ছোটদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম

মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর

0
596

ছোট্ট বন্ধুরা! কেমন আছ তোমরা? আশাকরি ভালো আছ সবাই। সুস্থতার সাথে সময় পার হচ্ছে তোমাদের। করোনাকালের এই ক্রান্তিকালে সকলের সুস্থতা ও নিরাপদ জীবন কামনা করছি। আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়ায় আবারও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিন সেই ফরিয়াদ তাঁর শাহি দরবারে।
আজকে তোমাদের আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা শোনাবো। তোমরা কাজী নজরুল ইসলামের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? হুম, শুনেছি তো! অনেক শুনেছি। ঝাঁকড়া চুলের কবি তিনি। বাবরি দোলানো দারুণ ছবি তার। ভাসা ভাসা চোখে তার আশার আলো। স্বপ্নীল হাতছানি। আলোর সন্ধানী স্বপ্ন পুরুষ! আমাদের বিদ্রোহী কবি। আমাদের জাতীয় কবি।

আমাদের এই কবি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দ ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত কাজী পরিবারের দুখু মিয়ার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ। মাতা জাহেদা খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের মক্তবেই সম্পন্ন করেন তিনি। পরে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুুলে পড়াশোনা করেন। তারপর ভর্তি হন বর্ধমান জেলার সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে। এই স্কুুলের দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপর আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগ হয়নি কবির।
অনেক দুঃখ কষ্টের জীবন পারি দিয়েছেন তিনি। মক্তবে পড়িয়েছেন। মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে রুটির দোকানেও কাজ করেছেন। প্রয়োজনের তাগিদে লেটো গানের দলে যোগ দেন। এখানে গান গাইতেন। নিজে গান লিখতেন। নিজের লেখা গানে নিজেই সুর করতেন। এখান থেকেই সাহিত্যের আঙিনায় শুরু হয় তার পথচলা। লিখেছেন গান -কবিতা, গল্প, উপন্যাস আর নাটক। ছড়াপাতায় নেচেছেন ছোটদের সাথে। স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখায় তার সরব বিচরণ ছিল। বাংলার সাহিত্য ভান্ডারে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অপরিসীম। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বড়দের কবি ঠিক তেমনি ছোটদেরও প্রিয় কবি। আজকে কবির শিশুতোষ ছড়া থেকে কিছু জানতে চেষ্টা করব।
কবি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। আদর করতেন হৃদয় ভরে। কবি চাইতেন ছোটরা অলস না হোক। তারা হবে কর্মচঞ্চল। শিশুরা যেন ভোরের বিছানায় অলস হয়ে ঘুমিয়ে না থাকে সেজন্য তাদের ডেকেছেন। জাগতে বলেছেন। ছুটতে বলেছেন ফুল পাখিদের সাথে। কবির ভাষায়Ñ
ভোর হলো দোর খোল
খুকুমণি ওঠোরে!
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে
ফুল-খুুকি ছোটরে!
আমরা জানি তরী হাল খুলে পাল তুলে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে। তার যাত্রীদের পৌঁছে দেয় কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। কবি শিশুদের তেমনি নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে চোখ মেলে তাকাতে বলেছেন। নতুন কিছু করার জন্য বন্ধ চোখ খুলতে বলেছেন। এখানেÑ
খুলি হাল তুলি পাল
ঐ তরী চলল,
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুলল।
কবি শিশুদের পাখির সাথে তুলনা করেছেন। পাখির মতো পরিবারের অন্য সবার আগে নিজেদের জাগতে বলেছেন। শিশুদেরকে কুসুমবাগে ডাকতে হবে। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এই দুনিয়াকে কুসুমবাগের বসুন্ধরা বানাতে হবে। এজন্য শিশুদের এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করেছেন কবি। মায়ের বাধা উপেক্ষা করে শিশুরা জেগে উঠবে এটাই কবির আশা। ফুলে ফলে দুনিয়াকে সাজাবে শিশুরাই। কবির কবিতা থেকেই জেনে নিইÑ
আমি হব সকাল বেলার পাখি।
সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
হয়নি সকাল, ঘুমো এখন মা বলবেন রেগে!
বলব আমি, আলসে মেয়ে! ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে না’ক!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।
ঠিক। শিশুরা জাগলেই জেগে উঠবে বসুন্ধরা। আলোকিত হবে দুনিয়া। প্রকৃতিতে জাগবে নতুনত্বের সারা।
কবি ছিলেন চঞ্চল! দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি। নীরব নিথর হয়ে চুপচাপ থাকতে পারতেন না। ভীরুতা আর অলসতাকে একেবারেই পছন্দ করতেন না কবি। তারুণ্যে ভরপুর ছিল তার হৃদয় মঞ্জিল। তাই তিনিও চাইতেন শিশুরা হোক চঞ্চল এবং দুরন্ত। ফুটন্ত গোলাপ। হোক অগ্রগামী বীর সেনানী। কবি শিশুদেরকে তাই সামনে এগুতে বলেছেন। আসুন কবির কবিতা থেকেই জেনে নিইÑ
চল্ চল্ চল্।
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা ধরণী-তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ-দল
চলরে চলরে চল্
চল্ চল্ চল্।
শিশুরা নিরন্তর এগিয়ে চলুক এটাই আমাদের চাওয়া। কোনো প্রতিবন্ধকতা ওদের থামিয়ে দিক সেটা আমাদের চাওয়া নয়।
কবি শিশুদের রাঙা প্রভাত আনতে প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিমিরে ঢাকা দুনিয়ায় আলোর সমাজ গড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। সকল বাধা মাড়িয়ে সামনে চলতে অনুপ্রাণিত করেছেন। ঊষার দুয়ারে আঘাত হেনে আলোর প্রভাত আনতে শিশুদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
কবির ভাষায়Ñ
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।
কবি শিশুদের চার দেয়ালের ঘরে আবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী নন। তিনি চান শিশুরা সারা দুনিয়ায় ঘুরবে। দেশ থেকে দেশান্তরের তেপান্তরে হারিয়ে যাবে। জ্ঞানের আঙিনায় বিশ্ব বিজয়ী বীর হবে তারা। জ্ঞানের সব দুয়ারে ওদের পদচারণা বিকশিত হোক এটাই কবির চাওয়া। তাইতো জগতটাকে নিজের করে সাজাতে বলেছেন শিশুদের। কবির কবিতায় চোখ রাখিÑ
থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে
কেমন করে করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।
ভ্রমণের বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা নিজেও। পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানে ভ্রমণের গুরুত্ব বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। (আল ইমরান-১৩৭)।
কবি গ্রামীণ প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন হৃদয় থেকে। গ্রামের সবুজ বন বনানী, বাড়ির আঙিনার শাকসবজির আকুলতা হৃদয় ভরে অনুভব করেছেন। ছোটদেরকেও কবি সেই অনুভূতির স্বাদ নিতে বলেছেন। ঝিঙেফুল কবিতায় সেই উপমা পরিলক্ষিত হয়। একটু হেঁটে আসি কবিতার পেলব জমিন থেকে। কবির ভাষায়Ñ
ঝিঙেফুল! ঝিঙেফুল!
সবুজপাতার দেশে
ফিরোজিয়া ফিঙে-ফুলÑ
ঝিঙেফুল।
গুল্ম পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল-
ঝিঙে ফুল।
পাতার দেশের পাখি বাঁধা হিয়া বোঁটাতে,
গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে।
পউষের বেলা শেষ
পরি জাফরানি বেশ
মরা মাচানের দেশ
করে তোলে মশগুল-
ঝিঙেফুল।
আমরা ঝিঙেকে একটি সবজি হিসেবেই জানি। যাকে আমরা তরকারি হিসেবে খেয়ে থাকি। ঝিঙে নিয়ে এখানেই খান্ত দিই আমরা। কিন্তু কবি! হ্যাঁ, সবজির স্বাদে নিজেকে বুঁদ করে রাখেননি তিনি। কবি ঝিঙের বাহারি রূপের বর্ণনা দিয়েছেন। ঝিঙেকে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে এনেছেন। এখানেই কবিত্ব! কবির দূরদৃষ্টির আলোকপাত এখানেই!
কবি শিশুদের যাদুকর বলেছেন। তবে এটি ক্ষতিকর দুষ্ট যাদু নয় কিন্তু! যাদুর মতো শিশুরা হয় আকর্ষণীয়! এদের মোহে পরেছিলেন কবি। যেন যাদুর মোহে! ছড়ায় সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। চলো তাহলে একটু দেখে নিই শিশু যাদুকরে কী বলেছেন কবিÑ
পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর
এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর!
কোন্ রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই
রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।
আহা! কবির কী ভাবনা!
কাঠবিড়ালির সাথে কবির খুব মিতালী ছিল। কাঠবিড়ালি খুব পেটুক। তাই কাঠবিড়ালীর সাথে কবির আড়ি খুব। খুকীরাও ছিল কবির আদরের ধন। দেখে আসি খুকী ও কাঠবিড়ালীতে কী বলেছেন কবিÑ
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বিড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাইতে নাকটি বোঁচা!
হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস
একলাই খাও হাপুস হুপুস!
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি’ হবে? বৌদি হবে? হুঁ!
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
আর খেয়ো না পেয়ার তবে,
বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? অ’মা দেখে যাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!
কবির প্রিয় ফল লিচু। বাবুদের পুকুরে কুকুরের সাথে কী ঘটেছিল কবির! শুনতে চাও বুঝি! হুম শোনাব। চল এবার তাহলে লিচুচোরকে দেখে আসিÑ
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াৎ করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।
শিশুদের জন্য এরকম অনেক মজার মজার ছড়া লিখেছেন আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার মতো শিশুতোষ ছড়া খুব কমই লেখা হয়েছে।
বাংলা কাব্যে তিনি আরেকটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। সেটি হল ইসলামী সঙ্গীত বা গজল। কবি ছোটদের জন্য ছড়া-কবিতা, গল্প, নাটক লেখার পাশাপাশি প্রচুর গানও লিখেছেন। তার লেখা গানগুলো আজও সমধিক জনপ্রিয়। তার গানকে নজরুল সঙ্গীত বা নজরুলগীতিও বলা হয়।
মধ্যবয়সে এসে কবি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন। যার কারণে আমৃত্যু তিনি আর সাহিত্যকর্মে ফিরে আসতে পারেননি। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। কবিকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র জগতবাসিকে কাঁদিয়ে কবি ইন্তেকাল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।