নিতু আমার পুঁচকে ছাত্রীর নাম। সাত বছর বয়স। যা পাকা হয়েছে। মিষ্টি দুষ্টুমিতে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে। ওকে যদি বলা হয়, নিতু এত দুষ্টুমি করো কেন?
ও তখন কি বলে জানেন? বলে, মেধাবীরা একটু দুষ্টুই হয়।
নিতু আসলেই মেধাবী। এ বছরেও ক্লাসে প্রথম হয়েছে। নিতুর আরো কয়েকটি গুণ আছে। এই যেমন, ছবি আঁকা, কবিতা আবৃত্তি করা আর ভয়ঙ্কর সব ধাঁধা ধরা। ভুলেও ওর ধাঁধার ফাঁদে পা দেবেন না। তাহলে আপনাকে গাধা বানিয়ে ছাড়বে। এইতো সেদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসে বলল- স্যার, একটা ধাঁধা ধরি?
আমি বললাম, ধরো।
নিতু ধাঁধা ধরে, বলুনতো, কোন প্রাণী লেজ দিয়ে ভাত খায়?
ওর ধাঁধা শুনে আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মনে মনে ভাবি, পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণী আছে নাকি? মানুষ ভাত খায় বটে, কিন্তু মানুষের তো লেজ নেই। লেজ আছে গরু ছাগলের। সাপের। কই, ওরাতো লেজ দিয়ে ভাত খায় না। অনেক ভাবার পরও যখন কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না, তখন নিতুকে বলি- আমি পারছি না। তুমিই বলো।
নিতু হি হি করে হাসে। আর বলে, এটা পারলেন না স্যার? এটাতো খুবই সহজ। উত্তর হবে মানুষ।
আমি অবাক হয়ে বলি, মানুষ! মানুষ কী করে হয়? মানুষের কি লেজ আছে?
নিতু আবারো হি হি করে হাসে। আর বলে, মানুষের লেজ থাকতে হবে কেন? মানুষ তো মাছের লেজ দিয়ে ভাত খায়।
আজ ২০ জুলাই। নিতুর জন্মদিন। তেমনি হারিয়ে যাওয়ার একবছর। একবছর আগে এক রাক্ষুসী ডাইনি আমাদের নিতুকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে। আরও যে কত অবুঝ শিশুর প্রাণ নিয়েছে ডাইনিটা! সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো আপনারা ভুলেননি নিশ্চয়? রক্তাক্ত জুলাই। কী এক দুর্বিসহ সময় পার করেছে এ দেশ। এত এত রক্ত, এত এত লাশ, এ দেশের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ছোট একটা আন্দোলন, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেশে। পুরো দেশ তখন উত্তাল। সেই উত্তাল তরঙ্গের দু’ফোঁটা ছিলাম আমি আর নিতু।
তখন আমাদের দিনের শুরু ও শেষ হতো মিছিল-মিটিং, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের মাধ্যমে। রাতগুলো ছিল আরও ভয়ঙ্কর। বাসায় থাকতে পারতাম না। বাসায় বাসায় তল্লাশি চলত। যাকে সামনে পেত, তাকেই ধরে নিয়ে লাশ বানিয়ে দিত।
আমি নিতুদের বাসায় থাকতাম। নিতুর বাবা সরকারি চাকরিজীবী। ওনার বাসায় তল্লাশি হতো না।
২০ জুলাই ২০২৪। সকালে নাশতার টেবিলে নিতুর বাবা বললেন, জানো ভাই, আমারও খুব ইচ্ছে করে, তোমাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে। কিন্তু পরিবারের কথা চিন্তা করে আর পারি না। তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও। জয় তোমাদেরই হবে ইনশাআল্লাহ।
আমাদের মাঝে যখন এসব কথা হচ্ছিল, তখন নিতু বলল, আচ্ছা আঙ্কেল! ওরা কি মানুষ না? মানুষ হয়ে মানুষের বুকে এভাবে গুলি করতে পারল? চোখ বন্ধ করলেই আবু সাঈদ ভাইয়ার শহিদ হওয়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে। উফ! কী নির্মম দৃশ্য!
নিতুর সঙ্গে আমার এই-ই শেষ কথা। শেষ দেখা।
রাতে বাসায় ফেরার সময় মনে হলো, নিতুর জন্যে রং-পেন্সিল নিতে হবে। নতুবা ওর আঁকা জুলাই বিপ্লবের ছবিগুলো সাদাকালোই থেকে যাবে। কী দুর্দান্ত সেইসব দৃশ্য! একেকটা ছবি, একেকটা ইতিহাস।
বাসায় পৌঁছাই রাত নয়টায়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। নিতুর আব্বু চিৎকার করে আমার গলা জড়িয়ে ধরেন। বলেন, নিতু আর আমাদের মাঝে নেই!
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যেন। বললাম, নেই মানে?
তিনি জানান, বিকেলে বাসার সামনে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল। নিতু তখন ছাদে ছবি আঁকছিল। এমন সময় একটা কালো হেলিকপ্টার এসে গুলি ছুঁড়তে থাকে। র্যাবের ওই হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া দুটো বুলেট এসে নিতুর বুকে লাগে।
অমন ভারী আঘাত ফুলের মতো নিতু সইতে পারে? আমাদের নিতু সেই যে চোখ বন্ধ করল, আর খুলল না।
নিতু ও কালো হেলিকপ্টার
আমিনুল ইসলাম হুসাইনী



