১.
কবি আল মাহমুদের নাম শোনেনি, এমন ছেলেমেয়ে ক’জন আছে! আমার মনে হয় শিশুকিশোর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর মনোমুগ্ধকর কবিতাগুলোর কথা নিশ্চয়ই তোমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে। কী অপরূপ সুন্দর ছন্দ আর ছন্দের সাথে মেলানো কথামালা! একবার থেকে দু’বার পড়লেই তা মুখস্থ হয়ে যায়। তাঁর কবিতার শব্দমালা যেন চিরকালের জন্য কানের পর্দায় গেঁথে আছে! আল মাহমুদ সত্যিই কথার জাদুকর। ছন্দেরও জাদুকর।
আল মাহমুদ বড়দের কবিতার পাশাপাশি শিশুকিশোরদের জন্য কালজয়ী সব কবিতা লিখে গেছেন। এরকম একটি শিশুতোষ কবিতা ‘পাখির মতো’। এই কবিতার লাইনগুলো সবার ছোটবেলাকে যেন ছবির মতো মনের অ্যালবামে ধরে রেখেছে-
আম্মা বলেন, পড় রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুলডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
আল মাহমুদের গদ্যে যেমন ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য স্থান পেয়েছে তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভ‚মিও তাঁর গদ্যে জায়গা করে নিয়েছে। আধুনিক বাংলাভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগ তাঁর গদ্যে লক্ষণীয়।
আল মাহমুদের শখ বইপড়া ও ভ্রমণ। পৃথিবীর নানা দেশ ও শহর তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর এই ঘুরে বেড়ানোর সুবাদেই তিনি দেশ-বিদেশের নানা পটভূমিতে গল্প, উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, গোয়েন্দা উপন্যাস রচনা করেছেন।
২.
‘চিরনতুন কিশোর গল্প’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে আল মাহমুদের কিশোর গল্পগুলো। এ গ্রন্থে স্থান পাওয়া ‘একটি ছবি’ গল্পে আল মাহমুদ কী অবলীলায় একটি বুড়ো ভিখিরি ও একজন কিশোরীর ছবি আঁকা নিয়ে অসাধারণ একটি গল্প রচনা করেছেন। গল্পের শেষ লাইনগুলো পড়লেই চোখে পানি চলে আসে।
বুড়ো বলল, ‘আমাকে সাহায্য করো মা। আমি বড়ো অসহায়।’
কিছু বলতে গিয়েও তার মুখ থেকে শব্দ বেরুলো না। শুধু তার সুন্দর ঠোঁটজোড়া কাঁপতে লাগল। কিছু না বলে নাজমা তার পুরস্কারের টাকা বাঁধা রুমালখানা বুড়োর হাতে চেপে দিলো। তারপর মাথা নুইয়ে অপরাধীর মতো রাস্তা পার হতে লাগল। বুড়ো রক্তহীন চোখদুটো মেলে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এই অদ্ভুত মেয়েটির দিকে।
‘একটি পাহাড়ি গল্প’ নামে আল মাহমুদ পাহাড়ি লোককাহিনি লিখেছেন কিন্তু সমতলের পাঠকরাও গল্পটি পড়ে শিহরিত হবে। মিকা আর মিমাই নামক দুটি গোত্রের বিরোধের কাহিনি কী সুন্দর শব্দ বিন্যাসে তিনি লিখেছেন। যা পাঠ করলে আমাদের কিশোর পাঠকরা রোমাঞ্চিত ও শিহরিত হবে।
গল্পের কিছু লাইন সত্যিই কিশোরমনে দাগ কেটে যাবে-
“মিষ্টি ভোরের আলোয় যখন তারা পাহাড়চূড়ার দিকে তাকাল তখনই দেখতে পেল রাতের অন্ধকারে তারা কী মারাত্মক ভুল করে বসেছে। পাহাড়চূড়া থেকে তারা খুব বেশি দূরে ছিল না। ইয়ান তাসেনের তীরবিদ্ধ মৃত-দেহ দুটো চিনতে কষ্ট হলো না জংলিদের। অস্ত্রশস্ত্র হাতে তারা যখন পরস্পরকে আক্রমণ করতে পাহাড়চূড়ায় উঠে এলো তখনই তারা বাধা পেল ইয়ান আর তাসেনের তীরবিদ্ধ মৃতদেহ দুটোয়। তারা আরও দেখল, ইয়ান আর তাসেনের বুকের রক্তের ক্ষীণ ধারা এক হয়ে শুকিয়ে গেছে। আর তাদের রক্তধারা যেখানে মিশেছে ঠিক সেখানেই লাল রক্তের উপর পড়ে রয়েছে একটি গন্ধযুক্ত কস্তুরী। বন্ধুত্বের এই প্রতীক দেখেই মিকা আর মিমাইদের হাত থেকে তীর-ধনুক খসে পড়ল। আসল ভুলটা বুঝতে পেরে মিকা আর মিমাইদের সর্দাররা সেখানে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। এরপর আর কোনোদিন মিকা আর মিমাইরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেনি, এখন সেই পাহাড়চ‚ড়াটা জংলিদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান।
জংলিরা বলে: ‘গভীর রাতে সে পাহাড় চূড়ায় গেলে, একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসের সাথে নাকে এসে লাগে। গন্ধটা নাকি ঠিক কস্তুরীর গন্ধের মতো।’
এছাড়াও উক্ত গ্রন্থে স্থান পেয়েছে আল মাহমুদের, ‘বেপরোয়া’, ‘ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড়’, ‘ক্ষুদে পাখির প্রেরণা’, ‘ফড়িং ধরার গল্প’, ‘নেবু ফুলের গন্ধ’, ‘পশর নদীর গাঙচিল’ নামের কিশোর গল্পগুলো। চিরকালের সেরা এসব গল্প লেখা সম্ভব হয়েছে কারণ তাঁর ভেতর চিরকিশোর জাগরুক।
গল্প ছাড়াও তিনি কিশোর পাঠকদের জন্য রচনা করেছেন ‘মরু মূষিকের উপত্যকা’, ‘ময়নামতির নেকলেস’ নামের দুটো কিশোর উপন্যাস। ‘মরু মূষিকের উপত্যকা’ উপন্যাসটি রচনা করেছেন মিশরের একটি অজানা পিরামিড আবিষ্কার নিয়ে। আর ‘ময়নামতির নেকলেস’ উপন্যাসটি কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড়ি পটভূমিকায় একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের কাহিনিবিন্যাস। দুটো উপন্যাসই পাঠককে টানটান উত্তেজনা এবং কাহিনির পরতে পরতে ধরে রাখবে নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায়।
আল মাহমুদের একটি অসাধারণ কিশোর কবিতা গ্রন্থ ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’। এই গ্রন্থটি বাংলাদেশের সকল শিশু-কিশোরের অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এই বইয়ে অসাধারণ সব কিশোর কবিতা রয়েছে। ‘ভরদুপুরে’ কবিতার প্রথম দুটো লাইন পড়লেই বোঝা যাবে কেন আল মাহমুদ শিশু-কিশোরদের জন্যও অবশ্য পাঠ্য।
মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কী ভাসে!
আল মাহমুদের ‘আকাশ নিয়ে’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন গ্রাম্য ও শহরের দামাল কিশোরদের মনে আলোড়ন তুলবেই।
আকাশটাকে নিয়ে আমার মস্ত বড় খেলা,
মেঘের কোলে ভাসাতে চাই চিলেকোঠার ভেলা।
তবে ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ বইয়ে তাঁর কালজয়ী ‘একুশের কবিতা’টি রয়েছে। একুশ নিয়ে অনেক কবিই কবিতা লিখেছেন কিন্তু কবি আল মাহমুদের এই কবিতাটি যে কত গভীর এবং চিরকালীন তা প্রথম চারটি লাইন পড়লেই বোঝা যায়:
ফেব্রুয়ারি একুশ তারিখ
দুপুরবেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত!
এছাড়াও এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর চিরায়ত চিরসবুজ ‘নোলক’ কবিতাটি।
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
সবশেষে ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ কবিতার লাইনগুলো এখনো বুকের ভেতর দোলা দিয়ে যায়।
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর
ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিল থরথর।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ,
পাথরঘাটার গির্জাটা কি লাল পাথরের ঢেউ?
৩.
বাতাসের মতো, সূর্যের আলোর মতো, আকাশের নিচে পড়ে থাকা শান্ত গ্রাম্য নদীটির মতো সহজকে কি এত অনায়াসে প্রকাশ করা যায়? কিন্তু আল মাহমুদ তার সাহিত্যকর্মে অনায়াসে তা প্রকাশ করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একটি ব্যবসায়ী পরিবারে ১১ জুলাই ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে লেখালেখি শুরু ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্য-সাময়িকীগুলোতে। এ সময় কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, চতুরঙ্গ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস-এ তাঁর লেখা প্রকাশ পেতে থাকে। সমালোচকগণ তাঁকে জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধারার এক নতুন কবিপ্রতিভা বলে উল্লেখ করতে থাকেন। এ সময় ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদ এ দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।
ম্যাথু আর্নল্ড তাঁর সনেটে শেকসপিয়রকে যে লোকোত্তর পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই একই মহিমা আল মাহমুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গল্প, কবিতা, উপন্যাস এবং কিশোরসাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি নিঃসঙ্গ এবং অননুসৃত। প্রখ্যাত পূর্বসুরীদের অনুসরণ করা প্রায় সর্বযুগের কিছু লেখকের প্রিয় অভ্যাস। কিন্তু আল মাহমুদকে কেউ সেভাবে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তাঁর আদলে গদ্য রচনার চেষ্টা করেননি। এর প্রধান কারণ বোধহয়, তাঁকে যথাযথ অনুসরণ করা যায় না। স্নিগ্ধতা এবং স্বচ্ছ উপলব্ধিই আল মাহমুদের রচনার প্রধান গুণ। যখন তিনি কিশোরদের জন্য কলম ধরেছেন, তখনও এই গুণই তাঁকে দেশ ও কালের অতীত শাশ্বত ভূমিতে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে।
ছোটদের জন্য লেখার সময় আল মাহমুদকে ছোটদের মতো হয়ে লিখতে হতো না, আসলে তাঁর ভেতরে একটি চিরকিশোর জাগরুক। চিরকিশোর আল মাহমুদের চোখে অনির্বাণ বিস্ময় আর হাতে প্রকৃতির সুরে বাঁধা বাঁশি। শিশু এবং কিশোরেরা খুব ভালো সমালোচক, কারণ নন্দনকাননের স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি তাদেরই আয়ত্তে থাকে। আল মাহমুদের লেখা পড়তে শুরু করেই তারা সেই অভ্রান্ত বোধের মারফত বুঝতে পারে- তাঁর জাত আলাদা, তাঁর গল্প শোনার জন্য অনায়াসেই একটি আসন টেনে নিয়ে বসে পড়া যায়। তাঁর লেখা কিশোরকবিতা ও চিরনতুন কিশোরগল্পমালা শুধু আমাদের দেশেরই নয় সারা পৃথিবীর শিশুকিশোরদের জন্যও চিরনতুন।
কবি আল মাহমুদকে আমরা যেমন চিনি কবি হিসেবে তেমনি গদ্যসাহিত্যেও তিনি কালোত্তীর্ণ। কিশোর উপন্যাস ও কিশোরগল্পে রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, সাহস ও মানবীয় গুণাবলির বিচিত্র সমাহার একই সাথে জায়গা করে নিয়েছে। কিশোর কবিতাগুলোও আমাদের কিশোর পাঠকদের আনন্দে ভরিয়ে তুলবে। ০