পদ্মাপাড়ের বিলু

হোসেন মাহমুদ-এর আত্মজৈবনিক উপন্যাস

0
48

পর্ব : দুই
শীত-কুয়াশার দিন

এবারে প্রথম পৌষেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। বিলু দেখেছে, শীতকাল এলেই সূর্যটা কেমন কাহিল হয়ে পড়ে। ওঠেও বেশ দেরি করে। যেন সারারাত লেপের ওমে ছিল। সকালের ঠা-ায় উঠে আসতে তাই ভারি আলসেমি তার। এদিকে আবার বিকেল নামার পরপরই সূর্য নেতিয়ে পড়ে। ভাবখানা যেন- যথেষ্ট হয়েছে বাপু, দিনমান তো তাপ-তুপ দিলাম। আর না। এখন আমি যাই, একটু বিশ্রাম নেই গে। তোমরা গরম জামা-কাপড় গায়ে দিয়ে আর লেপ-কাঁথার ওমে রাতটা পাড়ি দাও দিকিনি। আবার কাল সকালে তোমাদের সাথে দেখা হবে আমার। তো, সূর্যের আলো নরম হয়ে আসার সাথে সাথেই নোটিশ জারি করতে শুরু করে ঠা-া। পুবের মাঠের গায়ে পা ফেলে এগিয়ে আসে হালকা কুয়াশা। সন্ধ্যের বেশ আগে দিয়েই ছেলেপুলে আর বুড়ো মানুষরা গায়ে চাদর জড়াতে শুরু করে।
শীতের আবার নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। রাত যত বাড়ে, শীতও যেন তত বাড়ে। লেপের ওমে তখন কি যে আরাম। চোখে ঘুম যেন পর্দার ওপর পর্দা বিছাতে থকে। সে ঘুম ভেঙে উঠতে মন চায় না অনেকের। কিন্তু শুধু ঘুমালে তো আর চলে না। নানা কাজ-কর্ম আছে। যত শীতই পড়–ক না কেন, সে সব কাজ তো করতেই হয়। নইলে জীবন চলে না।
শীতকালটা বিলুর কাছে তেমন ভালো লাগে না। বিশেষ করে ঠা-াটা সহ্য করা মুশকিল। তার একটা চাদর আছে শীতে গায়ে দেয়ার জন্য। সবুজ রঙের সুতি চাদর। বিকেল নামলেই সেটা গায়ে চড়ায় সে। শোয়ার সময় খুলে রেখে লেপের নিচে ঢোকে। ঢোকার পর কয়েক মিনিট বাইরের ঠা-াটা গায়ে চেপে বসে থাকে। কিন্তু লেপ ওম ছড়াতে শুরু করলেই সে ঠা-া দৌড়ে পালায়। শুরু হয় আরাম। সত্যি বলতে কি, শীতকালে সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু সকালের নাশতা খাওয়া আছে, পড়াশোনা আছে, স্কুলে যাওয়া আছে। সূর্য ওঠার আগেই মা রোজ ডেকে তোলেন- বিলু ওঠ্, হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বয়- তখন আর না উঠে উপায় কী? তবে বিলু জরুরি ছোট কাজটা সেরেই এসে দাঁড়ায় বাইরের পথের ওপরে। ততক্ষণে সূর্য আলো ছড়িয়ে দেয়। সোনারং আলোয় হেসে ওঠে চারদিক। দূর্বাঘাসের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরের ফোঁটাগুলো সে আলোয় ঝলমল করতে থাকে। কী যে সুন্দর দৃশ্য! তবে বেশিক্ষণ থাকে না সে সৌন্দর্য। খানিকটা সময় পরই সূর্যের আলোয়, পথচলতি মানুষের পায়ে লেগে সে শিশির শুকিয়ে যায়।
রাতে লেপের তলায় অঘোরে ঘুমিয়েছে বিলু। একবারও জাগেনি । ঘুম যখন ভাঙল, হালকা একটা ঘ্রাণ নাকে এলো। ব্যাপারটা বুঝতে তার এক লহমাও দেরি হলো না। কুয়াশা। কেমন যেন সোঁদা সোঁদা ঘ্রাণ। মিষ্টি নয়, তবে খারাপও লাগে না। বাঁশের বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সাথে সাথে চোখ খোলে সে। মাথার কাছে বেড়ার গায়ে হাতে কাটা জানালা। তাতে ছালার ভারি পর্দা ঝোলানো। শীতের সময় রাতে সে পর্দা নামিয়ে দেয়া হয় যাতে ঠা-া বাতাস না লাগে। বিলু হাত বাড়িয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় বাইরে। এক নজর দেখেই লাফিয়ে ওঠে। আরে কী ঘন কুয়াশা। চারদিক সাদা হয়ে গেছে। সে জানে এখন দূরে কিছুই আর দেখা যাবে না। গা থেকে লেপ সরিয়ে রেখে নামে খাট থেকে। আলনা থেকে চাদর টেনে নিয়ে গায়ে জড়ায়। তারপর স্যান্ডেল পায়ে ঘর থেকে নেমে আসে উঠোনে। কুয়াশার দিনে সূর্য দেখা যায় না। তাদের বাড়িতে ঘড়িও নেই। তাই সময় ঠিক কত, বুঝতে পারে না সে। এমন সময় দেখল অন্য ঘর থেকে আব্বা বেরিয়ে এসেছেন। তার সাথে গেনু ভাই। গেনু হচ্ছে বিলুদের চার ভাইয়ের মধ্যে মেজো। দুজন কোথায় যেন যাবে। আব্বা ওকে দেখেই বললেন-
– কী রে! ঘুম থেকে উঠেছিস? যাবি নাকি?
কিছু না জেনেই বিলু বলে-
– যাব।
– তা হলে শিগগির মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। ততক্ষণে আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে নেই।
বোধ হয় দশ মিনিটও হয়নি। রেডি হয়ে যায় বিলু। আব্বাও হাতের কাজ সেরেছেন। তাদের দুজনের কাছে দা আর কুড়াল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে তারা।
এমন কুয়াশা আগে আর কখনো দেখেনি বিলু। পাঁচ-ছয় হাত দূরেও কিছুই দেখা যায় না। পাড়ার চিরচেনা পায়ে চলা পথে এগোয় তারা। শ’খানেক হাত দূরে ছোট দাদার বাড়ির সামনে এসে বিলুর আব্বা ডাক দিলেন-
– মোজাম! মোজাম কই রে?
সাথে সাথে বাড়ির ভেতর থেকে জবাব আসে-
– আসি মিয়াভাই।
মোজাম মোল্লা সম্পর্কে বিলুর চাচা। বিলুর দাদা ছিলেন তাদের মোল্লা বংশের আপন ছয় ভাইয়ের সবার বড়। বাকি পাঁচ ভাই তাকে মিয়াভাই বলে ডাকতেন। বিলুর আব্বা দাদার বড় ছেলে, বংশের আর সব চাচাদের বড়। তাই বয়সে ছোট সব চাচাতো ভাইরা তাকে রেওয়াজ অনুযায়ী মিয়াভাই বলে ডাকেন।
অল্পক্ষণের মধ্যেই হাজির হন মোজাম মোল্লা। তার গায়েও চাদর, হাতে বৈঠা। হাঁটতে শুরু করে দলটা। আরো খানিকটা এগিয়ে আবার একটা বাড়ির সামনে থেমে বিলুর আব্বা ডাক দিলেন-
– মহাই? আয় রে।
– এই যে চাচা, আসতিছি। জবাব আসে সাথে সাথেই।
দেরি না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে মহাই। তার নাম মোহাম্মদ, কিন্তু কিভাবে যেন ছোট হয়ে মহাই হয়ে গেছে। বিলুরা তাকে মহাই ভাই বলে ডাকে। যুবক মহাই তাদের মোল্লা বংশের লোক নয়, তবে নিজেদের লোক। ভালো মানুষ। যারা নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে সারা দিন কারো বাড়িতে কাজ করে সাধারণ ভাবে তাদের দিনমজুর বলা হয়। ওদের এ অঞ্চলে বলে পরেত বা কামলা। দরিদ্র অবস্থা বলে পরেত দেয় মহাই। পাড়ার মানুষের কাজই বেশি করে। তবে পাড়ায় কারো কাজ না থাকলে বাইরে অন্য কারো কাজ করে সে।
পাঁচজনের দলটা উত্তর দিকে একটুখানি হেঁটে গাঙের পাড়ে এসে পৌঁছে। গাঙ মানে পদ্মা নদী। তাদের পাড়ার শেষ মাথায়। সবার সাথে নদীর সম্পর্ক নিবিড়। নানাভাবে নদী জড়িয়ে আছে তীরের সব মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে। এলাকার লোকেরা নদীপাড়কে বলে গাংকুল- মানে গাঙের কূল। বহু দিন থেকেই সবার মধ্যে শব্দটা চালু। একজন হয়তো নদীপাড় থেকে বাড়িতে ফিরেছে। বাড়ির কেউ জিজ্ঞেস করল, কিরে! কনে গিছিলি তুই? সে জবাব দেয়, গাংকুলি গিছলাম।
বর্ষার সময় পদ্মা বিশাল আর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে! তখন কী যে প্রবল তার ¯্রােতের গতি! তবে এখন এ শীতের সময় অবশ্য পদ্মা বেশ শান্ত। আজ কুয়াশায় নদীর গোটা বুক ঢাকা পড়েছে। তার মধ্যেই মোজাম মোল্লা ঘাটে লগি গেড়ে বাঁধা তার নৌকা খুঁজে বের করেন। তাতে উঠে বসে সবাই। আর কোনো নৌকা চোখে পড়ে না। পানিতে হাত দেয় বিলু । বেশ ঠা-া।
নৌকা ছেড়ে দেয়। মোজাম চাচা বৈঠা নিয়ে পিছনের গলুইতে বসেছেন, মহাই ভাই দাঁড়ে। আব্বা বলেন-
– মোজাম, কুয়াশা তো ভীষণ ঘন রে! একেবারে পাড় ঘেঁষে থাক। খবরদার, বার নদীতে যাস না যেন। তাহলে দিক ভুল হয়ে যাবে। ¯্রােতের টানে অন্য দিকে চলে যেতে পারি।
বিলু লক্ষ করে, পাড় ঘেঁষে গেলেও ঘন কুয়াশায় নৌকায় বসে পাড় চোখে পড়ে না। মোজাম চাচা বৈঠা ধরে থাকেন, আর মহাইর দাঁড় টানায় নৌকা এগিয়ে চলে।
আব্বার কথা থেকে বিলু বুঝতে পারে তারা আমবাড়িয়ায় যাচ্ছে। তাদের গ্রাম থেকে মাইল দুয়েক পুব দিকে নদীর পাড়েই আমবাড়িয়া। ঠিক কত সময় কেটেছে বিলু বুঝতে পারে না, তবে ঘণ্টাখানেক হবে বলে অনুমান করল। এর মধ্যে কুয়াশা একটু হালকা হয়ে এসেছে। নদীর পাড় এখন চোখে পড়ছে। এক সময় একটা ঘাটে নৌকা ভিড়ান মোজাম চাচা। মহাই দাঁড় তুলে রেখে লাফ দিয়ে পাড়ে নামে। গেনু ভাই তার দিকে লগি এগিয়ে দেয়। নিজেও নামে। মুহূর্তেই নরম মাটিতে লগি গেড়ে ফেলে মহাই। আব্বার সাথে বিলুও নামে , তারপর মোজাম চাচা।
ঘাট থেকে সিকি মাইল পথ পেরনোর পর একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে তারা। আব্বার ইশারায় ডাক দেয় মহাই-
– আনু ভাই, ও আনু ভাই, বাড়ি আছেন নাকি? ইটু বাইরে আসেন। কেরানি চাচা আয়ছে।
অনেকটা সাথে সাথে বেরিয়ে আসেন আনু, আনু ম-ল। মাঝারি গেরস্থ। বিলু চিনতে পারে তাকে, মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যান, আব্বার সাথে কথা বলেন। ভালো লোক।
বিলুর আব্বাকে দেখে আনু ম-ল বলেন-
কেরানি ভাই আয়ছেন? এই ঘন কুয়োর (কুয়াশা) মদ্যি আসলেন ক্যাম্বা? আসেন, কাচারি ঘরে বসেন।
আব্বা বলেন-
নারে ভাই, বসতে চাচ্ছি না। তুমি একটু দেখিয়ে দাও, বাঁশগুলো কেটে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাই।
আনু ম-ল বাড়ির সাথের বাঁশঝাড়ে নিয়ে গেলেন সবাইকে। পাশাপাশি দু’টি ঝাড় থেকে চারটি বাঁশ দেখিয়ে দিলেন। ততক্ষণে কুয়াশা আরো একটু হালকা হয়ে প্রায় বিশ হাত দূরেও দেখা যাচ্ছে। বিলু দেখল, আনুু ম-ল যে বাঁশগুলো দেখিয়ে দিলেন সেগুলো যাওয়া বাঁশ। এতক্ষণে সে কারণটা বুঝতে পারে। তাদের গ্রামে বা আশেপাশে যাওয়া বাঁশ নেই। কিন্তু ঘর-গেরস্থালির বহু কাজে, বিশেষ করে ঘরের বেড়া দিতে ও মাছ ধরার সরঞ্জাম তৈরি করতে এ বাঁশ ছাড়া চলে না। তাই আব্বা এখান থেকে এ বাঁশ নিতে এসেছেন। কিন্তু এভাবে কুয়াশা পড়বে তা তার জানা ছিল না। যেহেতু আজ বাঁশ নিতে আসার কথা তিনি আনু ম-লকে বলেছিলেন তাই কথা রাখতে এই কুয়াশার মধ্যেই চলে এসেছেন। আর এতটা পথ বাঁশ কাঁধে করে বয়ে নেয়া কষ্টকর বলে নৌকা নিয়ে এসেছেন তিনি।
মোজাম চাচা আর মহাই বাঁশ কাটলেন। বেশি সময় লাগল না। যাওয়া বাঁশ খুব সরল, গিঁট নেই, তাই কঞ্চিও হয় না। পাতার পরিমাণও বেশি নয়। ফলে ঝামেলা কম। বাঁশগুলো নৌকায় আনা হল। তারপর উজান বেয়ে চলা। কুয়াশা ততক্ষণে আরো হালকা হয়ে এসেছে। ডাঙ্গা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। নদীর মধ্যেও বেশ খানিকটা দূরে দৃষ্টি যায়। আপন মনে ভাটিতে মৃদু গতিতে ¯্রােত বয়ে চলেছে। বিলুর মনে হলো, এতক্ষণ কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা নদী ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে।
কুয়াশা যে কী ভালো লাগে বিলুর! কুয়াশার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। কখনো রাত একটু বেশি ঘনালে কুয়াশা নামে। তবে বেশির ভাগ সময় কুয়াশা ঘনায় ভোরেই। কখনো প্রচ- ঘন কুয়াশা হলে দু’তিন হাত দূরেও কিছু চোখে পড়ে না। কাজ করতে তখন সমস্যা হয়। তাই লোকজন খুব একটা বের হয় না ঘর থেকে। দুধের মতো সাদা রঙের কুয়াশার একটা হালকা নিজস্ব গন্ধ আছে। পরিচিত কোনো গন্ধ নয়, অন্য রকম। তাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো সমস্যা হয় না। গন্ধটা ভালোই লাগে তার। কুয়াশা যেদিন ঘন হয় সেদিন শীত কম লাগে। কেন, তা বিলু জানে না। সেদিন ভোরে তার ঘুম ভেঙে গেলে সে উঠে চলে আসে বাইরে। এই যে একটু দূরেই কিছু দেখা যায় না, এটা তার কাছে অবাক করা ব্যাপার মনে হয়। তার মনে হয়, এ রকমটা সারা দিন থাকলে খারাপ হয় না। একদম কাছে না এলে কেউ কাউকে দেখতে পারে না। যেহেতু একটু দূরেই কিছু চোখে দেখা যায় না তাই পথ চলতে গেলে একজনের সাথে আরেক জনের ধাক্কাও লেগে যেতে পারে। স্কুলে যেতে হবে না, সারা দিন বাড়িতে থাকা যাবে। কিন্তু তা কি আর হয়! যতই ঘন হোক না কেন, বেলা আটটা-সাড়ে আটটার পর থেকেই হালকা হতে থাকে কুয়াশার পর্দা। এক সময় যেন কোথায় মিলিয়ে যায় তা। সূর্য আর আড়ালে থাকতে রাজি হয় না, বেরিয়ে এসে আলো ছড়াতে শুরু করে। তখন চারদিক ঝলমল করে ওঠে রোদে। সব পরিষ্কার। কাজকর্ম শুরু হয়ে যায় পুরোদমে। শীতের দিন বলে তো আর কাজ ফেলে রাখা যায় না। চলবে…