খুুদে পাঠক, খুদে লেখক

ওবায়দুল মুন্সী

0
98

কাব্য ক্লাস ফাইভে পড়ে।
ক্লাসশেষে প্রতিদিন গ্রন্থাগারে কিছু সময় বইপাঠে কাটায়। এটা তার নিয়মিত রুটিন। বিকেলবেলা বাড়ির বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে, সন্ধ্যা হবার আগেই ঘরে ফিরে আসে। ক্লাসের পড়া শেষে, সাড়ে নয়টায় রাতের খাবার খায় তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। হাত-মুখ ধুয়ে আবার কিছু সময় পাঠে মনোযোগী হয়। গোসল করে নাশতা সেরে আবার স্কুলে চলে যায়।
গ্রামীণ পরিবেশে বড় হলেও কাব্যর ভেতরে পরিচ্ছন্নতা রয়েছে। সে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। হাওরাঞ্চলের অজপাড়াগাঁয়ের এই শিশুটি অন্য সব শিশুর থেকে একটু আলাদা বটে! ক্লাসের ফার্স্ট বয় সে। খেলাধুলা, গান গাওয়া এবং কবিতা পাঠেও সবসময় প্রথম স্থান লাভ করে।
স্কুলের নিজস্ব লাইব্রেরিতে বসে শিশুতোষ গল্প,ছড়া-কবিতার বই পড়ে। পড়তে পড়তে প্রায় চিন্তা করত যে এসব যারা লিখেছেন, তাঁরা তো আমার মতোই মানুষ! তাহলে আমি পারি না কেন? সেই থেকে কী যেন ভাবে! আর হারিয়ে যায় ভাবনার ইন্দ্রজালে।
একদিন তার স্কুলের ম্যাডাম মুক্তা খানম ক্লাসে পড়াতে এসে সবার উদ্দেশে বললেনÑ ফেব্রæয়ারি ২১ তারিখে আমি ছড়ার বই বের করছি, তোমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে বই তুলে দেবো। বই পাঠ করে সবাইকে একটা করে ছড়া বলতে হবে, কি পারবে না? সবাই বললÑ জি ম্যাডাম পারবো।

ক্লাস ছুটির পরে, কাব্য মুক্তা ম্যাডামের কাছে গিয়ে সাহস করে বলল- ম্যাম, যদি আপনার বইয়ে আমি একটা ছড়া দিতে চাই সেটা ছাপাবেন? ম্যাডাম কাব্যের মাথায় হাতবুলিয়ে বললেন, কেন ছাপাবো না?
কাব্য খুশি হয়ে বলল, শুক্রবার যেহেতু ছুটি আছে শনিবার লিখে দিচ্ছি ম্যাডাম। ম্যাডামও খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে।
এই দিন সবাই চলে গেলেও সে লাইব্রেরিতে থেকে যায়। কয়েকজন বিখ্যাত কবিদের ছড়ার বই পড়তে থাকে।
আর ভাবতে থাকে সে কী লিখবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই মাথায় এসে যায় একটা কিছু! সে লিখে নেয় খাতার পাতায় এভাবেÑ

ইচ্ছে করে
কাব্য শুভ
ইচ্ছে করে স্বপ্ন দেখি
হোক না সাদা-কালো!
চারিদিকে স্বপ্ন দিয়ে
ভরে দিতে আলো।
ইচ্ছে করে ডানা মেলে
ওই আকাশে উড়ি
ছন্দ-সুতোয় বানাই নাটাই
নানান জাতের ঘুড়ি!
ইচ্ছে করে হতাম যদি
ফুল-পাখিদের মতো
সুবাস-গানে ডেকে যেতাম
আছে মানুষ যতো!
ইচ্ছে করে, ইচ্ছেগুলো
নিত্য পূরণ করি
ইচ্ছেমতো ইচ্ছে যত
আপন করে ধরি।
শনিবার সকালে ম্যাডামকে যখন নিয়ে দেখালো, তিনি তো অবাক। এতটুকু শিশু এভাবে লিখতে পারে? তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও আরেকবার বললেন, সত্যি করে বলো তো! এটা তুমি লিখেছ?
Ñ জি ম্যাম, সত্যিই এটা আমি লিখেছি।
ম্যাডাম আনন্দে তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, তুমিই পারবে, বাবা। তুমি কি আর এমনি এমনি লাইব্রেরিতে সময় কাটাও! এই বয়সে যে এত ভালো লিখেছ, সেই যুগের বিখ্যাত লেখকরাও পেরেছেন কি না, আমার জানা নেই! কাব্য ম্যাডামের উৎসাহ পেয়ে খুশিমনে ক্লাসে ঢুকে গেল।
ফেব্রæয়ারি মাসের একুশ তারিখ। কাব্যর স্কুল লাইব্রেরি আয়োজিত বইপাঠ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে জেলা শিক্ষা অফিসার এসেছেন। উপস্থাপনা করছেন স্কুলের ম্যাডাম মুক্তা খানম।
তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে থাকেনÑ
আজ একুশে ফেব্রæয়ারি। বাংলাদেশের মানুষের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ অনেকেই। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বছর একুশে ফেব্রæয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন মাননীয় জেলা শিক্ষা অফিসার শেখ একেএম জাকারিয়া স্যার। স্যারের বক্তব্যের পরেই আমরা বিজয়ী বন্ধুদের হাতে মাননীয় স্যারের মাধ্যমে পুরস্কার তুলে দেবো। প্রধান অতিথির বক্তব্যের শেষে, আবারো মাইক্রোফোন হাতে ম্যাডাম বললেন, এবার কথা না বাড়িয়ে সরাসরি চলে যাচ্ছি পুরস্কার ঘোষণায়।
তৃতীয়স্থান, দ্বিতীয়স্থান পুরস্কার নেয়ার পরে বললেনÑ এবার প্রথম পুরস্কার ঘোষণার আগে, আমাদের প্রধান অতিথি মাননীয় স্যারকে অবহিত করতে চাই, আজকের বইপাঠ প্রতিযোগিতায় যে শিশুটি প্রথম হয়েছে সে শুধু আমাদের লাইব্রেরির খুদে পাঠকই নয়! একজন খুদে লেখকও! স্যারের হাতে আমার একটি ছড়ার বই আছে, উক্ত বইয়ের বিশেষ পাতার প্রথম ছড়াটি আজকের প্রথম বিজয়ী কাব্য শুভর লেখা। তাই এই খুুদে লেখক আর খুুদে পাঠকের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন আমাদের শিক্ষা অফিসার মহোদয়।
কাব্য পুরস্কার নিতে এলে হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার পর, প্রধান অতিথি খুশি হয়ে নগদ এক হাজার টাকা উপহার হিসেবে হাতে তুলে দেন এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন।