গুপ্তধন (পর্ব-১৫)

নাঈম আল ইসলাম মাহিন

0
121

গতসংখ্যার পর

পনেরো

এষাটাকে আটকে রাখা যায়নি চারঘাটে। ভাইয়ের সাথে চলে এসেছে ঢাকায়। এষা আসাতে বাবার উপকার হয়েছে অনেক। রান্নাবান্নার পুরো দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে ও। নতুন ক্লাসে পড়াশোনা শুরু হয়নি ভালো করে। বাবা অফিসে চলে গেলে অফুরন্ত সময় দুজনের হাতে। এষার রান্নার কাজ শেষ হয়ে গেলে প্ল্য­ান করতে বসে দুজন। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ফ্ল্যাটের একজন চলে যাবেন। একটা রুম খালি হবে। বাবারা টু-লেট ঝুলিয়েছিলেন। ইফতু সেটা নামিয়ে রেখেছে। ওই রুমের ভাড়া ইফতু জোগাড় করবে, বলেছে ও বাবাকে। দুটো রুম নিজেদের থাকলে ড্রইং ডাইনিংকে নিজেদের বলে মনে হবে। তখন মনে হবে একটি রুম শুধু ভাড়া দেয়া হয়েছে। ছোটমামী আসবেন সামনের মাসের শুরুতে। একটা রুম এক্সট্রা থাকতেই হয়। যখন তখন যেকোনো কাজে দরকার হয়ে পড়ে।

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে জীবনটাকে স্বপ্নময় মনে হয় এষার কাছে। সব শখ পূরণ হবার, সব কিছু হাতের নাগালে পাবার সুখে সোনালি সোনালি লাগে দিনগুলো। এ কি তবে অর্থের সুখ? যেকোনো সমস্যায় পড়লে কিংবা যেকোনো কঠিন বাস্তবতাকে ‘জলবৎ তরলং’ করে দেবার সাহসে? নাকি কেবল পর্যাপ্ত অর্থ আছে, কোনো সমস্যা নেই বাক্যটার কারণে? জবাব পায়না এশা। ওর ক্লাসের অনেক মেয়েকে দেখেছে ও। গাড়িতে করে স্কুলে আসে, নিত্য-নতুন জামা কাপড় পরে, আর দেশ-বিদেশে ঘোরার গল্প শোনায় প্রায়ই। কিন্তু ওদেরকেও তো দেখেছে, পরিবারে অশান্তি, বাবা-মার মধ্যে বিচ্ছেদ কিংবা অকারণে ‘ভালো না লাগা’ রোগে আক্রান্ত এক একজন। আজকাল বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে এশার। বাবার মতন। বাবা এখনো অফিস করছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবাকে বলে ফেলি, কোনো দরকার নেই বাবা তোমার এত কষ্ট করে অফিস করার। সারা জীবন বসে বসে খাবার মতো যথেষ্ট অর্থ মজুদ আছে। আমাদের ভাইয়া বাবার জন্য লোকেশন খুঁজছে। একটা বড়সড় শো-রুম করা হবে। বই-ই হবে প্রধান আইটেম। তবে আরো নানান পণ্য থাকবে সে দোকানে। হিসাব নিকাশ হবে সব কম্পিউটারাইজড। প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিনসহ আধুনিক সব উপকরণ দিয়ে সাজানো হবে শো-রুমটি। বাবাকে কিছুই জানানো হবে না। পুরোপুরি রেডি হয়ে গেলে উদ্বোধনের দিন সারপ্রাইজ দেয়া হবে তাকে।
ভালো দেখে দুটো সাইকেল কেনা দরকার। ভাইয়া বলেছে এখন কিনলে লোকজনের চোখে লাগবে। ক’দিন পর বাসা বদল করে অন্য এলাকায় চলে গেলে জীবনযাপনের ধরনও বদলে ফেলা যাবে। খুব বেশি বদলাতে ইচ্ছা করে না জীবনের ধরন এষার। এমন মধ্যবিত্ত সুখগুলো যদি হারিয়ে যায় তখন।
বিকেলের আগেই ছুটি হয়ে গেল ইফতুর স্কুল। বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেড়ে এষাকে নিয়ে বের হলো ও। দিলরুবা আর ওর মার জন্য কিছু ফলমূল, খাবার-দাবার কিনে পীরেরবাগ চলে এলো। বাসায় ঢুকতে এষারও কেমন গা ঘিন ঘিন করছিল কিন্তু ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গিয়েছিল ও। দিলরুবা আর এষা দুজনেই গল্প শুনেছে দুজনের কিন্তু দেখা হয়নি কখনো। আজ পরস্পরকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল ওরা। দিলরুবার প্রশংসা করার সুযোগই পাচ্ছে না এষা। সারাক্ষণই এষা আপ্পি, তোমার নাকটা এত সুন্দর কেন? এষা আপ্পি, কি তুমি নাকি স্কেটিং করতে পারো? জুডো কারাতে করে তুমি কি ছেলেদেরও হারাতে পারো? এসব প্রশ্ন। আজ আন্টিকে কিছুই করতে দিল না ইফতু। স্যাঁতস্যাঁতে স্বপ্নহীন জীবন থেকে ওদেরকে কিছু সময়ের জন্য বের করে নিয়ে এলো। চারজন মিলে চলে এলো অভিজাত একটি রেস্টুরেন্টে। নানান খাবার দাবার, হালকা লাইটিং আর মিষ্টি মিউজিকের ফাঁকে গল্প করতে করতে অসম্ভব সুন্দর কতগুলো মুহূর্ত পার হলো। বের হয়ে ওরা আইসক্রিম খেলো। তারপর ঢুকলো শপিংমলে। অত্যন্ত বিনয়ী লাজুক আর কোন কিছু কিনতে না চাওয়া দিলরুবার জন্য অনেক কিছু কিনলো দুই ভাইবোন। বেশ কয়েকটি জামা, স্যান্ডেল এবং কিছু প্রসাধনী। ওর মার জন্যও কেনা হলো অনেক কিছু। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বারবার বলছিলেন, এতগুলো টাকা কেন খরচ করছো বাবা? নিরাশার কালো মেঘে ঢেঁকে থাকা জীবনের ফাঁকে, এইরকম এক ফালি জোছনাা নিয়ে আসার জন্য ইফতুর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল ওরা বারবার।
একটা স্মার্ট ফোন কিনেছে ইফতু। খুব প্রয়োজনে, ভীষণ দরকারেই কিনেছে। মানুষের সামনে সহজে বের করে না। এষাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে ছোট মামীকে ফোন দিল ও। আরো দুটো কয়েন নিলাম করার কথা বলল।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় এলেন ছোটমামী। মামাও এসেছিলেন সাথে তবে জমিজমা সংক্রান্ত জরুরী কাজ থাকায় পরদিন ভোরেই রাজশাহী ফিরে গেলেন। মামীকে দেখে একটু অবাকই হয়েছে ইফতু। এ কয়দিন রাজশাহীতে নানা ভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে তার। জিন্সের প্যান্টের সাথে ঢিলেঢালা শার্ট আর মাথায় স্কার্ফ পড়া শুরু করেছেন তিনি। ধর্ম তো আগেই বদল করেছিলেন, এখন সে ধর্ম পরিপালনে নিষ্ঠাবান হচ্ছেন মামী।
মামা চলে যাবার পর দিনই মামী জানালেন তার বাবা আসছেন। সন্ধ্যার দিকে বাচ্চা দুটো এষার কাছে রেখে ইফতুকে নিয়ে বের হলেন তিনি।
বাইরে থেকে বহুবার হোটেল শেরাটনের চেহারা দেখলেও এই প্রথম ভেতরে ঢুকলো ইফতু। ঝকঝকে-তকতকে, সাজানো-গোছানো। দেশের মধ্যেই যেন একটুকরো বিদেশ। বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিজনেস মিটিং করার জন্য এখানে আসেন। রাতে থাকতেও পারেন প্রয়োজনে, তবে সেটা খুব এক্সপেনসিভ।
সুইমিংপুলের পাশে একটা টেবিল পেতে পঞ্চাশোর্ধ একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তার সামনে একটি মাত্র চেয়ার। তার মানে একজন মাত্র মানুষই তার কাছে কাক্সিক্ষত। তিনি ছোটমামী। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর বাবা মেয়ের মিলন বাঙালীদের মতো অতটা ভেজা ভেজা হলো না। ছোটমামীর বাবা বরং অবাক হয়ে মামীর ড্রেসকোড খেয়াল করছিলেন।
– তুমি মুসলমান হয়েছ?
– সে তো অনেক আগেই বাবা, তবে প্রেমে পড়ে নয়। ইতিহাস পড়ে। পৃথিবীর মধ্যে মুসলমানরাই একমাত্র জাতি, যারা বিজয়ী হওয়ার পরও পরাজিতদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। ছোটমামীর বাবা আরেকটি চেয়ার নিয়ে ইফতুকে বসতে বললেন। বার্গার আর কফি খেতে খেতে নতুন অকশনের বিষয়ে আলোচনা করলেন বাবা মেয়ে।
– বুঝলে জেসিকা!
– ফাতিমা। ছোটোমামী শুধরে দিলেন।
– তোমার মা খুব অসুস্থ, একবার বেইজিংয়ে আসো। আর নাতি দুটোকে নিয়ে আসলে না কেন সঙ্গে?
– পরেরবার আনবো। আপনি হঠাৎ এলেন যে?
– না! মানে ভাবলাম ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করলে যে খরচ হয় তার থেকে অনেক কম খরচে আমি বাংলাদেশে এসে হাতে হাতে নিয়ে যেতে পারি কয়েনগুলো। বাবার হাতে আরো দুটো গোল্ড কয়েন দিলেন মামী। বাবা চেক লিখে দিলেন। ওরা বের হয়ে এলো হোটেল থেকে।
চলবে…