জার্নি টু ব্ল্যাকহোল

আশরাফ পিন্টু

0
159

গ-৭ গ্রহ থেকে বিদায় নিয়ে স্বনন ও খোগো (স্বননের ভিনগ্রহের নতুন বন্ধু) আরেকটি নতুন গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মহাকাশ ভ্রমণ যেন এক নেশায় পেয়ে বসেছে ওদেরকে। একের পর এক মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। নিত্য-নতুন আবিস্কারের নেশা মৃত্যু ভয়কে যেন জয় করেছে ওরা। এর মধ্যে যে দু-একবার বিপদে যে পড়েনি, তা নয়। স্বনন একবার বিপদে পড়েছিল। এর আগে ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ থেকে কপালগুণে উদ্ধার পেয়েছে সে। বিশেষ করে ভিনগ্রহের বন্ধুরা না থাকলে ওর কী যে হতো! এ ব্যাপারে ভিনগ্রহের বন্ধু বনবনই ওকে বেশি সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। ওরা অনেক বুদ্ধিমান প্রাণি। আচার-ব্যবহারও খুব ভালো।
অত্যাধুনিক নভোযানটি আলোর গতিতে ছুটে চলেছে। কিছুক্ষণ ছুটে চলার পর চারপাশটা কেমন অন্ধকারে ছেয়ে যায়। স্বনন এতক্ষণ গ-৭ -এর বাসিন্দাদের কথা ভাবছিল। কত সুন্দর ওদের ব্যবহার! জীবনযাত্রাও কত উন্নত! প্রযুক্তিতে কত এগিয়েছে ওরা! জ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে আমরা কবে ওদের মতো উন্নত হতে পারব? এমন সুন্দর চিন্তার মগ্নতা ওকে ভেঙে দিলো চারপাশের নিকষ-কালো অন্ধকার। এরই মধ্যে চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় নভোযানটি দ্রুত গতিবেগে ছুটে চলছে তো চলছেই।
স্বনন পাশে বসা খোগোকে উদ্দেশ্য করে বলল, এত অন্ধকার কেন?
খোগো বলল, তোমার কি ভয় লাগছে?
অন্ধকারে খোগোর চোখ-মুখ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু শব্দ শুনে ও জবাব দিলো, ভয় তো লাগতেই পারে, আমরা কোথা দিয়ে যাচ্ছি?
– মনে হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের পাশ দিয়ে।
-অ্যা! বলো কী! মানে সেই ভয়ংকর কৃষ্ণ-গহ্বরের চক্রের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি? স্বনন যতটা ভয় পেয়েছিল না, তার চেয়ে দশগুণ বেশি ভয় পেয়ে গেল। কম্পিত স্বরে বলল, এখন উপায়?
-এত ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ের তো তেমন কারণ দেখছি না।
তোমরা তো ভয়কে জয় করেছো কিন্তু আমরা তো মানুষ; আমরা এখনো ভয়কে জয় করতে পারে নি।
-সাহস না থাকলে কোনো কিছু জয় করা সম্ভব হয় না। ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণ-গহ্বরে যখন ঢুকেই পড়েছি, তখন এর। দেখে ছাড়ব।
-যদি আমাদের নভোযান ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়?
-হবে না। ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমাদের পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তারা মনে করত এর মধ্যে কিছু পতিত হলেই সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায়। আসলে এর। কোথায় এখনো কেউ জানে না। ধ্বংস হয় নাকি অন্য কোথাও যেয়ে পৌঁছে তা কেউ এ পর্যন্ত জানতে পারে নি। আর আমাদের নভোযানটি অত্যাধুনিক এবং অনেক শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় একটি নভোযান; কাজেই তেমন কিছু হবে না।
– আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।
– মনে সাহস সঞ্চার করো। আমাদের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এর রহস্য উম্মোচন করা। আজ ভাগ্যক্রমে যখন ঢুকেই পড়েছি তখন এর শেষ দেখেই ছাড়ব। শেষের কথাটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে খোগো।
– কী আজগুবি কথা বলছো তুমি। আমরা কৃষ্ণ গহ্বরের হাত থেকে বাঁচতে পারলে তো?
– দ্যাখো বিজ্ঞানী স্বনন, দিনের পর যেমন রাত আসে, অন্ধকারে পর তেমনি আলো থাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অসীম অন্ধকারের পর অবশ্যই আমরা আলোর সন্ধান পাবো।
– দেখা যাক। হতাশার সুর স্বননের।
স্বননদের স্বয়ংক্রিয় নভোযানটি কি এক অজানা চৌম্বকীয় আকর্ষণে ছুটে চলছে তো চলছেই। কত সময় ধরে চলছে তার কোনো হিসেব নেই। চারিদিকে আলোকহীন এক অসীম শূন্যতা। নভোযানের ভিতরে এবং বাইরের বাতিগুলোর আলোও শুষে নিয়েছে ব্ল্যাকহোলের এই অজানা শক্তি। এ কেমন স্থান? এ থেকে ওরা নিস্কৃতি
পাবে কীভাবে? নভোযানটি চলতে চলতে এক সময় প্রচ- শক্তিতে বিস্ফোরিত হয়। এর পর কে কোথায় যায় নিকষ কালো মৃত্যুর মতো অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না।
দুই
স্বননের যখন জ্ঞান ফেরে দেখে- চারিদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কোথাও এতটুকু আলো নেই। কোথায় এসেছে ও। ও কি বেঁচে আছে, না মরে গেছে? শুধু মনে আছে কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল ওদের নভোযানটি। এরপর প্রচ- গতিতে এক বিস্ফোরণ। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা দিয়ে আবার পূর্বের মতোই ভয়াবহ অন্ধকারে ভরে যায়। হঠাৎ কাছেই কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের শব্দ হয়। ও কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তাহলে কি মৃত্যু অতি সন্নিকটে চলে এসেছে? স্বনন মনে সাহস সঞ্চার করে বলে, আশেপাশে কেউ আছেন?
স্বননের কথার কোনোরূপ জবাব আসে না। আসলেই কি সে বেঁচে আছে? নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে? গায়ে চিমটি কাটে। নাহ্ জেগে আছে ও। কিন্তু যেখানে শুয়ে আছে, জায়গাটিকে তো কোনো বিছানা মনে হচ্ছে না? বেশ শক্ত একটি জায়গা। শুনেছে মৃত্যুর আগে মানুষকে কঠিন এক অন্ধকারের সম্মুখীন হতে হয়। ওর কি তাই হতে চলেছে? হঠাৎ একটু আলোর আভার দেখা পায়। বিদ্যুৎ চমকের মতো আলোর রশ্মিটুকু একটু দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যায়। ও আবার উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে, কেউ কি আছেন?
কিছুক্ষণ পর স্বননের গালে প্রচ- শব্দে একটি চড় অনুভূত হয়। সঙ্গে সঙ্গে দুটি আলোকরশ্মি জ্বলে ওঠে। সে আলোয় দেখে একটি কালো ছায়ামূর্তি ওকে চড় বসাল। ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। আলোক রশ্মি দুটো স্থির না হয়ে নিভছে আর জ্বলছে। ওই মৃদু আলোয় স্বনন দেখে- ৯/১০ ফুটের মতো লম্বা এক কালো রঙের প্রাণী। মুখ কালা কুৎসিত, নিচের পাটির দাঁতগুলো ঠোঁটের উপর দিয়ে বেরনো। অন্যান্য প্রত্যঙ্গগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। স্বনন শুনেছে মৃত্যুর সময় যমদূত নাকি বিভিন্ন ভয়ংকর আকৃতিতে আসে। ভয়ংকর মূর্তি ধরে অজ্ঞান করে জান কবজ করে। স্বনন এবার ভড়কে যায়। মুখ দিয়ে কথা বেরোতে চায় না। তবু মনে সাহস সঞ্চয় করে বলে, কে আপনি?
আলোকরশ্মি দুটো এবার স্থির হয়ে জ্বলতে থাকে। বলে, আমি এখানকার বাসিন্দা নিশাই।
স্বননের মনে একটু সাহস সঞ্চয় হয়, তাহলে এ যমদূত নয়। একটু রাগত স্বরে বলে, তুমি আমাকে মারলে কেন? – এটাই এখানকার অভ্যর্থনার নিয়ম।
স্বনন একটু অবাক হয়, বলে কী! তারপর শান্তস্বরে বলে, এ জায়গারটির নাম কি?
– এটি ব্লাকহোল নামের একটি গ্রহ।
– ব্লাকহোল কি কোনো গ্রহ?
– হ্যাঁ, কোটি কাটি বছর আগে এটির নাম ছিল ‘হটাহট’ নামের একটি গ্রহ। কিন্তু মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রবল প্রভাবে ‘ব্লাকহোল’-এ রূপান্তরিত হয়।
– শুনেছি, ব্লাকহোল হলো এক কঠিন দূর্গম জায়গা। এখানে যে বস্তু ঢোকে তা আর বেরুতে পারে না।
– তা ঠিক। কিন্তু এখানেও তো আলাদা একটা জগত আছে, যা তোমাদের পৃথিবীর কোনো লোক জানে না।
– কী রকম?
– এটা তো এক সময় একটি গ্রহ ছিল। গ্রহটি ব্লাকহোলে পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বাসিন্দারাও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
– বুঝলাম না।
– সে অনেক কথা। তবে এটুকু বলা যায়- আমরা এক সময় তোমাদের মতোই আলোকিত বা দৃশ্যমান ছিলাম। আমাদের গ্রহটিতে অন্ধকার নেমে আসার পর অর্থাৎ ব্লাকহোলে রূপান্তরিত হয়ে আমরাও অন্ধকারের জীবে পরিণত হয়েছি।
– তার মানে তোমাদের অবয়ব আছে ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি আমরা দেখতে পারছি না।
– হ্যাঁ।
– তোমাদের সব কিছুর সঙ্গে পৃথিবীর কতটুকু মিল আছে?
– খুব কমই মিল আছে। বরং তোমাদের উল্টোটাই বেশি।
– যেমন… ?
– যেমন তোমাদের পৃথিবীতে দিন আছে, রাতও আছে কিন্তু আমাদের এখানে দিনরাত নেই- শুধুই রাত। কেননা আমাদের এখানে কোনো সূর্য নেই। যেটুকু আবছা আলো পাই তা মহাবিশ্বের সুদূর গ্রহ-নক্ষত্র থেকে আসা।
– তাছাড়া…
– তাছাড়া আমরা যুগ যুগ ধরে অন্ধকারের মধ্যে বসবাস করতে করতে অন্ধকারের জীবই হয়ে গেছি। – বুঝলাম না।
– পরে তোমাকে সব খুলে বলব। এখন চলো তোমাকে আমাদের গ্রহটিকে ঘুরে দেখাই। – কীভাবে দেখবো? সবই তো অন্ধকার।
– অন্ধকারেরও এক প্রকার সৌন্দর্য আছে। তোমাদের পৃথিবীর নিশাচর প্রাণিগুলো যেমন রাত্রিতে দেখে তেমনি আমরাও আমাদের সবকিছু দেখতে পাই। তবে তুমি খালি চোখে এখানকার সব কিছু দেখতে পাবে না; এ জন্য তোমার চোখে এক প্রকারের চশমা লাগিয়ে দিতে হবে- তাহলে তুমি আমাদেরই মতো সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাবে।
নিশাই ওর পকেট থেকে একটি গোলাকৃতির চশমা বের করে স্বননের চোখে লাগিয়ে দেয়। চশমা পরার পর স্বনন সামনে তাকিয়ে দেখে নিশাই ১০ ফুটের মতো লম্বা, মুখম-ল নিগ্রোদের মতো কালো, ছাইরঙের দাঁতগুলোর নিচের পাটি ঠোঁটের উপর দিয়ে বেরোনো। চোখের মণি দুটো জ্বলজ্বল করছে, রাত্রি বাঘের চোখ যেমন জ্বলে। কেউ হঠাৎ করে দেখলে ভয় পেয়ে যাবে।
স্বননকে চুপ থাকতে দেখে নিশাই বলে, চলো, আগে তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করি; তারপর আমাদের গ্রহটিকে ঘুরিয়ে দেখানো যাবে।
তিন
নিশাই খাবারে জন্য স্বননকে একটি প্রান্তরে নিয়ে আসে। নিশাইয়ের মতো অনেকেই ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। নিশাই এগিয়ে গিয়ে পলিথিনের মতো একটা কাগজে খাবার নিয়ে আসে। খাবারগুলো স্বননের হাতে দিয়ে বলে, খাও।
স্বনন তাকিয়ে দেখে খাবারগুলো নোংরা এবং উচ্ছিষ্ট ধরনের। পৃথিবীর খাবারের সাথে তেমন মিল না থাকলেও খাবারগুলো কেমন ময়লাযুক্ত, খাবারের মধ্যে বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট কীট ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাবারগুলো দেখে স্বননের গা ঘিন ঘিন করে বমি বমি ভাব হয়। ও বনবনের হাতে খাবারগুলো ফেরত দিয়ে বলে, এমন নোংরা খাবার আমরা খাই না।
নিশাই বলে, আমরা তো এগুলোই খাই। নোংরা-উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়েই আমরা অভ্যস্ত। মৃদু হেসে বলে, তোমরাও কিন্তু খাও।
– না জেনে মিথ্যা বলছো কেন? স্বনন হঠাৎ রেগে যায়।
– রাগছো কেন স্বনন? তোমরাও খাও, তবে স্বীকার করবে না তাই।
– কী যে বলো তুমি। স্বনন শান্তস্বরে বলে।
– তোমাদের আর আমাদের মধ্যে এটাই পার্থক্য। তোমরা সত্য গোপন করো আর আমরা সত্য গোপন করি না।
– ঠিক আছে, আমার আর খেতে হবে না।
– না, তুমি আমাদের মেহমান। তোমার উপযোগী খাবারের আমরা ব্যবস্থা করেছি। এ জন্যে তোমাকে আমাদের ফলমূলের বাগানে যেতে হবে।
নিশাই স্বননকে একটা বিশাল ফলের বাগানে নিয়ে আসে। এখানে নানা ধরনের ফল পেকে টসটস করছে। অধিকাংশ ফলই সাদা আর কালো রঙের। পেয়ারার মতো একটি কালো রঙের ফল দেখে স্বননের ভীষণ খেতে ইচ্ছে করে। বলার সঙ্গে সঙ্গে নিশাই ওকে কয়েকটি ফল পেড়ে স্বননের হাতে দেয়। ফলগুলো দেখতে পেয়ারার মতো মনে হলেও খেতে ডাবের শাঁসের মতো নরম এবং মিষ্টি। দুটো ফল খেয়েই ওর পেট ভরে যায়। বাকী ফলগুলো নিশাইয়ের হাতে দিয়ে বলে, এগুলো তুমি খাও।
নিশাই ফলগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলে, আমরা ফল খাই না। এগুলো তুমিই রেখে দাও, পরে কাজে লাগবে।
– কেন? স্বনন একটু অবাক হয়।
– আমরা তো ওই নোংরা খাবারগুলো খাই।
– তাহলে এগুলো কে খায়?
– এগুলো আমাদের পশুপাখি খায়।
– বলো কী!
– হ্যাঁ।
– চলো এবার আমাদের অফিসে যাওয়া যাক।
– হ্যাঁ চলো।
নিশাই স্বননকে একটি বড় হলরুমের মতো জায়গায় নিয়ে এলো। এখানে কিছু টেবিল আছে কিন্তু চেয়ার নেই। টেবিলের পর কিছু ফাইলপত্রও রয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো অফিসিয়াল কাজ-কর্ম করছে না। কেউবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করে গল্প করছে, কেউবা দৌড়াদৌড়ি করে বিভিন্ন প্রকারের ইনডোর গেম খেলছে। স্বনন অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে এ সব দৃশ্য। তারপর নিশাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, কী ব্যাপার, কেউ তো অফিসিয়াল কাজ-কর্ম করছে না।
নিশাই মৃদু হেসে বলল, এগুলোই ওদের অফিসিয়াল কাজ।
– মানে?
– মানে এভাবেই বিনোদনের মাধ্যমে আমরা অফিসিয়াল কাজ করে থাকি।
– তাহলে দেশ চলে কী করে?
– এক অদৃশ্য শক্তির বলে চলে।
– বুঝলাম না।
– এত জানতে চেয়ো না। আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারবে। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, তোমাদের দেশের সাথে এত মিল নেই আমাদের এখানে। তবে মিল যা আছে সেটা বুঝতে পারছো না হয় তো।
– যাক বোঝার দরকার নেই; তবে তোমাদের আজব আজব কা-কারখানা দেখতে বেশ ভালোই লাগছে।
– এবার তোমাকে আমাদের রাজদরবারে নিয়ে যাবো, যেখানে গেলে তুমি আরো অবাক হবে।
চার
নিশাই স্বননকে একবারে অন্ধবারাচ্ছন্ন একটি জায়গায় নিয়ে আসে। স্বননের চোখে পাওয়ারফুল আলোক-চশমা থাকলেও তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও। আবছা আলোয় শুধু পথটুকু দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর এক বিশাল বাগানের মধ্যে এসে থামল ওরা। বাগাানের মাঝখানে ফাঁকা জায়গা। নিশাই স্বননকে বলল, এটাই আমাদের দরবার হল। স্বনন দেখল কোথাও কোনো চেয়ার পাতা নেই। অদূরে শুধু একটি বড় টেবিল পাতা রয়েছে। দু-একজন করে নিশাইয়ের সমগোত্রীয়রা এসে টেবিলটির সামনে পিছন দিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে জায়গাটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
নিশাই বলল, একটু পরেই আমাদের রাজা মহাশয় আসবেন।
স্বনন একটি কথা চেপে রাখতে পারছিল না। ও বলে ফেলল, তোমাদের চেয়ার কোথায়? কেউ তো বসছে না। নিশাই মৃদু হেসে বলল, আমরা তো কেউ বসি না। তাই চেয়ারের প্রয়োজন হয় না।
স্বনন মনে মনে বলল, তাই তো! এতক্ষণ ও তো ওদের কাউকে বসতে দেখে নি। প্রকাশ্যে বলল, এ রকম মিটিং তোমাদের ক’বার হয়?
-তোমাদের হিসেবে মাসে একবার বলতে পারো।
-এখান থেকেই দেশের সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?
-হ্যাঁ।
হঠাৎ এক বিদঘুটে শব্দ হলো হলো। সবাই টেবিলটিকে পাছা উঁচিয়ে অভিবাদন জানাল। স্বনন দেখল- টেবিলের এক ফুট উঁচুতে একটি আলোকরশ্মি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। নিশাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, রাজা মহাশয়কে দেখা যাচ্ছে না যে?
নিশাইও ওদের সবার মতো পিছন দিক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বননের দিকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ওনাকে আমরা কেউ এ পর্যন্ত দেখেনি। উনি অশরীরী।
স্বননের আবার অবাক হবার পালা। কিন্তু তোমাদের তো সবাইকে আমি দেখছি।
-এটাই তো রাজা-প্রজার পার্থক্য। উনি অশরীরী জীবে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন বলেই তিনি শক্তিমান। আর শক্তিমান বলেই তিনি আমাদের রাজা হতে পেরেছেন।
-তোমরা অশরীরী হতে পারো না।
– সে বিদ্যা খুব কম লোকেরই আছে। তবে…
সভাসদগণ!
এক বিকট শব্দের বজ্রকণ্ঠ ভেসে এলো টেবিলের ওখান থেকে। স্বনন বুঝতে পারলো রাজা মহাশয়ের কণ্ঠস্বর এটি। তিনি দরবারে চলে এসেছেন। স্বনন একমনে শুনতে লাগলো রাজামহাশয়ের বক্তব্য :
আমরা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের এ গ্রহটিকে আলোকময় করে তুলতে পারে নি। প্রকৃতি আমাদের উপর রুষ্ট। আমরা ক্রমান্বয়ে অন্ধকারের জীবে পরিণত হয়েছি। আমাদের মন-হৃদয় প্রকৃতির প্রভাবেই অন্ধকারময় হয়ে উঠেছে। কাজেই আমরা আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চাই।
স্বনন অবাক হয়ে পাশে পিছনফেরা নিশাইকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ইঙ্গিত করল, কী বলছে এসব? নিশাইও একটু ঘাড় ঘুরিয়ে স্বননকে চুপচাপ শুনে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো।
আজ আমি শুনতে চাচ্ছি গত এক মাসে কে কতটি ভারাপ কাজ করেছো?
এক প্রতিনিধি বলে উঠল, মহাশয়, আমাদের এলাকায় যারা অভাবগ্রস্ত ছিল-তাদের সবাইকে মেরে ফেলে দিয়েছি। যারা বিছানায় পড়ে মৃত্যুর দিন গুণছিল তাদেরকেও গলা টিপে হত্যা করে আত্মার শান্তি দিয়েছি।
-বাহ! সুন্দর তো! আপনি? আরেক প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন রাজা মহাশয়।
-মহাশয়, আমার এলাকায় যারা আলোর জন্য প্রার্থনা করছিল তাদের সবাইকে মেরে ফেলার -কুম দিয়েছি।
-শুধু -কুম! মেরে ফেলো নি?
-এতক্ষণে হয়তো সব মরে ভূত হয়ে গেছে মহাশয়।
-তোমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল? আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন রাজা মহাশয়।
-হ্যাঁ মহাশয়, এখন আমাদের লোকালয় ৯০% মিথ্যে কথা বলছে। আগে ৬০% মিথ্যে কথা বলতো। আর ১০% হলেই আমরা একটা ‘মিথ্যার’ স্বর্ণযুগ চালু করতে পারব।
স্বনন সবার বক্তব্য শুনে হতবাক হয়ে যায়। কী বলছে এসব? সে কোথায় এসে পৌঁছেছে? এতো এক অন্ধকার যুগ চলছে এখানে। এ থেকে এরা কীভাবে আলোর দেখা পাবে?
সভাসদগণ!
রাজা মহাশয়ের কথায় স্বনন আবার বক্তব্য শুনকে মনোযোগী হয়।
-শোনো সবাই। আমরা আরো বেশি বেশি খারাপ কাজ করব। মিথ্যে বলব, এতেই আমাদের মঙ্গল ঘনিয়ে আসবে।
-কী বলছে এ সব! স্বনন আর স্থির থাকতে পারে না। নিশাইকে কনুুয়ের মাথা দিয়ে আবার গুঁতো মারে। নিশাইও পূর্বের মতো ইশারায় স্বননকে চুপ থাকতে বলে।
-তোমরা জেনে রাখো, খারাপ এবং মিথ্যের কোনো বিকল্প নেই। এতে হয়তো দু’একজনের মন খারাপ হতে পারে। কেননা এখনো আমরা ১০০% খারাপ হতে পারিনি। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। বিশ্বজগতের সবকিছুরই পরিণতি আছে। একসময় খারাপ আর মিথ্যাতে যখন দেশ পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে তখনই হয়তো আমরা ভালো আর সত্যের দেখা পাবো। রাতের পর যেমন দিনের দেখা মেলে তেমনি আমরা অন্ধকারের পর আলোর দেখা পাবো।
-কী অদ্ভুত যুক্তি! স্বনন মনে মনে ফুঁসতে থাকে। নিশাইকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। নিশাই ঘাড় ঘুরিয়ে চুপি চুপি বলে, এই তো, কিছুক্ষণের মধ্যে সভার সমাপ্তি ঘোষণা হবে। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মধ্যে সভা। হয়ে যায়। স্বনন যেন হাঁফছেড়ে বাঁচে।
পাঁচ
স্বনন নিশাই হাঁটছিল আর কথা বলছিল :
-কী অদ্ভুত যুক্তি! তোমরা তাহলে বিশ্বাস করো এভাবেই মুক্তি পাবে? খারাপের পর ভালো আসবে, মিথ্যের পর সত্যের আগমন ঘটবে। এভাবেই তোমাদের নিস্কৃতি ঘটবে?
-তুমি এত উতালা হচ্ছো ক্যানো? আমরা অনেকেই এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই না। কেননা, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে আমাদের এই গ্রহটি হয়তো আলোকময় ছিল। তখন হয়তো ভালোমন্দ উভয়ই ছিল। কিন্তু এখন তো আমরা যুগ যুগ ধরে অন্ধকার আর মন্দতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কাছে ভালোমন্দের পার্থক্য অধিকাংশই বুঝতে পারে না।
-তুমি জানো, এমন একটি গ্রহ আছে যেখানে ভালোমন্দের পার্থক্য বোঝা যায়।
-সে গ্রহের নাম কী?
-সেটা আমাদের পৃথিবী।
-সেখানকার বাসিন্দারা কেমন?
-সেখানকার বাসিন্দা মানে আমাদের মানুষের মধ্যে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ দুটোই আছে।
-তাহলে প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে আমাদের যেতে হয়।
-অবশ্যই। আমাদের পৃথিবীতে গেলে তোমরা সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারবে।
-তা ঠিক; কিন্তু শুধু ভালো বা সত্য বলে কি কোনো জগত বা গ্রহ আছে?
-হ্যাঁ, ‘মঙ্গল’ নামের একটা গ্রহ আছে।
-সেট কোথায়?
-আমাদের পৃথিবীর পাশেই।
-তুমি এতো সব জানো কী করে?
-আমি অনেক গ্রহে ভ্রমণ করেছি।
-এসব গ্রহে গেলে তো অনেক অত্যাধুনিক নভোযান লাগবে। আমাদের এখানে তো সেগুলো নেই।
-তাই তো; এসব কথা আগে ভাবিনি তো।
-তাহলে কী করা যায়?
-তাহলে তোমার কাছে শুনি, এসব গ্রহের গল্পগুলো। এসব গ্রহের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা,আচার আচরণ ইত্যাদি।
-ঠিক আছে। তবে শোনো আমাদের পৃথিবীর কথা-
আমরা মানুষ জাতি এখানে বসবাস করি। মানুষ ছাড়াও তোমাদের মতো এখানে বিভিন্ন জীবজন্তু অর্থাৎ পশুপাখিও আছে। তারা বোবা-নিরীহ প্রাণি। মানুষরাই এখানে উন্নত জীব। তারা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ক্রমান্বয়ে সভ্যতা গড়ে তুলেছে পৃথিবীতে।
-তাহলে তোমরা বেশ পরিশ্রম করো?
-হ্যাঁ। পরিশ্রমের মাধ্যমেই উন্নতির শিখরে পৌঁছানো যায়। তোমাদের মধ্যে এই দিকটা খুব কম। তবে আমরা সব মানুষই পরিশ্রমী নয়। অনেকেই অলস।
-বুঝলাম না।
-আমরা অনেকেই কাজ না করে উন্নতি করতে চাই।
-সেটা কেমন? -যেমন নিজে দায়িত্ব পালন না করে বসে থেকে ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ করি।
-ঘুষ কী?
-সেটা তোমরা বুঝবে না। তোমাদের সমাজে যেটা প্রচলিত নেই- তাই বুঝানো কষ্টকর। ঘুষ হলো নিজ-দায়িত্ব পালন না করে বসে থেকে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করা।
-ও। না বুঝেই নিশাই বলে এটা ভালো না মন্দ কাজ।
-এটা হলো মন্দ কাজ। আমি বলিনি আমাদের পৃথিবীতে ভালোমন্দ দুটোই আছে।
-আরো ভালোমন্দ সম্পর্কে কিছু বলো?
-তোমরা যেমন বিনা কারণে তোমাদের অনেক সাধারণ জীবকে মেরে ফেলো, আমাদের মধ্যে অনেক সময় সেটা হয়ে থাকে; তবে স্বার্থের জন্যই হানাহানি, খুন-খারাবি বেশি হয়ে থাকে। -এটা তো তোমাদের মন্দ দিক না, এবার ভালো দিকগুলো বলো?
-আমাদের নারী জাতির মধ্যে মায়া-মমতা প্রবল। তারা সন্তানকে পাগলের মতো ভালোবাসে। -পাগল কী?
-ওটা একটা কথার কথা। অর্থাৎ তারা সন্তানদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসে।
-নিশ্চয়ই ‘পাগল’ বলে কিছু একটা আছে। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।
-পাগল হলো যে সব মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায় অর্থাৎ বুদ্ধি এলোমেলো হয়ে যায়।
-বুঝলাম না।
-তোমাদের মধ্যে তো কোনো পাগল নেই, তাই বুঝতে পারছো না।
-পাগল কীভাবে হয়?
-যখন মানুষের ব্রেনে অত্যন্ত চাপ পড়ে তখন ব্রেন এলামেলো হয়ে যায়।
-যাক বাঁচা গেল! এদিক থেকে আমরা মুক্ত।
-তোমাদের মধ্যে তো তেমন দুঃখ-বেদনা নেই, তেমন ব্রেনের বিকাশও নেই; কাছেই পাগল হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই।
-তা ঠিক। কিন্তু তোমরা পাগল হয়েও এত উন্নতি করলে কীভাবে?
-নিশাইয়ের কথা শুনে স্বনন হেসে ফেলে। বলে, আমাদের মধ্যে তো সবাই পাগল নয়। অল্প কিছু পাগল আছে পৃথিবীতে। তবে কিছু পাগল আছে যাদের পাগলামির কারণে অনেক নতুন জিনিস আবিস্কৃতও হয়েছে। জেনে রেখো পাগলামির সংমিশ্রণ ছাড়া কেউ উন্নতি করতে পারে না। এদের মধ্যে অনেকেই সভ্যতা বিকাশে কমবেশি অবদান রাখছে। বুঝলে… আ-আ-আ…
স্বনন কথা বলছিল আর ঝিঁমুচ্ছিল। নিশাই বুঝতে পারছিল না যে স্বনন কেন এমন করছে। ‘স্বনন এমন করছ ক্যানো?’ বলে নিশাই একটা সজোরে ধাক্কা দিলো।
স্বনন চমকে উঠে বলল, আমার ঘুম আসছে; কালকে আবার বাকিটুকু বলব।
ছয়
পরদিন নিশাই আবার স্বননের রুমে আসলো। ওর খুব ভালো লেগেছে স্বননের গল্পগুলো। কত্ত সব নতুন নতুন কথা! আগে কখনো এমন কথা কল্পনায়ও আসেনি। এ মহাবিশ্ব কত রহস্যময়! কত বিচিত্র প্রাণীই না আছে এ মহাবিশ্বে। আজ সে স্বননের কাছে শুনবে ‘গুড প্লানেট’ বা ‘মঙ্গল গ্রহ’-এর কথা।
স্বনন কীভাবে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ চুপ থাবার পর বলল, ‘গুড প্লানেট’ মানে ‘মঙ্গল গ্রহ’-এর কথা বলছো?
-হ্যাঁ, ওখানে সব কিছুই নাকি ভালো, মন্দের কোনো লেশ নেই।
-ঠিক বলেছো। মঙ্গল গ্রহের সবকিছুই মঙ্গলজনক। তারা যুগে যুগে সততার সঙ্গে কাজ-কর্ম করে আজ উন্নতির এক চরম শিখরে পৌঁছেছে।
-কেমন?
-তারা কখনো মিথ্যে কথা বলে না। সততার সঙ্গে সবাই নিজ নিজ কাজকর্ম করে থাকে। এটা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বংশপরস্পরায় চলে এসেছে।
-তাদের মধ্যে কি অন্যায়-অত্যাচার নেই।
-না নেই। ওখানে মিথ্যে বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। আর এ কারণেই ওখানে কোনো অন্যায়-অত্যাচার নেই।
-তারা এখন কেমন উন্নত প্রাণী?
-তারা এতই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছিছে যে, শুনলে রূপকথা গল্পের মতো শোনাবে।
-বলো, শুনতে ইচ্ছে করছে।
-মনে করো, তারা ইচ্ছে করলে মহাবিশ্বের যে কোনো গ্রহে অতি অল্পসময়ে যেতে পারবে-এমন অত্যাধুনিক নভোযান তৈরি করেছে। সত্যি কথা বলতে কি জানো, ওরা কিন্তু এ গ্রহের আদি বাসিন্দা নয়। -আগে ওখানে কারা ছিল?
-আগে ছিল রোবট ও মানবজাতি। তবে তারাও এ গ্রহের আদি বাসিন্দা নয়। রোবট আর মানবজাতির মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধে সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরপর উন্নত গ্রহের জীবরা গিয়ে ওখানে বসতি গেড়ে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করে।
-তারপর?
-তারপর আর কী, ওরা সততা আর মেধা দিয়ে নিজেদেরকে উন্নত থেকে উন্নততর জীবে পরিণত করেছে। -আর?
আরো অনেক কথা বলার আছে ওদের সম্পর্কে, বলতে বলতে হয়তো একটা উপন্যাসই হয়ে যাবে। -উপন্যাসটা আবার কী?
-কী মুশকিল! এটা একটা উপমা দিলাম আর কী।
-তবুও এ সম্পর্কে একটু বলো।
-মূলত উপন্যাস হলো মানুষেরই একটা লিখিত জীবনকাহিনী।
-ও আচ্ছা। ওদের সম্পর্কে আবার বলো।
-ওরা রোগ-ব্যাধি জয় করে দীর্ঘায়ু হয়েছে। অমরত্বের সন্ধানে গবেষণা করছে।
-আর কী কী গুণ আছে ওদের?
-মনে করো, ওদের একটি জিনিস প্রয়োজন হচ্ছে, তা ওরা নড়াচড়া না করে রিমোটের মতো একটি যন্ত্র দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসছে। ওদের এখন খুব একটা দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করতে হয় না। ওরা এখন বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির সাহায্যে কাজ করে থাকে। এসব যন্ত্রপাতিকে ছোট ছোট রোবটও বলা যায়।
-রোবট কী? -রোবট হলো যন্ত্রপ্রাণি, যা ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। মানুষ বা মানুষ জাতীয় উন্নত প্রাণীর সৃষ্টি।
-আমরা তাহলে তো অনেক পিছিয়ে আছি।
-হ্যাঁ, তোমাদের সভ্যতা নি¤েœর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
-এ থেকে নিস্কৃতির উপায় কী?
-এ থেকে নিস্কৃতির একমাত্র উপায় হলো ব্লাকহোলকে পুনরায় গ্রহে রূপান্তরিত করা।
-সেটা কীভাবে সম্ভব?
সেটা মানুষ বা অন্য কোনো গ্রহের উন্নত প্রাণী দ্বারা পরিবর্তন করা প্রায়ই অসম্ভব। একমাত্র মহাজাগতিক বিপর্যয় ঘটলে হয়তো এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারো।
-মহাজাগতিক বিপর্যয় তো একমাত্র প্রকৃতি বা আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া হবার নয়। তোমাদের মঙ্গলের উন্নত প্রাণীরা পারবে না। নিশাই একটু মনমরা হয়ে বলে।
-বোধহয় পারবে না। তবু গিয়ে শোনা যেতে পারে। কথাটি বলেই স্বননের মনটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণ গল্পে গল্পে ওর পৃথিবীতে ফেরার চিন্তা মাথায়ই ছিল না। ও মনমরা হয়ে বলল, আমি পৃথিবীতে যাবো কী করে?
-আমাদের এখানে তো তেমন কোনো উন্নত যান নেই যে তোমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবো। নিশাইও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলল। একটু থেমে বলল, তোমার নভোযানে আর কেউ ছিল?
-হ্যাঁ, আমরা দু’বন্ধু ছিলাম আমি আর খোগো।
-ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারো, যদি ও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারো।
-ও বেঁচে আছে কিনা জানি না। তবুও দেখা যাক। স্বনন পকেট থেকে ইথারযন্ত্রটি বের করে বার কয়েক চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ও পাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। মনমরা হয়ে নিশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হয়তো ও বেঁচে নেই, মরে গেছে।
-মন খারাপ করো না স্বনন। নিশাই সান্তনা দেয়। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করে দেখো।
-তা হয়তো দেখবো খন। কিন্তু আমি আমি কীভাবে ফিরে… স্বননের চোখে অশ্রুতে টলমল করে।
-কেঁদো না স্বনন। উপায় একটা হবেই। নিশাই সান্তনা দেয়। তুমি আর একবার একটু চেষ্টা করে দেখো না।
-ঠিক আছে। স্বনন আবার ইথারযন্ত্রটি মুখের সামনে ধরে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু যন্ত্রটি থেকে শুধু গোঁ-গোঁ আর বোঁ-বোঁ শব্দ হতে থাকে। স্বনন রাগ করে যন্ত্রটি ঢিল মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। ফেলে দেবার পর পরই মনে হয় একটি তো মেসেজ পাঠানো যায়। ও যদি বেঁচে থাকে তবে নিশ্চয়ই রিপ্লাই আসবে। চেষ্টা করে দেখা যাক-মনে মনে বলে স্বনন সংক্ষেপে মেসেজ লেখে :
খোগো,
তুমি কোথায় আছো? আমি ব্লাকহোলে আটকে আছি। তুমি যদি আমাকে উদ্ধার করে পৃথিবীতে নিয়ে যেতে পারো তবে আমি বেঁচে যেতাম।
ইতি-স্বনন।
মেসেজটি পাঠানোর পর যন্ত্রটি পকেটে রাখতে রাখতে অশ্রুসিক্ত চোখে স্বনন নিশাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমার বুঝি আর ফেরা হলো না। তোমাদের এখানেই বুঝি সারাজীবন কাটাতে হবে।
-মনখারাপ করছো ক্যারো স্বনন। আমাদেরও বিনোদনের জাায়গা আছে, ওঠো বেড়িয়ে আসি।
সাত
স্বনন ও নিশাই হাঁটতে হাঁটতে একটি পার্কের মতো জায়গায় এসে থামে। স্বননের কাছে মনে হয় এটা কোনো সাফারি পার্ক। বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুগুলো স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর জীবজন্তুর সাথে এদের চেহারার তেমন মিল নেই। তবে বাঘ বা সিংহের মতো দু-একটা প্রাণী দেখা যাচ্ছে।
নিশাই স্বননকে ভিতরে হাত ধরে টেনে নিয়ে বলে, এসো, পশুগুলোকে খাবার দিয়ে আদর করি। ও একটি বাঘের মতো প্রাণীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জীবজন্তুগুলো পৃথিবীর জীবজন্তুর চেয়ে অনেক লম্বা-চওড়া। নিশাই একটি বাঘ জাতীয় ডোরাকাটা প্রাণীর মুখের সামনে একটি ফল ধরে বলে, খাও সোনা, খাও।
স্বনন অদূরে দাঁড়িয়ে নিশাইকে লক্ষ্য করছিল। নিশাই ওকে ডাকতেই চমকে বলে, আরে তোমার ভয় করছে না। দেখে তো মনে হচ্ছে হিং¯্র প্রাণী এগুলো।
নিশাই হেসে ওঠে ওর কথায়। বলে, আমাদের এখানে কোনো হিং¯্র প্রাণী নেই। সবাই নিরীহ প্রাণী। দেখছ না কেউ কাউকে আক্রমণ করছে না। আমরা একে অপরের ক্ষতি করলেও আমাদের প্রাণীগুলো এদিক দিয়ে অনেক ভালো। তারা সবাই এক সাথে মিলেমিশে থাকে।
কথা শুনে প্রথমে স্বনন একটু অবাক হলেও পরে চিন্তা করে পৃথিবীর কোনো বৈশিষ্ট্যের সাথেই তেমন এদের মিল নেই-এটাই স্বাভাবিক। ও এগিয়ে গিয়ে নিশাইয়ের পাশে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে প্রাণীগুলোকে আদর করতে যাবে এমন সময় ইথারযন্ত্রটি বেজে ওঠে।
স্বনন একটু সরে এসে ইথারযন্ত্রটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খোগোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। স্বনন খুশিতে নেচে ওঠে। বলে, খোগো তুমি কেমন আছো? কোথা থেকে কথা বলছো।
-একরূপ আছি। আমি ‘ইউনিভার্সাল’ নামক এক মহাকাশ স্টেশন থেকে কথা বলছি। -তুমি ওখানে কীভাবে গেলে?
-আমাদের নভোযানটি ধ্বংস প্রাপ্ত হলে আমি একটি ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে ভাগ্যক্রমে এই স্টেশনের কাছাকাছি আসলে ওখানকার রোবট বিজ্ঞানীরা চৌম্বকীয় শক্তির বলে আমাকে উদ্ধার করে। পড়ে এখানকার ডাক্তারদের চিকিৎসায় ও বিজ্ঞানীদের সেবায় আমি সেরে উঠি। -আমাকে তুমি এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে?
-হ্যাঁ। এখানে মহাবিশ্বের অনেক অত্যাধুনিক নভোযান এসে নোঙর করে। ব্লাকহোলে যাবার মতো অন্ধকার রশ্মিযুক্ত একটি রূপান্তরিত নভোযানে করে তোমাকে নিয়ে আসবো। -তাই নাকি! কবে, কখন? স্বনন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।
-এই তো কিছু সময় পরেই।
কথা। করে নিশাইকে সব কথা খুলে বলে স্বনন। শুনে নিশাইও খুশি হয়। কিন্ত পরক্ষণেই মনমরা হয়ে বলে, সত্যি তুমি চলে যাবে বন্ধু?
-হ্যাঁ। একটু পরেই খোগো নভোযান নিয়ে আসবে।
-আমাদের কী হবে?
-তোমাদের উদ্ধারের জন্য আমরা উন্নত গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তবে ঈশ্বরকে ডাকো তিনি হয় তো একদিন তোমাদের বিপদ মুক্ত করবেন।
কথা বলতে বলতে স্বনন দেখে- আলোর গতিতে একটি ধোঁয়ার কু-লী এসে স্বননদের অদূরে স্থির হয়। ওখান থেকে একটা স্পেসশিপ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। ভিতর থেকে ক্ষীণদেহী খোগো বেরিয়ে আসে। কাছে আসতেই স্বনন নিশাইকে খোগোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বেশিক্ষণ সময় না নিয়ে স্বনন ও খোগো নিশাইয়ের কাছে থেকে বিদায় নেয়। স্পেসশিপটি আবার ধোঁয়ার কু-লী পাঁকিয়ে আলোর গতিতে উপরে উঠে যায়। নিশাই একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।