আসসালামু আলাইকুম বন্ধুরা। মনে করো বাসায় বসে সবাই মিলে গল্প করছো। এমন সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলে বাসার বিভিন্ন জিনিসপত্র অস্বাভাবিকভাবে দুলছে। একইসাথে বুঝতে পারলে যেখানটায় বসে আছ, সেখানটাও স্থির নেই আসলে। এমন সময় মাথায় সবার আগে কী আসবে? ভূমিকম্প! দেখবে ভূমিকম্প বলে চিৎকার দিয়ে সবাই নিরাপদ জায়গার সন্ধানে ছুটে যাচ্ছে। এই তো গত ৬ ফেব্রুয়ারি’২৩ এর কথা। তুরস্ক আর সিরিয়ার এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। আহত হয় প্রায় সোয়া লাখের মতো মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ ছুটে গেছে তাদের সহযোগিতায়। আচ্ছা, এই ভূমিকম্প কেন হয় আসলে? আর কীভাবেই বা ভূমিকম্প হয়? ভূমিকম্প কি শুধু মাটিতে হয়? আরো কথা হলো, এটা কি শুধু পৃথিবীতে হয়? নাকি মঙ্গল বা অন্যান্য গ্রহেও হয়? আর ভূমিকম্প হলে আমাদের করণীয়ই বা কী? বন্ধুরা, বুঝতেই পারছ আজ আমরা এই ভূমিকম্প নিয়েই আলাপ করবো। তাহলে চলো, জানার যাত্রা শুরু করি!
শুরুতে ভূমিকম্প ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করি। ভূমিকম্প মানে যে ভূমির কম্পন বা আমাদের পায়ের নিচের মাটির কম্পনকে বুঝায়, এটা তো বুঝতেই পারছ। সব কম্পন কিন্তু ভূমিকম্প নয়। যেমন ধরো, ট্রেন চললেও কিন্তু তার পাশের ভূমি কাঁপে। আবার মাটির উপর বড়সড় কিছু পড়লেও কিন্তু কাঁপে। এগুলোও কি তাহলে ভূমিকম্প? ব্যাপারটা আসলে তেমন না। সহজ করে বললে কিছু নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারণে ভূপৃষ্ঠের কোনো এলাকার আন্দোলনকে ভূমিকম্প বলে। এটা নিশ্চয়ই তুমি জানো যে, পুরো পৃথিবীতে একসাথে ভূমিকম্প হয় না। বরং একেকবারে নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতে ভূমিকম্প হয়। এটা কীভাবে হয় জানতে চাও? তাহলে শোনো, আমাদের এই (প্রায়) গোলাকার পৃথিবীর ভেতরের অংশ কিন্তু পুরোটা একরকম না। এই যে আমাদের পায়ের নিচেই মাটি, পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত পুরোটাই তো আর মাটি না। তার নিচে অনেক স্তর আছে। আছে শক্ত কিছু জায়গা। তারপর আবার আছে ফুটন্ত লাভার স্তর। এরপর আছে আরো বিভিন্ন স্তর। সে আলোচনা আজকের নয়। এখনকার মতো জানার বিষয় হলো, আমাদের পায়ের নিচের যে স্তর একে বলা হয় ক্রাস্ট। এটি ৫-৭০ কিমি পর্যন্ত পুরু বা মোটা হয়। এর নিচে পুরো পৃথিবী কতগুলো ইয়া বড় বড় পাথুরে খণ্ড দ্বারা বিভক্ত। এগুলোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। প্রায় ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটারের এই পৃথিবী এরকম অজস্র ছোট বড় প্লেটে বিভক্ত। এই প্লেটগুলো একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা খেলে তখন ধাক্কা খাওয়া প্লেটগুলো কেঁপে ওঠে। আর কেঁপে ওটাকেই আমরা ভূমিকম্প নামে চিনি।
তুমি আন্দাজ করতে পারো, পৃথিবীতে প্রতিবছর কতগুলো ভূমিকম্প হয়? ১০০? ২০০? আমেরিকার ন্যাশনাল আর্থকোয়েক ইনফরমেশন সেন্টার বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৫০০,০০০টি ভূমিকম্প হয়, মানে প্রতিদিন প্রায় ১৩৭০টি! হা হয়ে যাওয়ার মতো তথ্য না? কিন্তু কথা হলো, আমরা বছরে মাত্র বড়জোর ১০/১২ বার ভূমিকম্প টের পাই। তাহলে বাকি ভূমিকম্পগুলো কোথায় হয়? ব্যাপার হলো, অধিকাংশ ভূমিকম্প আসলে এত মৃদু হয় যে, আমরা টেরই পাই না।
আগে ভূমিকম্প মাপা হতো প্রধানত শুধু রিখটার স্কেল দিয়ে। এখন মোমেন্ট ম্যাগনিচুড নামের একটি পদ্ধতি এক্ষেত্রে বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। এই স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানেই ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা গ— ৫ – ৫.৯৯ মাঝারি, ৬ – ৬.৯৯ তীব্র, ৭ – ৭.৯৯ ভয়াবহ এবং ৮-এর উপর অত্যন্ত ভয়াবহ।
একটা মজার ব্যাপার বলি। এই যে এত্তগুলো ভূমিকম্প হয় বলে উপরে পড়লে, তার প্রায় ৯০% হয় একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে। এই এলাকাকে বলা হয় রিং অব ফায়ার। এটি প্রশান্ত মহাসাগর ও এর তীরের বেশকিছু এলাকা নিয়ে অবস্থিত। তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়ই, বেশি ভূমিকম্প হলে এর নাম রিং অফ আর্থকোয়েক হতে পারতো, রিং অব ফায়ার কেন? আসলে পৃথিবীর স্থলভাগে সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলোর অধিকাংশ এই এলাকায় অবস্থিত। আগুন থেকেই যেহেতু আগ্নেয়গিরি, তাই এর নাম রিং অব ফায়ার।
এই শতাব্দিতে, মানে ২০০০ সাল থেকে, সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে ২০০৪ সালে। সুমাত্রা দ্বীপের কাছে উৎপত্তি হওয়া ৯.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, ভারত, শ্রীলঙ্কা থেকে আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত। ভূমিকম্প আর তা থেকে সৃষ্ট প্রায় ৩০ মিটার উঁচু সুনামিতে মারা গিয়েছিল ২,২৭,৮৯৮ জন। সুনামি শব্দটা অনেকের কাছে নতুন হতে পারে। মনে করো তুমি কক্সবাজার বা কুয়াকাটায় গিয়ে সাগরপাড়ে মনের সুখে হেঁটে বেড়াচ্ছ। ছোট ছোট ঢেউ এসে তোমার পায়ে আলতো করে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে দূর থেকে এক ইয়া বড় ঢেউ ছুটে আসছে। উঁচু হবে প্রায় ২০ মিটার বা ৬৫ ফুট! এই ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে পাড়ে। শুধু আছড়ে পড়বে? তা তো না। বীচের সবকিছুকে মাড়িয়ে এই ঢেউ আঘাত করে এগিয়ে যাবে শহরের ভবনগুলোসহ সবখানে। তারপর সব লণ্ডভণ্ড করে এগোতে থাকবে যতক্ষণ না তার শক্তি শেষ হয়। কেমন ভীতিকর না ব্যাপারটা? এরকম ঘটনাকেই সুনামি বলে। যাইহোক, আমরা ফিরে যাই ভূমিকম্পের আলোচনায়।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে। ৯.৫ মাত্রার এ ভূমিকম্পে প্রায় ৫,৭০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুমাত্রার ও তার আশেপাশের দেশগুলোর উপর দিয়ে হওয়া ৯.১-৯.৩ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে, যার কথা একটু আগেই পড়লে।
ভূমিকম্পের আলোচনায় তোমরা আফটারশক কথাটা মাঝেমাঝে শুনে বা দেখে থাকবে। ব্যাপারটা বেশ সহজ। কোনো ভূমিকম্প হলে একবার নড়াচড়া হয়েই কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। অনেক সময়ই এর পর আবার কাছাকাছি বা কম মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এগুলোকে আফটার শক বলে। একে একটা সিরিজ হিসেবে নিলে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পারবে। ২০০৪ সালের সেই ভূমিকম্পের পর আফটার শক ছিল প্রায় ৮.৭ মাত্রার। আফটার শকের জন্যেই ভূমিকম্প শেষ হলেও নিরাপদ জায়গায় কিছু সময়ের জন্য অবস্থান করা প্রয়োজন।
ভূমিকম্পের প্রভাবে অনেক বড় বড় ব্যাপার ঘটে যায়। এই যেমন আমাদের দেশের ব্রহ্মপুত্র নদীর কথাই ধরো। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করা এ নদীর মূল প্রবাহ ছিল জামালপুর, ময়মনসিংহ দিয়ে। কিন্তু ১৭৬২ সালের এক ভূমিকম্পে এই বিশাল নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে বর্তমানের সিরাজগঞ্জের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে, যাকে আমরা যমুনা নামে চিনি। ভাবতে পারো, ব্যাপারটা কেমন না? এভাবে ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় কোনো দ্বীপ পানিতে হারিয়ে যায়, আবার কোনো দ্বীপ নতুন করে জেগে ওঠে।
ভূমিকম্প টের পেলে অস্থির বা আতঙ্কিত হয়ে পড়া যাবে না। ভূমিকম্প হচ্ছে টের পেলে বা খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা ও উন্মুক্ত স্থানে আশ্রয় নিবে। উঁচু ভবনে থাকলে এবং বের হতে না পারলে জানালা বা দেয়ালের পাশে অবস্থান না নিয়ে শক্ত কোনো বীম, টেবিলের নিচে অবস্থান নিবে। দ্রুত নামার জন্য ভবন থেকে লাফিয়ে পড়বে না, লিফট ব্যবহার করবে না। গ্যাস এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে দূরে অবস্থান নিবে। কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়বে এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিবে। ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিবে। স্কুলে অবস্থানকালে স্কুল ব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিবে। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিবে। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিবে।
ভূমিকম্প নিয়ে তোমাদের জন্য সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, বড়সড় ভূমিকম্প হলে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য কমে যায়। এই কমে যাওয়া অবশ্য খালি চোখে, মানে আমরা সাধারণ মানুষ ওভাবে বুঝতে পারব না। নাসা বলছে, বড় ভূমিকম্পে পৃথিবীর অক্ষের পরিবর্তন ঘটতে পারে। ২০০৪ সালের সেই ভূমিকম্পের ফলে সেইদিনের দৈর্ঘ্য ৬.৮ মাইক্রোসেকেন্ড কমে গিয়েছিল। ভালো কথা, ১ মাইক্রোসেকেন্ড মানে হলো ১ সেকেন্ডের ১০ লক্ষ ভাগের ১ ভাগ।
পৃথিবীর বাইরে আমাদের একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ, প্রতিবেশি মঙ্গল বা সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, কিংবা মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহে কি ভূমিকম্প হয়? বিজ্ঞানীরা সূর্য, চাঁদ, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহে ভূমিকম্প ট্র্যাক করতে পেরেছেন। এছাড়া পৃথিবী থেকে ৫০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা নক্ষত্র এসজিআর ১৮০৬-২০ এ ২০০৪ সালে সংঘটিত একটি ভূমিকম্পও বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তবে এ ভূমিকম্পগুলোর সাথে পৃথিবীর ভূমিকম্পের মিল-অমিল নিশ্চয়ই আছে। সেগুলো আস্তে আস্তে আরো জানা যাবে।
ভূমিকম্প এমন এক দুর্যোগ, যার কোনো পূর্বাভাস দেয়া যায় না। অনেক সময় অহঙ্কারে মত্ত থাকা মানুষের জন্য ভূমিকম্প যেন এ বার্তাই দেয় যে, মানুষ কত দুর্বল, কত অসহায়! তুরস্কের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেষ করছি আজ। একজন ব্যক্তি জানায়, বাসার মালিক তাকে কয়েকদিন আগে বাসাভাড়া দিতে না পারার কারণে বের করে দেয়। ভূমিকম্পে সেই বাড়িটি ভেঙে যায় আর বাড়ির মালিক সেই ভাড়াটিয়ার সাথে একই তাবুর নিচে আশ্রয় নেয়। আল্লাহ আমাদের অহঙ্কার থেকে মুক্ত রাখুন, মুক্ত রাখুন সকল বিপদাপদ থেকে। তোমাদের সবার জন্য শুভকামনা জানিয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ। ০
প্রকাশকাল: মার্চ, ২০২৩



