পরম উপকারী বন্ধু

কবির কাঞ্চন

0
43

“গাছ আমাদের পরম উপকারী বন্ধু। এই জগতে গাছ ব্যতীত এমন কোনো বন্ধু পাওয়া দুষ্কর হবে; যে নিঃস্বার্থভাবে বন্ধুর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। বিপদে আপদে আমাদের ভরসার উৎস হয়। সেটা হোক আর্থিক, স্বাস্থ্য বা যেকোনো ক্ষেত্রে।”

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন সেলিম হায়দার। তার উদ্দেশ্য একটাই- একমাত্র নাতিকে গাছ বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তোলা।
মীরন আগ্রহী হয়ে বলল,
: দাদু, থামলে কেন? আমার তো ভালোই লাগছিল।
মৃদু হেসে সেলিম হায়দার বললেন,
: সোনা দাদু আমার! তোমাকে শুধু পড়াশোনা করে বড় হলেই চলবে না। বরং একজন আদর্শ মানুষ হতে হবে।
: দাদু, আদর্শ মানুষ আবার কীভাবে হওয়া যায়?
: শোন জন্মিলেই মানুষ হওয়া যায়। কিন্তু আদর্শ মানুষ হতে হলে নিজের মধ্যে আদর্শের গুণাবলি চর্চা করতে হয়।
: আদর্শ গুণাবলি আবার কী, দাদু?
: আদর্শ গুণাবলি হলো এমন সব গুণাবলি যেখানে একজন মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। কখনও অন্য কারো ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো কাজ করে না। জীবনে চলার পথে সৃষ্টিকর্তার আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
: ধন্যবাদ দাদু, এবার বুঝেছি। কিন্তু একটু আগে তুমি একটা কথা বলেছ, গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছ আবার মানুষের বন্ধু হয় কীভাবে? ওরা কী আমাদের সাথে কথা বলতে পারে?
নাতির কথা শুনে সেলিম হায়দার একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
: আচ্ছা দাদু, তুমি না সেদিন বললে তোমাদের ক্লাসে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আছে!
: জি। ও বোবা। কথা বলতে পারে না। কিন্তু খুবই মিশুক। ভালো ছাত্রও। ওকে স্যার-ম্যাডামরা পছন্দ করেন। আমরাও করি।
: কেন করো? ও তো তোমাদের মতো করে কথা বলতে পারে না। কথা বলতে না পারলে কী কেউ আমাদের বন্ধু হতে পারে?
: হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। আমরা ওকে পড়াশোনার বিষয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করি। আবার সেও আমাদের প্রয়োজনে সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করে। ওর বোবা বোবা কথাগুলো আমরা প্রথম প্রথম না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারি।
: তাহলে তোমার কথা শুনে বলতে পারি, বন্ধু হতে কথা বলতে পারাটাই মুখ্য না। পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব এবং ভালো লাগার বিষয়ই আসল।
: জি, দাদু। কিন্তু গাছ কীভাবে আমাদের বন্ধু হতে পারে? আমার মাথায় তা ঢুকছে না।
: আচ্ছা দাদু, বলো তো, আমরা পরিবেশের বায়ুমণ্ডল থেকে প্রতি শ্বাসে কী গ্রহণ করি?
: কেন? অক্সিজেন।
: সেই অক্সিজেন কোথা থেকে আসে তা বলতে পারো?
: হ্যাঁ, পারি। বায়ুমণ্ডল থেকে।
: এবার বলো, বায়ুমণ্ডল তা কোথা থেকে পেয়ে থাকে?

মীরন ডান হাতের তর্জনী মুখ ও নাক বরাবর লম্বালম্বি করে রেখে নাড়তে নাড়তে বলল,
: আমাদের সায়েন্স ক্লাসে জেনেছি, আমরা অক্সিজেন পাই বৃক্ষ থেকে।
: ভেরি গুড! তুমি ঠিকই জেনেছো। আরেকটা বিষয় কী জানো?
: কী বিষয়, দাদু?
: আমরাও কিন্তু তাদের সাহায্য করি। অক্সিজেন গ্রহণের পরই আমরা যে নিঃশ্বাস ছাড়ি তাতে থাকে কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড আবার গাছের খাদ্য তৈরিতে কাজে লাগে। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমরা একে অন্যের সহায়তাকারী। ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
: জি। আচ্ছা দাদু, তুমি আরেকটা কথা বললে, গাছের আর্থিকভাবে সাহায্যের কথা। এটা কী করে সম্ভব হতে পারে?

সেলিম হায়দার একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,
: শোনো দাদু, তোমার মেজো ফুপুর বিয়ের সময় আমার হাতে তেমন টাকা ছিল না। তার উপর তখন তোমার বাবাও ছিল বেকার। ওদিকে বিয়ের দিনতারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। কার কাছে যাব? কী করব? এসব নিয়ে যখন ভেবে কোনো কূল পাচ্ছিলাম না। তখন হঠাৎ মনে হলো, আমার নিজের হাতে রোপণ করা বড় বড় গাছগুলোর কথা। তারপর বেছে বেছে সাতটা গাছ বিক্রি করে দিলাম। গাছ বেচে দিয়ে যে টাকা পেলাম তা দিয়ে ধুমধাম করে তোমার ফুপুর বিয়ে দিয়ে দিলাম। আমাদের বাড়ির পিছনের অংশে এখন বড় বড় যে চৌদ্দটি গাছ দেখতে পাও সেগুলো তোমার ফুপুর বিয়ের ঠিক দুইদিন আগে আমার হাতে রোপন করা। আমি সবসময় মনে করি, প্রয়োজনে গাছ কাটলে কমপক্ষে তার দ্বিগুণ গাছ রোপন করা উচিত।

মীরন আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললো,
: ম্যাজিক! চমৎকার ম্যাজিক!
: ম্যাজিক মানে?
: এটা তো ম্যাজিকের মতো ঘটেছে। তোমার দুঃসময়ে কাউকে যখন পেলে না তখনই গাছগুলো তোমার বন্ধু হয়েছে।

সেলিম হায়দার এবার নাতিকে আদর করে বলতে লাগলেন,
: আরেকটা কথা বলি, শোনো। তোমার বাবা যখন ক্লাস টু তে পড়তো তখন ও খুব সর্দিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। শেষে তুলসী গাছের পাতা খাওয়ালাম। চায়ের সঙ্গে ভিজিয়েও খাওয়ালাম। পাশাপাশি লেবুর শরবতও চলল। মাত্র ক’দিনেই সুস্থ হয়ে গেল। সেই থেকে আমার পাশাপাশি তোমার বাবাও বৃক্ষপ্রেমী হয়ে গেল।

মীরন খুশি হয়ে বলল,
: দাদু, আজ থেকে আমিও তোমাদের দলে যোগ দিলাম।
: ধন্যবাদ, দাদু। একটি পরিবেশে পর্যাপ্ত গাছপালা থাকলে তা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়।
: সেটা আবার কেমন?
: এই যেমন ধরো, আমাদের পৃথিবীতে দিনদিন গাছপালা কমে যাচ্ছে। আমরা কারণে অকারণে তা বিনষ্ট করছি। এতে করে ক্রমশ বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছি। তুমি কি জানো আমাদের দেশের মানুষদের এসব দুর্যোগের ঘনঘটা থেকে বাঁচতে কোন জিনিসটা সাহায্য করছে?

মীরন উপরের দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বলল,
: না, দাদু, আমার মাথায় আসছে না। তবে সৃষ্টিকর্তার কথা বলতে পারি।

সেলিম হায়দার মীরনের মুখের দিকে সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন,
: অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু এখানে একটা কথা তোমাকে না বললেই নয়। আমাদের দেশের বনাঞ্চল বিশেষ করে সুন্দরবন তার বুক পেতে দিয়ে এমন ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে।

মীরন কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো,
: গাছ তো সত্যিই আমাদের পরম উপকারী বন্ধু!