নামহীন বালক

বদর উদ্দিন আনসারী

0
12

অফিস শেষে মিয়াবাড়ির গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। গলিটা পার হলেই একটা মসজিদ, তার দু-তিনটা বাড়ি পার হলেই আমার বাসা। সময়টা তখন বেলা তিনটা। গ্রামের বাড়িতে যাবো তাই এক ঘণ্টা আগেই ছুটি নিয়ে চলে এলাম। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। গলি পেরিয়েই মসজিদের সামনে দেখলাম জীর্ণশীর্র্ণ পোশাকে এক ছেলে বসে আছে। ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে ৯-১০ হবে। মুখটা খুব মায়াবী। বাসায় যাবার খুব তাড়া থাকলেও কেন জানি দাঁড়িয়ে গেলাম। ছেলেটা মসজিদের সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে ঢিল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আমি ধীরে ধীরে ওর কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ তাকে দেখছিলাম। হঠাৎ কী মনে করে ওর মাথায় হাত দিলাম। ও চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে একটু সরে বসল। আমি ওর সামনে দুই পায়ে ভর দিয়ে বসলাম। বললাম তোমার নাম কী?
– নাম নাই। আমি একটু হেসে দিলাম
– কী বলো! নাম ছাড়া কোনো মানুষ আছে নাকি?
– হ নাম নাই আমার। কেউ আমারে মনা ডাকে, কেউ আবার হিরু কয়, আবার কেউ জীবনও কয়।
– বাব্বাহ্ তোমার তো দেখি অনেক নাম। আচ্ছা তোমার বাসা কোথায়?
– বাসা নাই।
– এটা আবার কেমন কথা! বাসা না থাকলে থাকো কোথায়?
– আমার পাগলি বুড়ির কাছে।
– তোমার পাগলি বুড়ি কোথায় থাকে?
– ওই পুরান বাজারের পাশের বস্তিতে।
– ওহহ আচ্ছা। তা তুমি এখানে কী করছ?
– বুড়ির জন্যি বসে আছি। বুড়ি আসলি একসাথে যাবানে।
– দুপুরে কি কিছু খেয়েছ? প্রশ্নটা করেই নিজের ক্ষুধার কথা মনে পড়ে গেল।
– না!
– খাবে কখন? এখন তো বিকাল হয়ে যাচ্ছে।
– জানিনে। বুড়ি যহন খাবি তহন খাবানে।
– আচ্ছা তোমার বাবা-মা নেই?
– নাই, মরে গেছে। বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খেলাম। নিজের বাবা-মার কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন হলো বাবা-মার খোঁজ নিই না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ আছি। ছেলেটা ঢিল নিয়ে খেলছে। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ও কত স্বাভাবিক, ওর কিছুই নেই তারপরও কোনো দুঃখ নেই, অভাব নেই। আর আমাদের সবকিছু থাকার পরও শুধু নাই আর নাই। ওর কথা শুনে মনে হলো ওকে সাহায্য করা দরকার। ওকে যদি আমার সাথে রাখি তাহলে ক্ষতি কী। নিজের একটা ছোট ভাই হিসেবে দেখে রাখব। এসব ভাবতে ভাবতে মনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল, নিজের ক্ষুধার কথাও বেমালুম ভুলে গেলাম। আনমনে ভাবছি ওর একটা সুন্দর নাম দেবো। কী নাম দেওয়া যায়? কী নাম…! ওহ পেয়েছি, ওর নাম হবে জামিল। জামিল মানে সুন্দর। ও বড় হয়ে একসময় এদেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলবে।

হঠাৎ ট্রাকের বিকট এক শব্দে বাস্তবে ফিরে এলাম। সামনে ছেলেটাকে দেখতে পেলাম না। চোখ গেল সামনের মোড়ের দিকে। দেখি একটা ট্রাক দ্রুত চলে গেল। রাস্তায় রক্ত বয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠল। এক বয়স্কা মহিলা সম্ভবত ছেলেটার সম্পর্কে বুড়ি আর সেই ছেলে রাস্তায় পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। মাথা দিয়েও রক্ত ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে আসছে। মুহূর্তেই অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বলাবলি করছে, আহ! পাগলি আর মনা ছ্যামরাডা মরে গেল…!
আমার তখনো পা নিশ্চল। বুকে চাপা কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আর সামনের দুনিয়াটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে…।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া