শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি

ডা. আশরাফ হোসেন

0
197

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয় জানো ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্ক-কে সংক্ষেপে ইন্টারনেট বা শুধু নেট বলা হয়। ইন্টারনেট বর্তমানে মানুষের বহু কাজ সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে আবার বিরূপ প্রভাব ফেলছে স্বাস্থ্যে। এ নিয়ে বেশ গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। সব গবেষণার শেষে বলা হচ্ছেÑ ইন্টারনেট আসক্তি মাদকের মতো। এটি শরীর-মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের সাইট নিয়ে পড়ে থাকা শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক সমস্যার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা বলছেন, শিশু-কিশোরদের মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারে আসক্তি বাড়ছে। তা থেকে তারা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এসব শিশু-কিশোর হয় গেম খেলে, না হয় সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে চ্যাট করে সময় কাটায়। তারা বাস্তব দুনিয়া থেকে দূরে সরে যায়। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে কিশোরেরা বাস্তব থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়। তারা একটি কাল্পনিক জগৎ গড়ে তোলে এবং তাতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। তাদের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।
মানসিক সমস্যার প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা ও কথাবার্তা বন্ধ করে দেওয়া ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা। যদি শিশুর কাছ থেকে জোর করে ডিভাইস কেড়ে নেওয়া হয়, তবে সে মেজাজ দেখাতে শুরু করে বা রেগে যায়। অনেক সময় শিশু বাজে ব্যবহার শুরু করে।

বন্ধুরা, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোরদের মধ্যে মোবাইল গেম বা সামাজিক যোগাযোগে আসক্তি তৈরির প্রাথমিক কারণ হিসেবে বাবা মায়ের নজরদারির অভাবকেই দায়ী করা হয়। বেশির ভাগ সময় বাবা-মা নিজেদের দৈনন্দিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং সন্তানকে অবহেলা করেন। অনেক সময় মা-বাবা সন্তানের মানসিক সমস্যার কথাটা ধরতে পারেন না। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যান না।
অনেকেই মানতেই চান না যে এটা মানসিক সমস্যা। অনেকেই তাই চিকিৎসকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন। এখানেই মনোবিদ ও মানসিক সমস্যায় ভোগা রোগীদের সঙ্গে একটা দূরত্ব থেকে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকেই যদি মা-বাবা শিশুদের প্রতি নজর রাখতে পারেন, তবে এই মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি কম। অবশ্য ইন্টারনেট বা ডিভাইস ব্যবহার কতটুকু করলে তা আসক্তির পর্যায়ে পড়ে, তার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেননি বিশেষজ্ঞরা। অনেক সময় তিন থেকে চার ঘণ্টা বা ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মোবাইল ব্যবহার করলে আসক্তির পর্যায়ে চলে আসে। এর পরিবর্তে শিশুদের বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য কাজে যুক্ত করতে পারেন মা-বাবা। এতে তারা বাস্তব দুনিয়ার মুখোমুখি হবে।

শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ন্ত্রণে ৭ উপায় : প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ করতে বাবা-মাকে মূলত দুটি জিনিস যোগাযোগ-মাধ্যমে রাখতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো বিপদে পড়ছে কিনা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তারা কোনো আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে কি না।
এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সাইবার অপব্যবহার এখন খুব সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এটি একটি হুমকির জায়গা। আরেকটি হচ্ছে আসক্তি। শিশুরা তখন ইন্টারনেট ছাড়া থাকতেই পারে না বা থাকতেই চায় না।

শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি কমানোর কয়েকটি উপায়-
* কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ ইনস্টল করুন। প্যারেন্টাল সেফ ব্রাউজার একটি অ্যাপ আছে। এটি যদি শিশুর ডিভাইসে ইনস্টল করা হয় এটি ব্যবহার করে কোনো ধরনের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট দেখতে পারবে না শিশু। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই নিরাপত্তা-বিষয়ক কিছু অ্যাপ ইনস্টল করা উচিত।
* প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন। শিশুদের যদি কোনো ডিভাইস দেওয়া হয়, তা হলে তাতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করাটাই নিরাপদ। গুগলে একটা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সিস্টেম আছে, যা ব্যবহার করে শিশু কী দেখছে তার ওপর নজরদারি করা সম্ভব।
* ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার সময় সচেতন হোন। কোম্পানির কাছ থেকে ইন্টারনেট সংযোগটি নেওয়া হচ্ছে তা শিশুর জন্য সেফ ইন্টারনেটের ফিচারটি আছে কিনা সেটি যাচাই করে নিন।
* চাইল্ড ভার্সন অপশনটি ব্যবহার করুন। ফেসবুক ও মেসেঞ্জারের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের চাইল্ড ভার্সন আছে। সেক্ষেত্রে শিশুদের একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দেওয়া যায়, যেটি তারা ব্যবহার করলেও অভিভাবকদের সুপারভাইস করার সুযোগ থাকে।
* শিশুর সঙ্গে আপনিও অংশ নিন। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় আপনিও শিশুর সঙ্গে বসুন। শিক্ষামূলক বিভিন্ন চ্যানেল ও ওয়েবসাইট রয়েছে। তাদেরকে সেগুলো দেখতে উৎসাহিত করুন। নতুন কিছু শিখতে বা তৈরি করতে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলুন।
* আপনি কী দেখছেন সে বিষয়েও সতর্ক হোন। বাড়ির বাবা-মা বা প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা যদি ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে আপত্তিকর কিছু সার্চ করে বা দেখে, তা হলে সেগুলো ঐ আইপি অ্যাড্রেসেই জমা হয়। ঐ ইন্টারনেট ব্যবহার করে যদি বাড়ির শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরাও কিছু ব্রাউজ করে তা হলে সেই জিনিস বা কন্টেন্টগুলো তাদেরও সামনে চলে আসে। তাই সতর্ক হোন।
* শিশুর ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সময় বেঁধে দিন। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে ইন্টারনেট সংযোগ বাসায় কখন কখন থাকবে আর কখন
থাকবে না, সেটির একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।

বাবা-মার সাথে দূরত্বের কারণে সন্তান অনেক সময় ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই তাকে সময় দিতে হবে। নৈতিক শিক্ষার কেনো বিকল্প নেই। তাকে নীতিবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে ওয়েব দুনিয়ার অশুভ দিকগুলো থেকে সে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।