রেলেরগাড়ি রাজারবাড়ি
শতবর্ষী এক রাজার বাসার সামনে সার বাঁধা বাস, স্বচ্ছ দেয়ালের বাস স্টেশন। সেখানে willkommen পথের বিবর্তনে হয়ে গেল welkom, eingang হলো invoeren, ausgang বুঝলাম uitgang লেখা দেখে, পোস্টার সাঁটা সিনেমার বিজ্ঞাপনে লেখা bioscoop শব্দটা মনে ধরল। এই প্রাচীন রাজবাড়িই নাকি ওলন্দাজদের সেন্ট্রাল স্টেশন। এর ভেতরেই অত্যাধুনিক ট্রেনগুলো সব তীব্রগতি নিয়ে ছুটে আসে, বিশ্রাম নেয়, আবার ছোটে।
সেন্ট্রাল স্টেশন নামক রাজপ্রাসাদের ভেতর ঢুকে পড়লাম। এত বিশ্বজনীন রাজপ্রাসাদ আগে দেখিনি। দুনিয়ার সব দেশের প্রতিনিধি যেন হেঁটে যাচ্ছে। আশপাশ থেকে ব্রিটিশ/আমেরিকান এক্সেন্ট যেমন ভেসে আসছে, কিছু ওলা! কমো এস্ত্যাস শুনলাম। শুনলাম দাস্তার মাথায় দেয়া একজন শিখ পাজির চিন্তিত গলায় ‘মুবাইল ত্যায় মিসকালান মারডা’ ধরনের অমিয় কিছু বাণী। আর আমরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা নিজ ভাষায় বগরবগর করতে করতে স্টেশনের অন্যপ্রান্তে যাচ্ছি। শুনেছি আমস্টারডামের বিখ্যাত নৌবন্দরটি ট্রেন স্টেশনের পেছনের দিকে আছে। গন্তব্য সেদিকে।
পায়ের পাতায় ফোস্কা
হারবারের আশেপাশে ভিড়তে পারিনি তার আগেই পায়ের পাতায় ফোস্কা। বড় লেখকদের পায়ের তলায় শর্ষে থাকে, কারো থাকে খড়ম। আমি পাঠক আমার ভাগে বরাদ্দ শুধুই ফোস্কা। নতুন কেনা ব্যালেরিনা জুতোদের বিশ্বাস করে ভুল করেছি। বাড়তি স্যান্ডেল জোড়াও রেখে এলাম শেষ মুহূর্তে, ওজন সঙ্কট। নতুন কেনার প্রস্তাব পেয়ে বাতাসে দিলাম উড়িয়ে। একেকটি নতুন জুতো, একেকটি বিশ্রী ফোস্কা। আর কেনাকাটায় আমার আলসেমি লাগে। খালি পায়ে কতক্ষণ হাঁটলে ঠিক হয়ে যাবে। এই বেলা ঠান্ডাও জোরালো লাগছে না। শুরু হলো আমার থেকে থেকে মুক্ত পদব্রজে হীরক রাজার দেশে অভিযান।
আমস্টারডাম শহরে চক্কর দেবে সিটি সার্কেল ট্যুর বাস। টিকেট কেটে সোজা ছাদবিহীন দোতালায় দৌড়। সকালের দিকে আকাশে রোদ থাকলেও এখন তুলিতে আঁকা কাজল মেঘ। বৃষ্টিহীন বাতাসে উড়ছি যেন। হারবারকে ঘিরে থাকা উৎফুল্ল গাংচিলের অনুভূতি কেমন বুঝি আমি। ওরা আমার মতন ভাবে।
হারবারের গল্প; গল্প থেকে আরও গল্প
নৌবন্দর ঘেঁষে যাচ্ছিল আমাদের বাস। পানির ওপর ভেসে আছে অতীত এবং বর্তমান দুটোই। ইয়োরোপের সবচেয়ে বড় এনার্জি পোর্ট ক্লাস্টার হচ্ছে আমস্টারডাম-রটারডাম-এন্টওয়ার্প। নেদারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের এই সমন্বিত নৌপথটি তেল এবং রাসায়নিক শক্তি পরিবহনের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। ছোট বড় নৌযান চলছে কখনো যাত্রী নিয়ে, কখনো বড় বড় কনটেইনার নিয়ে। আবার থেমে আছে কোথাও। হারবারের বর্তমান মুগ্ধ হবার মতো।
থেমে থাকার বেশকিছু আবার অতীতের স্মৃতিচারণের জন্য রেখে দেয়া। সেই স্মৃতি সাহসিকতার নিদর্শন হলেও শোষণের অমোচনীয় চিহ্ন অনুভব করা যাবে। প্রাচীন মডেলের পাটাতন-মাস্তুলগুলোতে যত্নের ছাপ স্পষ্ট।
ওলন্দাজ নাবিকেরা তাদের স্বর্ণসময়ে সাগরের আনাচে কানাচে জাহাজে চড়ে দাপিয়ে বেড়াতো। ইউরোপের উপক‚লবর্তী বাণিজ্যের মূল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছিল। পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়েছিল তাদের উপনিবেশ। নিজেদের এই শ্রীবৃদ্ধির অন্তরালে আছে সুবিশাল অন্ধকার অধ্যায়। নির্মম দাসবাণিজ্য, বোম্বেটেগিরি এবং চোরাচালানীর আশ্রয় নিয়ে তারা উন্মত্তের মতো নিজেদের সমৃদ্ধ করে যাচ্ছিল। ট্রান্স আটলান্টিক উগ্রদাস বাণিজ্যে ওলন্দাজরা পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ এবং স্প্যানিশ সহচরদের পাশাপাশি নিজেদের নৌবন্দর-জাহাজ, সময়-শ্রম-শক্তি বিনিয়োগ করে মূলত মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে জোর করে ধরে আনা দেড় কোটিরও বেশি মানুষগুলোকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করেছিল। বাধ্য করেছিল তাদের মরে গিয়ে মুক্তি পেতে।
আমেরিকার কাছে এরা ট্রায়াঙ্গুলার ভয়্যাজ পদ্ধতিতে মানুষ বিক্রি করত। প্রথমে ডাচরা আমস্টারডাম বন্দর থেকে আফ্রিকান গোল্ড কোস্টে যেত। জাহাজ বোঝাই আফ্রিকান কালো মানুষগুলোকে মালামালের মতো ঠেসে ঢোকাতো। ওখানেই সহ্য করতে না পেরে বিশ ভাগ মানুষ মরে যেত। পথিমধ্যে সাগরডুবিতে শত শত অসহায় মানুষের মৃত্যু এবং শুধুমাত্র লাইফ বোটে করে কেবিন ক্রুদের পগারপাড় হবার মত সুনিশ্চিত ঘটনাও ঘটতো।
এরপর তাদের একটা অংশকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এনে বিক্রি করে দেয়া হতো। শক্তিশালী-দুর্বল, নারী-পুরুষ-শিশু বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলে নির্ধারিত হতো জীবনের মূল্য। এরপর আজীবনের জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অশেষ দুর্ভোগের জীবন বয়ে বেড়াতো ভাগ্যহত মানুষের দল। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, সুরিনাম এবং আরও কিছু অঞ্চলে ছিল ওলন্দাজ উপনিবেশ। ক্রীতদাসদের বাকি অংশকে তারা চরম শ্রমনির্ভর কৃষিকাজে নিয়োগ করত। আখ, কফি, কোকোর পাশাপাশি নীলচাষেও বাধ্য ছিল তারা।
জুলুম অব্যাহত রেখে এই মেয়াদে বুদ্ধিমান ডাচরা খালি জাহাজ ভরতি করে চিনি, স্বর্ণ বা তামাক নিয়ে আবার বন্দরে ফিরে গিয়ে তাদের ত্রিকোণ সমুদ্র যাত্রা আপাতত শেষ করত।
ওলন্দাজ উপনিবেশের চরম অপশাসনের চিহ্ন লেগে আছে সুরিনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী নেদারল্যান্ডের এক চিনি ইন্ডাস্ট্রিই দাঁড়িয়ে ছিল দেশগুলোর মানুষের কাঁধের ওপর দিয়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল ওলন্দাজ কলোনি। বাংলা শোষণ করেও তাই ওলন্দাজরা নিজেদের ভাঁড়ার ভরতে পেরেছিল।
১৮৫০ সালে এসে দাসপ্রথা বিলুপ্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলেও পুরোপুরি বিলোপ হতে আরও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ডাচ ন্যাশনাল মনুমেন্ট অব দ্য হিস্ট্রি অব স্লেভারি ২০০২ সালে ডাচ রাজপরিবারের দাপ্তরিক ক্ষমা বা কোনো বার্তা ছাড়াই জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়।
ডাচদের আরেকটু দুর্নাম গাইতেই হচ্ছে। বসনিয়ার স্রেব্রেনিতসায় প্রায় আট হাজার মানুষকে মুসলিম পরিচয়ের কারণে পরিকল্পিতভাবে নির্বিচারে হত্যা করেছিল সার্ব বাহিনী। বাড়তি হিসেবে জ্বালানো- পোড়ানো, ধর্ষণ, নির্যাতন তো ছিলই। সে সময় স্রেব্রেনিতসায় ডাচরা ছিল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীবাহিনী। কিন্তু তারা সার্বিয়ানদের আটকায়নি।
ভূত জাহাজ আর নেমো জাহাজ
সপ্তদশ শতাব্দীতে একবার ডাচদের বা ওলন্দাজদের এক অদ্ভুতুড়ে জাহাজ পৃথিবীর কোথাও নোঙ্গর করেনি, আবার ফিরেও আসেনি। কিন্তু উনবিংশ এবং বিংশ শতকের অনেক নাবিক ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’কে সমুদ্রে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে বলে দাবি করে। আমিও কিন্তু এই জাহাজের সমুদ্রে রহস্যজনক আলো ফেলা দেখেছিলাম স্কুবি ডু আর শ্যাগিদের সাথে। দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান যদি এই অবেলায় নিজ জন্মভূমিতে এসে একটু দেখা দেয় সেই আশায় ঐ দূরে খুঁজে দেখছিলাম।
সায়েন্স মিউজিয়াম অব নেমোর বিল্ডিংটা দেখে একটু জোরেই বলা লাগলো, ‘এটা কী!’
রেগুলার কোনো বাড়ির বা মিউজিয়ামের ডিজাইন না। দূর থেকে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল অত্যাধুনিক কোনো জাহাজের সবুজাভ পাটাতন পানিতে অর্ধ ডুবন্ত অবস্থায় আছে। সাদা রঙের সাঁকোটা পার হয়ে বুঝি জাহাজের ডেকে ওঠা লাগে। পরে অডিও গাইড বলল, এটা ইতালিয়ান স্থপতি রেনযো পিয়ানোর নির্মাণশৈলীতে বানানো। পানির ওপর বাইশ মিটার উঁচু এই স্থাপনাটির নিচে আবার একটা টানেলও আছে। ভেতরে কচিকাঁচাদের উপযোগী করে সায়েন্স- টেকনোলোজির অপূর্ব সব প্রদর্শনী। কখনো হাতে কলমে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে, কখনো পর্দায়। মহাবিশ্বের টুকিটাকি, রসায়ন বা গণিতের চমৎকার সব কৌশল এখানে পাওয়া যাবে।
রিদমিক প্যাডেল, গ্রাখটেন
পানির থেকে চোখ সরিয়ে একটু সড়কের দিকে নজর দেয়া দরকার। চোখ দুটোকে টেনে অন্যপাশে নিতে হলো। তবে বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেলো না, চোখ হাজারে বিজারে সাইকেল দেখে নিজেই ভিরমি খেয়ে আটকে গেল। রাস্তার ওপর সাইকেল বিপ্লব যেন। বিভিন্ন বয়সী কত মানুষ সাইকেল চালিয়ে পথের বাঁকগুলোতে মিশে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে! এই হারিয়ে যাওয়া দুই চাকার হালকা তালে খুব ছন্দোবদ্ধ লাগছিল। তারা খুব নির্বিকারভাবে অফিসের ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ ইত্যাদি জিনিসপত্র সাথে নিয়ে দুলকি চালে প্যাডেল মারছিল। এই দক্ষতার কারণে চালানো বেশ রিদমিক লেগেছে।
আবার ঝাঁক বেঁধে সাইকেল স্ট্যান্ডে বা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইকেল। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে এই দেশে মানুষের চাইতে সাইকেলের সংখ্যা বেশি। আশেপাশের কড়া ট্রাফিক আইন কানুনের দেশগুলোর মতো এদেশকে লাগেনি। বরং মনে হয়েছে নিয়মগুলো ট্রাফিক লাইটগুলোর মতোই একবার জ্বলছে একবার নিভছে। মানুষের ইচ্ছে হলে মেনে নিচ্ছে, ইচ্ছে না হলে নিজের ধ্যান ধারণা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন পথে চলবে, কোন কথা বলবে।
ঝট করে আবার পানিতেই চোখ পড়ল। আমস্টারডামকে কী নাম দেয়া উচিত? দ্য সিটি অব হারবার, নাকি সাইকেলের শহর, না খালবিলের শহর? গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকটা অবস্থাসম্পন্ন বাসাবাড়ির সামনে নিজস্ব পুকুর/ ঘাটলার মতো এদের আছে খাল। বন্যার প্রকোপ ঠেকাতে আমস্টেল নদীতে বাঁধ দিয়ে স্থানীয় জনগণ আমস্টারডাম শহর বানিয়ে ফেলেছিল। আর আমস্টেল নদীর শাখা প্রশাখা থেকে অসংখ্য খালের শুুরু। খালগুলোর ওপর হাজারের বেশি ছোট ছোট সেতু থাকায় মনে হয় আমরা সমন্বিত দ্বীপের শহরে এসেছি। এখানে ওরা খালকে বলে গ্রাখট। গ্রাখটেন হচ্ছে গ্রাখট এর বহুবচন।
জাদুঘর, হতাশা এবং শিথানের বালিশ
অডিও গাইড ডামস্কয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। এই নগর কেন্দ্রে পাওয়া যাবে ডাচ রাজার রাজপ্রাসাদ। রাজ প্রাসাদের সামনেই খোলা চত্বরে কোথাও হারমোনিকার সুর, বেহালাবাদকের উপার্জনের থলে, চেয়ার পেতে অবকাশ যাপন আর কতরকমের বিকিকিনি! সেন্ট্রাল স্টেশনে যেমন দেখেছি, এখানেও তাই। বিভিন্ন জাতীয়তার সম্মেলনকেন্দ্র যেন। প্রায় ১৭৭ দেশের মানুষের বাস এই বহুজাতিক শহরটিতে।
ডামস্কয়ারকে কেন্দ্রে রেখে পুরো শহরে রয়েছে পুরনো আমলের উইন্ডমিল, চিজ মার্কেট সহ অন্যান্য মার্কেট, সেই সাথে মিউজিয়াম আর মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ভেতর ফান গখ বা ভ্যান গগ, রেমব্রান্ট বুঝতে চাইলে ভ্যান গগ মিউজিয়াম এবং রাইখস মিউজিয়ামে যাওয়া প্রয়োজন। রেমব্রান্টের নৈশ প্রহরী বা দ্য নাইট ওয়াচ হলো মোনালিসার মতো জনপ্রিয়। আবার শুধু ভ্যানগগের শিল্পকর্ম দেখতেই আমস্টারডামে অসংখ্য পর্যটক আসে। জীবদ্দশায় ভ্যানগগের মাত্র একটা শিল্পকর্ম বিক্রি হয়েছিল। হতাশা আর অর্থকষ্ট মিলে বিষিয়ে তুলেছিল জীবন। সে জন্য সাতত্রিশে এসে তার আত্মহননের পরাজিত সিদ্ধান্ত। মৃত্যুর পর তার সৃষ্টি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে আজ অবধি। মানুষের পরাজয়ের অনুভূতি বড় তীব্র।
নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ল। একবার বিমূর্ত চিত্রকলার প্রতি মহাঝোঁক তৈরি হলো। ঈদী, টিফিনের পয়সা জমিয়ে নানা কিসিমের রঙ কিনলাম। বড় আর্টপেপারে মগজের অস্থিরতা ফুটিয়ে তোলার নিবিষ্টতায় বেনানাস পায়জামাসের এপিসোডও মিস করেছি! মমিসিং অঞ্চলের এক ভদ্রমহিলা কাজ করতেন আমাদের বাসায়। পাশের ফ্ল্যাটের বান্ধবী বুয়াকে ‘মায়া মায়া গো’ করতে করতে বড় আফসোস করছিলেন। এই বাসার বড় আফা এহাবেহা বাতর (আঁকাবাঁকা ক্ষেতের আইল), হাগ (শাক)- কাউয়ার ঠ্যাংগ আর কী সব উমাইল্লা জিনিস আঁকে সারাদিন। এরচেয়ে আম কাডল আঁকলেও তো ভালো ছিল। কায়ালাইতে পারতাম । এই মন্তব্য শুনে জায়গায় হুতিয়ে পড়তে ইচ্ছে করেছিল। আমি অল্প প্রতিভার শখের শিল্পী। আমার হতাশার দৌড় হিতানে বালিশ পেতে ঘুমানো পর্যন্ত। বড় প্রতিভারা একটু এদিক সেদিক হলেই দেখি নিজেকে মাইরালবাম কুইটটালবাম এগুলি করতে চায়। উস্তাদি করে নেয়া যে কোনো সিদ্ধান্তই গুরুতর ভুল।
তবে আমি এক মহা উস্তাদের সর্বনাশা সিদ্ধান্তের ভুক্তভোগী কোটি মানুষের একজনকে খুঁজছিলাম এই শহরে। মাদাম ত্যুসো, হিস্ট্রি মিউজিয়াম, স্টেডলিক মিউজিয়াম, রিজস্কিমিউজিয়াম, পানির ওপর দাঁড়ানো মেরিটাইম মিউজিয়াম ইত্যাদির ভিড়ে খুঁজেছিলাম আমি আনা ফ্রাঙ্ককে।
প্রজাপতি, হীরক রাজার দেশ
‘দ্য ডায়রি অফ আ ইয়ং গার্ল’ এর আনা ফ্রাঙ্ক। আমস্টারডামের প্রিন্সেনগ্রাখট সংলগ্ন বাসাটিতে দুই বছরের বেশি সময় ধরে অন্তরীণ থাকা সেমিটিক মেয়েটি তাদের পতঙ্গের মতো বেঁচে থাকা দিনগুলোর দিনলিপি লিখেছিল এখানে। জার্মানির ভাইমার আমলে ফ্রাঙ্কফুট আম মাইনে আনা ফ্রাঙ্কের জন্ম ও কিছুকাল বেড়ে ওঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর তীব্র ইহুদিবিদ্বেষের কারণে ফ্রাঙ্ক পরিবার জার্মান নাগরিকত্ব হারায়। এর আগেই অবশ্য তারা আমস্টারডামে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪০ সালে আমস্টারডাম জার্মানির দখলে চলে গেলে কিশোরী আনা এবং তার পরিবার এই বাড়িটিতে ভীষণভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কালো কাপড়ের পর্দায় জানালাগুলো ঢেকে দেয়া থাকতো সন্ত্রস্ত মানুষগুলোর অস্তিত্ব লুকাতে। চিলেকোঠার একটা ঘর থেকে কেবল বিশাল আকাশের ছোট্ট একটা অংশ সবটুকু আনন্দ হয়ে ধরা দিত আনার চোখে। লিখেছিল আনা তাদের এই দুর্বিষহ জীবনের অনেকটাই। পালিয়ে বাঁচার বেদনাবিদ্ধ অনুভূতি।
তারা ধরা পড়ে যায়। বার্গেন-বেলজান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আনা ফ্রাঙ্ক ও তার বোন মার্গো ফ্রাঙ্ক মারা যায়। যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কিছুদিন আগে একটু একটু করে উড়তে শেখা প্রজাপতিটির খোলা আকাশের আনন্দের গল্প আর লেখা হলো না।
পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য বাবা অটো ফ্রাঙ্ক পরবর্তীতে আনার ডায়রির খোঁজ পান। যুদ্ধবন্দি মানুষের বিষন্ন পৃথিবীর খোঁজ জানান স্বয়ং পৃথিবীকেই। ওলন্দাজ ভাষায় লেখা এই ডায়রিটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ির দেয়ালগুলো ছুঁয়ে দেখা কিংবা চিলেকোঠার জানালা দিয়ে আকাশ দেখা হয়নি আমার। বাসট্যুর কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা রাখেনি। বরং রেখেছে ডায়মন্ড মিউজিয়ামের হীরা কাটাকাটি দেখার ব্যবস্থা।
একটু বিরক্তি নিয়েই নামলাম। পাদুকাবিহীন পা নিয়ে হাঁটবো দেখে এমনিতেই বলছিলাম হীরক রাজার দেশ। এখন দেখি রূপক অর্থ মাঝেমধ্যে ব্যাপক অর্থ বহন করে।
আমস্টারডামকে একসময় বিশাল হীরা বাণিজ্যের কারণে হীরার শহরও বলা হতো। এই জাদুঘরে দেখানো হবে কীভাবে ধাতু ঘষে ঘষে হীরা বানানো হয়। সেক্টরে সেক্টরে ভাগ করা বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম যন্ত্রপাতি দিয়ে গবেষকেরা এবং কারিগরেরা হীরা নিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিল। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া কোনো যন্ত্র তেমন পরিচিত লাগলো না। চোখের সামনে দেখিয়ে দিলো কেমন করে হীরা বানাতে হয়। ভবিষ্যতে কোনোদিন যদি হীরার কারিগর হতে হয় এই আশঙ্কায় মন দিয়েই কাটাকাটি ছানাছানি দেখলাম। কারণ কোনোখানে ছাই দেখিলে উড়াইয়া দেখিবার উপদেশ দিয়েছিলেন কবি। কবিরা চিন্তা ভাবনা ছাড়া কথা কম বলে।
তারপর হীরার তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রের প্রদর্শনী ছিল। গলার হার, মাথার মুকুট, আঙটি, ঘড়ির মিলন মেলা। দেখলাম মানুষের মাথার একটা খুলি বানিয়ে রেখেছে হীরা দিয়ে। গর্জিয়াস কঙ্কালের পাটিতে আবার দাঁতও বাঁধিয়ে দিয়েছে। বোদ্ধাগণ নিশ্চয়ই এইসমস্ত অলঙ্কার, দাঁতাল খুলির কদর করবেন। আমি বোদ্ধা নই। দেখলাম অনেকেই যাইবার কালে কেনাকাটা করছে।
আনা ফ্রাঙ্কের বাসার বদলে সময় বাঁচিয়ে এখানে আনলে এই সুবিধাটুকু পাওয়ার অধিকার কর্তৃপক্ষের থাকতেই পারে। আমার মন আনা ফ্রাঙ্কের চিলেকোঠায় পড়ে থাকলেই বা কি আসে যায়!
জুতা কতক্ষণ হাতে নিয়ে, কতক্ষণ পায়ে দিয়ে আমস্টারডামের হীরা ঝিলমিল জাদুঘর পর্ব শেষ করলাম।
বাঁধের শহরে বসতি, প্রার্থনা
আমস্টারডামের বেশ অনেক বাসার ছাদগুলো, স্পেসিফিকলি পুরনো বাসার ছাদ ইউরোপের গতানুগতিক ছাদের মতো না। একটু তিনকোণা কিন্তু কোণের প্রান্তবিন্দু আবার অর্ধবৃত্তাকার। এগুলোকে বলা হয় ত্রিকোণ গেবল বা চুড়ো। আমস্টারডামেই শুধু এমন চুড়াওয়ালা বাসা দেখলাম। বাড়িগুলো হোমোজেনাস আর দুই দালানের মাঝখানে কোনো তফাৎ নেই।
একে তো বাঁধের শহর, স্বাভাবিকভাবেই অতি ওজনদার বাড়ির ভার বইতে পারার কথা না। তাই এক পর্যায়ে কাঠের বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বড় বড় দুটো অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় নগরী। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল কাঠের বাড়িগুলোকে একের পর যথার্থ জ্বালানি হিসেবে নাগালের ভেতর পেয়ে গিয়ে।
এবার বাড়িগুলোর প্রস্থ, সেই সঙ্গে মূল ফটকের বহির্ভাগের ওপর শুল্ক বসানো হলো। এখন এই শুল্ক এড়াতে এমন সংকীর্ণ সংকীর্ণ বাড়ি বানানোর চল শুরু হলো। বাড়িই যখন সংকীর্ণ, তখন এর ভেতর প্রশস্ত সিঁড়ি কেমন করে পাওয়া যাবে?
সিঁড়িগুলোও সরল নিয়মে তাই জবরজং ঘিঞ্জি, ও দিয়ে ওজনদার মালসামান ওপরতলায় ওঠানো সম্ভব না।
বাসাগুলো কেমন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে এমন মনে হলো। পরে এই নিবন্ধ সেই নিবন্ধ পড়ে জানতে পারলাম ছাদের গেবলের সাথে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ক্যান্টিলেভারড বা দেয়াল থেকে সম্প্রসারিত বীম দেয়া আছে আর আছে এক ধরনের আংটা। এদের সাহায্যে মালামাল পরিবহন করা হয়। আর জিনিসপত্র আংটা দিয়ে ওঠানোর সময় দেয়ালের গায়ে যাতে ধাক্কা না লাগে সে জন্য একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বাড়ি বানানো হয়েছে।
এইসমস্ত পুরনো বাড়ির ভেতর আবার কিছু ক্যাথলিক চার্চ আছে। স্প্যানিশ ক্যাথলিক রাজার সাথে কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধজয়ের পর নেদারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সব গির্জা প্রোটেস্ট্যান্ট উপাসনালয়ে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে বসতবাড়ির গোপন কোনো কক্ষেই ক্যাথলিকদের লুকিয়ে ধর্ম পালন করতে হতো।
এখন আর আগের সেই দ্ব›দ্ব নেই কিন্তু এখনও ওভাবেই চুপিসারে যেন অনেক ক্যাথলিক প্রার্থনায় মগ্ন হতে পছন্দ করে।
স্পেন ও পর্তুগাল থেকে প্রচুর পরিমাণে সেফার্ডিক ইহুদি এখানে এসে অভিবাসন গড়ে তুলেছিল। অসংখ্য খ্রিষ্টীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু সিনাগগও আছে নগরীতে। ইহুদিরা অনেকেই নগরীকে পশ্চিমের জেরুজালেম ডেকে থাকে। তবে সুন্নি মুসলিমরা এখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়। তুরস্ক, মরক্কো থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অতীতের ওলন্দাজ কলোনীভুক্ত ইন্দোনেশিয়া ও সুরিনামের অনেক মুসলমান এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এছাড়াও তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া থেকে আগত অভিবাসীরাও সংখ্যায় নেহায়েত কম না।
টিউলিপ ফুল পপি ফুল
বাস থেকে নেমেই খেয়াল করলাম খিদে লেগে আছে। সাইকেল, খাল, হীরে জহরতের চক্করে পড়ে পাত্তা পাচ্ছি না। একটা তুর্কি রেস্টুরেন্টের এক কোণে নামাজ পড়লাম তারপর টোম্যাটো ছাড়া তুর্কি সালাদ খেলাম। আমার সামনে আরেকজন ভাজা মাংসের থালা নিয়ে বসেছে। কিন্তু এক টুকরো মাংস চেখে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। হল্যান্ডে এসে হল্যান্ডের কুইজিন না চেনা অন্যায়। ডাচ হচপচের কথা শুনেছি অনেকবার। আলু সেদ্ধ, সব্জি আর মাংসের মিশ্রণে তৈরি। হালাল হচপচ খুঁজে দেখার মতো সময় আসলে নেই, এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। সে জন্য ক্যাফে থেকে আনা স্পেশাল ওলন্দাজ নিয়মে তৈরি আপেল কেক খেয়েছি এক পিস, নেদারল্যান্ড স্পেশাল চিজকেকও প্যাকেটে নিয়েছি।
কেক ভালো লেগেছে। ক্যারামেলাইজড আপেলের টুকরো চিবুতে চিবুতে পসরা বসানো দোকান, টিউলিপ- সূর্যমুখীসহ নাম না জানা অসংখ্য ফুলের চারা উদ্দেশ্যহীনভাবে দেখছিলাম। শুনেছিলাম এখানকার নার্সারিতে নাকি দেদারসে ফুলের চারা, টিউলিপের কন্দের মতো পপি ফুলের চারা/গাঁজার চারার বেচা-বিক্রি ভালো হয়। এই কথা গাঁজাখুরি নয়, সত্য। অনেক পর্যটক এত দূর থেকে গাঁজার চারা কিনে নিয়ে যায়। তাদের তালিকা উৎকট এই স্যুভেনির সংগ্রহের পর সমৃদ্ধ হয়ে ডালপালা ছড়ায়।
নেদারল্যান্ডের মানুষের ফুলের প্রতি তীব্র অনুরাগ আছে। বাড়িতে বাড়িতে লাগোয়া চিলতে বাগানে বা বারান্দায় তার প্রমাণ তো পেয়েছিই। আর গ্রাখটের স্বচ্ছ পানিতে জলরঙে আঁকা ছবি হয়ে ছিল গুচ্ছ ফুলের প্রাচুর্য। আমাদের প্লেন যখন হেলেদুলে ওপরে উঠছিল তখন চমকে উঠেছি মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ টিউলিপের বাগান দেখে। সার বাঁধা হলুদ, বেগুনি, লাল, গোলাপি টিউলিপেরা যেন খুব বাধ্য সেনাবাহিনী। বাতাসের আদেশে আরামে দাঁড়িয়ে আছে এখন।
একটু পর মার্চ শুরু করতে হবে।