুন সৌরসন উদ্ভাবনের জন্য সে সময়ের একজন বিশেষজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেউল্লাহ্ সিরাজীকে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে দায়িত্ব দেন।
তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরি সনের বর্ষকে বজায় রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করেন। তা ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ্ আকবরের দরবারে পেশ করেন। আকবর তাতে অনুমোদন দেন এবং এক ফরমান জারি করে এই সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের ঘোষণা দেন। হিজরি সনের এই সৌররূপ নতুন সনের সঙ্গে হিজরি সনের আরবি মাসগুলোর স্থলে যে যে অঞ্চলে এ সন গেলো সে সে অঞ্চলে প্রচলিত মাস তাতে সংযোজিত হয়। হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররমকে প্রথম মাস ঠিক রেখেই যে অঞ্চলে এই নতুন সন গেল সেই অঞ্চলে মুহররমে যে মাস ছিল সেই মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। এই নতুন সন প্রর্বতনের বছরেই আকবর কর্তৃক গঠিত বাংলা প্রদেশ বা সুবা বাংলায় তা চলে আসে। তখন এখানে মুহররমে ছিল বৈশাখ মাস। তাই এখানে নতুন সনের প্রথম মাস হিসেবে স্থির করা হয় বৈশাখকেই।
এই বৈশাখ মাস হচ্ছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। শকাব্দের নববর্ষ আসে চৈত্র মাসে, আর সেই চৈত্র মাস হয় নতুন সনের দ্বাদশ মাস। এই নতুন সন বাংলাদেশে এসে বাংলা সন নামে অভিহিত হয়। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণ। এই মাসটির নামকরণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়নি যেমনটা অন্য মাসগুলোর ক্ষেত্রে করা হয়েছে। সে কথা পরে বলছি। মজার বিষয় হলো অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ অগ্র বৎসর বা বছরের প্রথম মাস। অগ্র মানে প্রথম হায়ণ মানে মাসে। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নববর্ষ সূচিত হতো হেমন্তকালের যে মাসটিতে, সেই মাসটির নামকরণ করা হয়েছিল অগ্রহায়ণ। এক সময় নবান্নের আনন্দ নিয়ে হেমন্তকালে নববর্ষ আসতো বিশেষ এক আমেজে।

সঠিক হিসাবের জন্য পরিবর্তিত বাংলা সালের দৈর্ঘ্য হয় ৩৬৫ দিন। কিন্তু পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লাগে। এই ঘাটতি দূর করার জন্য গ্রেগরিয়ান সালে প্রতি চার বছর পর পর ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে একদিন যোগ করা হয় (শুধু যে শত বছর ৪০০ দিয়ে ভাগ হয় সে বছর যোগ করা হয় না)। শুরুর দিকে বাংলা সাল এই অতিরিক্ত সময়কে গণনায় নেয়নি। পরে এই ঘাটতি দূর করার জন্য বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পরিচালনায় একটা কমিটি গঠন করা হয় ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে বাংলা একাডেমির সুপারিশ করা পঞ্জিকা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। এটি এখন আরো সংস্কার করে চার বছর পর পর লিপইয়ার বা অধিবর্ষ যোগ করা হয়েছে। ফলে ১৪ এপ্রিল প্রতি বছর ১ বৈশাখ হবে। দিনের কোনো হেরফের হবে না।
বাংলা নববর্ষে এখন সাধারণ ছুটি থাকে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নববর্ষ উদযাপিত হয়। ধর্ম নির্বিশেষে সবাই দিনটি উদযাপন করে। ফলে এটি এখন আমাদের একটি জাতীয় উৎসবের দিন। এ দিন বসে বৈশাখী মেলা। সবাই বাঙালি খাবারের আয়োজন করেন। থাকে খই মুড়ি বাতাসা ইত্যাদি। উড়ানো হয় বেলুন। বাজানো হয় পাতার বাঁশি থেকে শুরু করে নানান ধরনের বাঁশি। এখন অবশ্য পান্তা-ইলিশের চল দেখা যায় শহরে। তবে পান্তা-ইলিশ অতীতে ছিলো না। ব্যবসায়ীরা এ দিনে খোলেন হালখাতা। তবে প্রথাটা এখন সবাই অনুসরণ করে না। স্বর্ণের দোকান বা বনেদি ব্যবসায়ীরা তা ধরে রেখেছেন। হালখাতা হচ্ছে বছরের হিসাব রাখার নতুন খাতা। পুরনো হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা চালু হয় এ দিনে। এখন পোশাকেও নববর্ষ নতুন আমেজ নিয়ে আসে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য তা অনেক আনন্দ বয়ে আনে।

কীভাবে এলো বাংলা মাসের নাম
এবার বলছি বাংলা মাসের নামগুলো কী করে এলো। বিভিন্ন নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয়। এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে সে সময় প্রচলিত শকাব্দ থেকে। যখন বাংলা সন চালু হয় তখন শকাব্দ ছাড়াও আরো বহু সন প্রচলিত ছিল।
বাংলা সনের সঙ্গে শকাব্দের যে মাসগুলোর নাম সংযুক্ত করা হয় তার অধিকাংশেরই নামকরণ হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের নামে। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস। একইভাবে জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, শ্রাবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্র মাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ মাস, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুন মাস, চৈত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস নামকরণ করা হয়েছে।
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।