দাদাভাইয়ের ঈদ আসর

মাহবুবুল হক

0
74

‘বর্ষার ঝরঝর
সারাদিন ঝরছে,
মাঠ-ঘাট থৈ থৈ
খাল বিল ভরছে।’

আমিরার কাব্যচর্চা শুনে আরিজ ভাইয়া চিৎকার করে ওঠে-
খুব তো ছড়া কাটছো, আজ যে শুক্রবার মনে আছে? একটু পরতো মিলন ভাইয়া, শাহিন ভাইয়া, নিজাম ভাইয়া, গোফরান ভাইয়া, ইব্রাহিম ভাইয়া, রোমান ভাইয়া আসবে। সে কথা কি মনে আছে?
– মনে আছে, মনে আছে আমার সব মনে আছে। তুমি কিচ্ছুই জানো না। আজকে বাইরে থেকে
আসবে মাত্র চার জন। এরপর আমি, তুমি আর দাদাভাই থাকবে। তাহলে কয়জন হলো বলতো?
ওরা দুজনেই ইংরেজিতে শুরু করে-
‘‘১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭’’

– জানো না এখন ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্স’ চলছে? ৩ ফুট দূরে দূরে বসতে হবে। চেয়ারগুলো নতুন, ফাঁক
ফাঁক করে সাজাতে হবে’’।

আরিজ রাগত স্বরে বলছে-
– সবতো তুমি একাই জানো, অন্য কেউ আর তো কিছু জানে না। তাহলে আবার ছড়া কাটছো কেন? দশটা বাজতে তো আর মাত্র পনের মিনিট বাকি।

আমিরা হে হে করে হেসে বলল, মিলন ভাইয়া তো আসতে পারবে না। সে তো থাকে রূপনগরে।
জেবু দাদির বাসার পাশে। আসবে মাত্র তিন জন। আর যা বৃষ্টি! সবাই একটু দেরি করবেই।
হে-হে-হে-হে।

আরিজ বলে, একটা বিষয় তুমি বলতে পারনি। বলতো সেটা কি?

আমিরা মাথা চুলকায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা দাঁতগুলো কেলিয়ে বলে,
হুম, আমি তো কিছু বুজতে পারছি না।
– পারবে কি করে? খালি তো গান গাবে আর ছড়া কাটবে। এই তো কিছুক্ষণ আগেও ছড়া কাটছিলে-
‘আয় বৃষ্টি ঝেপে,
ধান দেবো মেপে’।
তোমার কি ধান আছে? তুমি ধান দেখেছো? ধান চেনো?
আমিরার চোখ, মুখ লাল হয়ে যায়। আসলেই তো সে ধান চেনে না। খুব লজ্জা পায় সে।

আরিজ হাসতে হাসতে বলে, তাহলে এই যে ছড়ার মাধ্যমে তুমি মিথ্যে কথা বলছো, তুমি বলাতেই তো ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি
এলো। এখন ধান দাও’।
আমিরা চুপ করে থাকে।
আরিজ বলে, সেদিন দাদাভাই বলেছিলেন না, খালি কলসি বাজে বেশি। জরপব চেনো জরপব?
এবার আমিরা হে হে করে হেসে ওঠে।
– জরপব চিনবোনা কেনো, প্রতিদিন দু’বার করে জরপব খাই।
আরিজ বলে ওঠে, বোকা, তুমিতো একটা আস্ত বোকা। আরে বোকা চধফফু থেকেই তো জরপব হয়। অনেক দিন আগে আমরা নানুর বাড়ি বিক্রমপুরে গিয়েছিলাম না? তখন তো আমরা চধফফু ঋরবষফ দেখেছিলাম। খোসাসহ জরপব হলো চধফফু। খোসা বাদ দিলেই হয় জরপব বেরিয়ে আসে।

আমিরা হে হে করে হেসে বলে, ও বুঝেছি বুঝেছি। প্যাকেজিংসহ জরপব হলো চধফফু, আর প্যাকেজিং ছাড়া জরপব হলো জরপব। আর জরপব এর বাংলা হলো চাল।

বৃষ্টি একটু থেমেছে। ওরা ভাইবোন মিলে ড্রয়িং রুমটা সাজাতে যায়। জানালাগুলো বন্ধ করে এসি ছেড়ে দেয়। ছ’টা চেয়ার দূরে দূরে সাজায়। স্যানিটাইজারের ছোট ছোট শিশিগুলো টেবিলের ওপর রাখে। ব্লিচিং পাউডারের পানি দরজার বাইরে রাখে। ‘দয়া করে জুতাগুলো বাইরে রাখুন’-ছোট সাইনবোর্ডটি ঝেড়ে মুছে আবার সুন্দর করে বাইরের দরজায় ঝুলিয়ে দেয়। আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি।

এর মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় দিয়ে আসে মিজান ভাইয়া, শাহিন
ভাইয়া আর ইব্রাহিম ভাইয়া। দরজা খুলতেই ওরা একে অপরকে ঐঁমমরহম করতে এগিয়ে যায়।

আমিরা চিৎকার করে বলে ওঠে, ভাইয়ারা, ঐঁমমরহম করা যাবে না আবার ঐধহফংযধশব ও করা যাবে না।
দূরে দূরে বসতে হবে।
আমিরা সবাইকে আস্সালামু আলাইকুম বলে।

সবাই বলে, আমরা তো অনেক আগেই তোমাকে সালাম দিয়েছি। তুমিতো আমাদের সালামের জবাব দাওনি। আমরাতো তোমার ওপর খুব রেগে আছি’’।

– আমার ওপর রেগে কি লাভ হবে, আমিতো ছোট মানুষ। ছোট মানুষের ওপর কেউ রাগ হয়?
জানো না সেদিন দাদাভাই কি বলেছেন? বলেছেন- যারা ছোটদের ভালোবাসে না, তারা ভালো মুসলিম নয়। হে-হে-হে, তোমাদের মুসলিম থেকে নাম কাটা যাবে। তখন আর আমাদের আসরে আসতে
পারবা না।
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
শাহিন ভাইয়া বলে, আমাদের বুড়িআপুটা সুন্দর সুন্দর কথা বলে।
– আচ্ছা ভাইয়া, তুমি যেন কি বলতে চেয়েছিলে? তারপর আবার সব ভুলে গেলে।
সে আরিজ ভাইয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আরিজ ভাইয়া বলে, হুম, আমিতো ভুলতেই বসেছিলাম। আমরাতো আজ মসজিদে যাবো না।
এখানেই জুম্মার নামাজ পড়বো।

এরই মধ্যে দাদাভাই পাঞ্জাবি, পাজামা ও টুপি পড়ে আসরে হাজির হয়ে যান। সবাই ওঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানায়। সালামের জবাব দিয়ে বলেন, দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। তোমরা যার যার জায়গায় বসো।

এরপর তিনি সবার খোঁজখবর নেন। কারা কারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং কারা
ইতোমধ্যে ভালো হয়েছে তাদের সবার খোঁজ-খবর নেন এবং বলেন, এসো আমরা করোনায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য দোয়া করি। সবার জন্য দোয়া করা হলো। ফুলকুঁড়ি আসরের ভাইয়াদের জন্যও দোয়া করা হলো।

তিনি বললেন, ইব্রাহিম ভাইয়া, তুমি কুরবানির গল্পটা আমাদের একটু শোনাও তো।
ইব্রাহিম ভাইয়া খুব সুন্দর করে কুরবানির গল্পটা শুনালেন।
দাদাভাই শাহিন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা শাহিন ভাইয়া, তুমি বলোতো হাজেরা বিবির আসল নামটা কি?
শাহিন ভাইয়া বললেন, হাজর।
দাদাভাই বললেন, মিজান ভাইয়া, তুমি বলতো এই করোনা মহামারীর মধ্যে আমরা কোরবানির
ঈদটা কি করে করতে পারি, কীভাবে করতে পারি?

মিজান ভাইয়া বললেন, এবার তো যেখানে সেখানে গরু, ছাগলের হাট বসছে না। যেখানে গরু-ছাগলের হাট বসানো হচ্ছে, সেখানে গরু-ছাগলগুলোকে দূর দূর অবস্থানে রাখা হচ্ছে। যাতে মানুষের সাথে মানুষের দুরত্ব বজায় থাকে। তাছাড়া অনলাইনে গরু, ছাগল ও ভেড়া বিক্রি হচ্ছে। এমনও ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে যে, কুরবানি হবে খামারে। গোশতগুলো প্যাকেট করে যার যার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে। এরমধ্যে আলেমরাও বলেছেন, যাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব হয়েছে, এবার তারাই যেন শুধু
কুরবানি দেয়। যাদের হাতে টাকা পয়সা নেই, তারা যেন ঋণ করে কুরবানি না দেয়। বর্তমান
আর্থিক পরিস্থিতি ও আলেমদের আহ্বানের কারণে মনে হয় কুরবানির সংখ্যা কিছুটা কম হবে।
আমরা যখন সৌদি আরবে ছিলাম, তখন আমরা কুরবানির দৃশ্য দেখতে পাইনি। কুরবানি দেয়ার
জায়গাই ছিল আলাদা। আমরা শুধু সেখানে টাকা পৌঁছে দিয়েছি। বাকি কাজটা ওরাই করে দিয়েছে।
এতে পরিবেশ সুস্থ ও সুন্দর থাকে। সিরিয়ালি সবার কুরবানি বিকেলের মধ্যেই হয়ে যায়।

দাদাভাই, আরিজ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কুরবানিকে কেন্দ্র করে কী পরিকল্পনা
নিয়েছো?

আরিজ বলে, সেটা তো আমার চেয়ে তুমিই ভালো জানো। তোমার নির্দেশেই তো সবকিছু হচ্ছে।
তুমিইতো বাবাকে বলে দিলে গ্রামে যে গরু-ছাগল জবেহ হবে তার গোশত ঢাকা শহরে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রামে যারা এবার কুরবানি দিতে পারছে না, তাদের প্রতি ঘরে ঘরে কুরবানির গোশত পৌঁছাতে হবে। গ্রামে সবার গোশত একত্র করে (গরীবদের জন্য বরাদ্দকৃত) সেই গোশত সবার কাছে
পৌঁছাতে হবে। শহর ও গ্রামের ধনী ব্যবসায়ীরা এবার বেশি করে কুরবানি দিবেন বলে আশা করা যায়।

আমিরা বলল, এবার আমরা ঠিক করেছি এই ঈদে আমরা নতুন কোনো জামা কাপড় কিনবো না বা পরবো না। সেই টাকাটা আমরা গরীবদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেবো। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আমরা বেশি ত্যাগ স্বীকার করবো।
দাদাভাই বললেন, এবার আমরা বেশি করে আল্লাহমুখী হবো। আল্লাহর রাসূল সা: যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে কুরবানির ঈদটি প্রতিপালন করবো ইনশাল্লাহ।

আরিজ ও আমিরা নাশতা নিয়ে আসে। ঠাকুরগাঁয়ের মিষ্টি, আম ও কাঁঠাল। সবাই সরস আলাপে মেতে ওঠে।