ব্যালন ডি’অর জয় : অতীত ও বর্তমান

ওয়াহিদ আল হাসান

0
181

পাঠকবন্ধুরা, ঢাকাসহ সারাদেশে শীতের আমেজ বিরাজ করছে। তবে তুলনামূলক উত্তরবঙ্গে শীতের প্রকোপটা বরাবরের মতোই একটু বেশি। এই শীতের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলছে খেলাধুলার বিভিন্ন আয়োজন। সেই আয়োজনের মধ্যে বিশ^ ফুটবলের খবর নিয়ে এ মাসের খেলার পাতাটি সাজানো হয়েছে। আশা করি ভালো লাগবে।

ব্যালন ডি’অর : ইধষষড়হ ফ’ঙৎ বা সোনার ফুটবল একটি ফুটবল খেলার পুরস্কার, যা প্রতি বছর ফরাসি ক্রীড়া সাময়িকী ‘ফ্রান্স ফুটবল’ (ঋৎধহপব ঋড়ড়ঃনধষষ) প্রদান করে থাকে। এটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য সবচেয়ে প্রাচীন পুরস্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটিকে সাধারণত ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য সর্বোচ্চ মর্যাদাবান পুরস্কার হিসেবে গণ্য করা হয়।
পুরস্কারটি ১৯৫৬ সাল থেকে প্রদান করা হয়। তবে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব ফুটবল সংস্থা ফিফার সাথে একটি চুক্তি অনুযায়ী এটিকে ফিফা বিশ্বের বর্ষসেরা ফুটবলার পুরস্কারটির (১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত) সাথে সাময়িকভাবে একীভ‚ত করে দেওয়া হয় এবং একীভ‚ত পুরস্কারটির নাম দেওয়া হয় ফিফা ব্যালন ডি’অর। এই অংশীদারিত্ব ২০১৬ সালে সমাপ্ত হওয়ার পর থেকে পুরস্কারটি আবার ‘ব্যালন ডি’অর’ নামে ফেরত যায় এবং ফিফাও নিজস্ব পৃথক একটি পুরস্কার প্রদানে ফেরত যায়, যার নাম দেয় ফিফা সেরা পুরুষ খেলোয়াড়।
ফিফা ব্যালন ডি’অর বিজয়ীদেরকে ফিফা ও ফ্রান্স ফুটবল সাময়িকী উভয়েই বিজয়ী হিসেবে গণ্য করে থাকে। ফরাসি ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল হানোট (এধনৎরবষ ঐধহড়ঃ) এই পুরস্কারটির পরিকল্পনা করেন। পূর্ববর্তী বছরজুড়ে যে পুরুষ খেলোয়াড়টি সবচেয়ে ভালো কৃতিত্ব দেখিয়েছে বলে পরিগণিত হয়, তাকে ব্যালন ডি’অর ফরাসি পুরস্কারটি দেওয়া হতো।
১৯৫৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ফুটবল সাংবাদিকদের ভোটাভুটিতে এটি নির্ধারিত হতো। ২০০৭ সাল থেকে জাতীয় ফুটবল দলসমূহের প্রশিক্ষক ও অধিনায়কদেরকেও ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। আদিতে ব্যালন ডি’অর শুধু ইউরোপীয় ফুটবল খেলোয়াড়দেরকে প্রদান করা হতো এবং এটি সেসময় বর্ষসেরা ইউরোপীয় ফুটবলার পুরস্কার হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৯৯৫ সাল থেকে ইউরোপীয় ক্লাবে সক্রিয় যেকোনো জাতীয়তার খেলোয়াড়কে এই পুরস্কারের আওতায় আনা হয়। ২০০৭ সালে সমগ্র বিশ্বের সমস্ত পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়কে এই পুরস্কারের আওতায় আনা হলে এটি একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে পরিণত হয়।

ব্যালন ডি’অর জয়ী বিভিন্ন খেলোয়াড় ও দেশের তালিকা : ব্যালন ডি’অর কে কতবার পেয়েছেন? বর্তমান সময়ে ফুটবলপ্রেমীদের অন্যতম প্রশ্ন হতে পারে এটি। সেই ১৯৫৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলার লিওনেল মেসি। মেসি ২০২১ সহ মোট সাতবার ব্যালন ডি’অর জয়লাভ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে এই পুরস্কার জয়ের দিক দিয়ে মেসির ঠিক নিচেই অবস্থান করছে পর্তুগিজ উইঙ্গার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি ব্যালন ডি’অর জয়লাভ করেছেন। তিনবার করে পান মিশেল প্লাতিনি, ইয়োহান ক্রুয়েফ ও মার্কো ভ্যান বাস্তেন। তারা তিনজনই নেদারল্যান্ডসের ফুটবলার ছিলেন। এছাড়া দুবার করে ব্যালন ডি’অর জেতেন বেকেনবাওয়ার (জার্মানি), আলফ্রেডো ডি স্টিফানো (স্পেন) এবং রোনালদো (ব্রাজিল)।
এদিকে দেশ হিসেবে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১৯টি দেশের খেলোয়াড়রা জিতেছে ব্যালন ডি’অর পুরস্কার। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ বার করে ব্যালেন ডি’অর জিতেছে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা। আর ৬ বার ব্যালন ডি’অর জিতেছে ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা। এছাড়া ৫ বার করে ব্যালেন ডি’অর জিতেছে পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ও ব্রাজিলের ফুটবলাররা। নি¤েœ ব্যালন ডি’অর বিজয়ী খেলোয়াড় ও দেশের তালিকা দেয়া হলো :

১৯৫৬Ñ২০০৯ সাল : ১৯৫৬ : স্ট্যানলি ম্যাথিউস (ইংল্যান্ড); ১৯৫৭ : আলফ্রেডো ডি স্টিফানো (স্পেন); ১৯৫৮ : রেমন্ড কোপা (ফ্রান্স); ১৯৫৯ : আলফ্রেডো ডি স্টিফানো (স্পেন); ১৯৬০ : লুইস সুয়ারেজ (স্পেন); ১৯৬১ : ওমর সিভোরি (ইতালি); ১৯৬২ : জোসেফ মাসোপুস্ট (চেকোশ্লোভাকিয়া); ১৯৬৩ : লেভ ইয়াচিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন); ১৯৬৪ : ডেনিস ল (স্কটল্যান্ড); ১৯৬৫ : ইউসেবিও (পর্তুগাল); ১৯৬৬ : ববি চার্লটন (ইংল্যান্ড); ১৯৬৭ : ফ্লোরিয়ান অ্যালবার্ট (হাঙ্গেরি); ১৯৬৮ : জর্জ বেস্ট (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড); ১৯৬৯ : গিয়ানি রিভেরা (ইতালি); ১৯৭০ : জার্ড মুলার (পশ্চিম জার্মানি); ১৯৭১ : ইয়োহান ক্রুইফ (নেদারল্যান্ডস); ১৯৭২: ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ার (পশ্চিম জার্মানি); ১৯৭৩ : ইয়োহান ক্রুইফ (নেদারল্যান্ডস); ১৯৭৪ : ইয়োহান ক্রুইফ (নেদারল্যান্ডস); ১৯৭৫ : ওলেগ বেøাকহাইন (সোভিয়েত ইউনিয়ন); ১৯৭৬: ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ার (পশ্চিম জার্মানি); ১৯৭৭ : অ্যালান সিমোনসেন (ডেনমার্ক); ১৯৭৮ : কেভিন কিগান (ইংল্যান্ড); ১৯৭৯ : কেভিন কিগান (ইংল্যান্ড); ১৯৮০ : কার্ল-হেইঞ্জ রুমিনিগে (পশ্চিম জার্মানি); ১৯৮১ : কার্ল-হেইঞ্জ রুমিনিগে (জার্মানি); ১৯৮২ : পাওলো রসি (ইতালি); ১৯৮৩ : মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স); ১৯৮৪ : মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স); ১৯৮৫ : মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স); ১৯৮৬ : ইগোর বেলানোভ (সোভিয়েত ইউনিয়ন); ১৯৮৭ : রুড গুলিত (নেদারল্যান্ডস); ১৯৮৮ : মার্কো ভ্যান বাস্তেন (নেদারল্যান্ডস); ১৯৮৯ : মার্কো ভ্যান বাস্তেন (নেদারল্যান্ডস); ১৯৯০ : লোথার ম্যাথিউস (জার্মানি); ১৯৯১ : জিন-পিয়েরে পাপিন (ফ্রান্স); ১৯৯২ : মার্কো ভ্যান বাস্তেন (নেদারল্যান্ডস); ১৯৯৩ : রবার্তো ব্যাজিও (ইতালি); ১৯৯৪ : রিস্টো স্টোইকোভ (বুলগেরিয়া); ১৯৯৫ : জর্জ ওয়েহ (লাইবেরিয়া); ১৯৯৬ : ম্যাথিয়াস সামির (জার্মানি); ১৯৯৭ : রোনালদো (ব্রাজিল); ১৯৯৮ : জিনেদিন জিদান (ফ্রান্স); ১৯৯৯ : রিভালদো (ব্রাজিল); ২০০০ : লুইস ফিগো (পর্তুগাল); ২০০১ : মাইকেল ওয়েন (ইংল্যান্ড); ২০০২ : রোনালদো (ব্রাজিল); ২০০৩ : পাভেল নেদভেদ (চেক প্রজাতন্ত্র); ২০০৪ : আন্দ্রেই শেভচেনকো (ইউক্রেন)। ২০০৫ : রোনালদিনহো (ব্রাজিল); ২০০৬ : ফ্যাবিও ক্যানাভারো (ইতালি); ২০০৭ : কাকা (ব্রাজিল); ২০০৮ : ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল); ২০০৯ : লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)।

২০১০Ñ২০১৫ সাল : ২০১০ : লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা); ২০১১ : লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা); ২০১২ : লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা); ২০১৩ : ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল); ২০১৪ : ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল); ২০১৫ : লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)।
২০১৬Ñবর্তমান : ২০১৬ : ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল); ২০১৭ : ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল); ২০১৮ : লুকা মদ্রিচ (ক্রোয়েশিয়া); ২০১৯ : লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা); ২০২০ : ঈঙঠওউ-১৯ মহামারির কারণে বাতিল হয়েছে।
উল্লেখ্য, সকল অপেক্ষার অবসান করে সবাইকে পিছনে ফেলে ২০২১ সালের ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জিতে নেন আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গত ২৯ নভেম্বর ’২১ সোমবার দিবাগত রাতে জমকালো অনুষ্ঠানে মাধ্যমে মেসির হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। আর এবার লিওনেল মেসির হাতে ব্যালন ডি’অর তুলে দেন বার্সেলোনার প্রাক্তন সতীর্থ লুইস সুয়ারেজ। অবশ্য আগেও (২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫ এবং ২০১৯) সর্বোচ্চ ৬ বার ব্যালন ডি’অর জয়ের মালিক ছিলেন মেসি। এবার সেই সংখ্যাটিকে আরো উঁচুতে নিয়ে গেলেন পিএসজি সুপারস্টার।
ব্যালন ডি’অরের সংক্ষিপ্ত পাঁচজনের তালিকায় মেসির সঙ্গে ছিলেন রবার্তো লেভানদোভস্কি, জর্জিনিও, করিম বেনজেমা ও এনগোলো কন্তে। এই পাঁচ খেলোয়াড়ের মধ্যে সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে পুরস্কারটি জেতেন মেসি। দ্বিতীয় হয়েছেন বায়ার্ন মিউনিখের পোলিশ স্ট্রাইকার লেভানদোভস্কি। তৃতীয় হয়েছেন চেলসির ইতালিয়ান মিডফিল্ডার জর্জিনিও।

ক্লাব ফুটবলে মৌসুমটা বার্সেলোনার ভালো না কাটলেও মেসি নিজে ছিলেন উজ্জ্বল। লা লিগায় সর্বোচ্চ ৩০ গোল করে রেকর্ড অষ্টমবারের মতো পিচিচি ট্রফি জিতে নেন তিনি। এরপর গত আগস্টে ২১ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছেন পিএসজিতে। সেখানে গিয়ে অবশ্য এখনো নিজেকে ঠিকঠাক মেলে ধরতে পারেননি।
জাতীয় দলেও মেসি ছিলেন এবার অনন্য। আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের ২৮ বছরের শিরোপার খরা কাটালেন তিনি। তার অধীনেই লম্বা সময় অপেক্ষার পর কোপা আমেরিকার শিরোপা ঘরে তুলেছে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দিয়ে আরেকবার ব্যালন ডি’অরের মর্যাদা অর্জন করলেন মেসি।

পুরস্কার পেয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে মেসি বলেন, ‘এখানে আবার আসতে পারাটা অবিশ্বাস্য। দুই বছর আগেও ভেবেছিলাম এবারই শেষ। কোপা আমেরিকা জয়ই চাবিকাঠি।’
এদিকে নারী ফুটবলে এবছর ব্যালন ডি’অর জিতেছেন আলেকজিয়া পুতেয়াস। গত মৌসুমটা বার্সেলোনার হয়ে দারুণ খেলেছেন তিনি। তাইতো পুরস্কারও উঠল তারই হাতে।