ইতু ও বায়োনিক থেরাপী

আহমেদ কিবরিয়া

0
127

সারা বাড়ি অন্ধকার। শুধু উপরতলার বড় হলরুম থেকে আলো আসছে। এটা হলরুমের মতো হলেও মূলত বিশাল একটি ল্যাব। বায়োলজি ল্যাব। ভেতরে বিখ্যাত বিজ্ঞানী শফিক চৌধুরী তার বাকি তিন বিজ্ঞানী ও দুইজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টসহ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ব্যস্ত। তারা একটি খরগোশের DNA অনুলিপন (DNA Replication) করবেন আজ। কাজের বুয়া করিমন বিবি সবাইকে কফি আর টোস্ট দিয়ে গেলো। ড. শফিক চৌধুরী কাজ শুরু করার আগে তার সহকর্মীদের আবার মনে করিয়ে দিতে শুরু করলেন, আমার প্রিয় গবেষক বন্ধুরা, আমরা আজ DNA অনুলিপন করবো, তবে সেটা একটা খরগোশের। আপনারা জানেন, DNA অনুলিপন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় একটি DNA অণু থেকে আরেকটি নতুন DNA অণ তৈরি হয় বা সংশ্লেষিত হয়। DNA অর্ধ-রক্ষণশীল পদ্ধতিতে অনুলিপিত হয়। এই পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন (ঐ) বন্ধন ভেঙে গিয়ে উঘঅ সূত্র দুটি আলাদা হয়ে যায়। তখন কোষের ভেতর ভাসমান নিউক্লিওটাইডগুলো থেকে অ এর সাথে ঞ, ঞ এর সাথে অ, ঈ এর সাথে এ এবং এ এর সাথে ঈ যুক্ত হয়ে সূত্রদুটি তার পরিপূরক (ঈড়সঢ়ষবসবহঃধৎু) নতুন সূত্র তৈরি করে। উঘঅ-এর দুটি সূত্রের ভেতর একটি পুরাতন সূত্র রয়ে যায়, তার সাথে একটি নতুন সূত্র যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ উঘঅ অণুর সৃষ্টি হয়। অর্ধেক পুরাতন এবং অর্ধেক নতুন দিয়ে এই অর্ধ-রক্ষণশীল পদ্ধতি বলে। আজ থেকে অনেক আগে ১৯৫৬ সালে Watson ও Crick এ ধরনের অনুলিপন এর কথা বলেন। আমরাও আজ খরগোশটির DNA অনুলিপন করবো। তাই এই বিষয়গুলো ভালোভাবে জানতে হবে। তাই নয় কি? না মানে আমি কি বেশি কিছু বলে ফেললাম?
সবাই হেসে উত্তর দিলো, না স্যার, আপনি ঠিক বলেছেন।
শফিক সাহেব কফিতে মুখ দিয়ে বিরক্ত হয়ে বুয়াকে ডাকলেন। করিমন বিবি ঘরে এসে বলল, কিছু কইবেন স্যার?
– কফি কে বানিয়েছে? তুমি?
– জি স্যার, ভাবীজান নেই তো, আমি বানাইছি।
– তোমাকে কতবার বলেছি, আমি ব্ল্য­াক কফি খাই না। ব্রাউন কফি নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, কফি ক্রিমার দিও বুঝলে?
– জে আচ্ছা স্যার।
করিমন বিবি কিচেনে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর কফির মগ নিয়ে ফিরে এলো। শফিক সাহেব প্রথমে খরগোশটিকে বিশেষ ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করলেন। সবাই হাতে গ্ল­াভস পরেছেন, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক পরেছেন। খরগোশটির DNA নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষ দ্রবণে রাখলেন। এরপর তারা একটি শামুকের DNA সংগ্রহ করে ওর মধ্যে রাখলেন। এগুলো দ্রবণে ফিল্টারেশন করে টেস্টটিউবে রেখে দিলেন। এক সপ্তাহ রাখার পর ই-কলি ব্যাকটেরিয়াতে সেগুলো ট্রান্সফার করে তারপর একটি বিড়ালের দেহে সংস্থাপন করবেন। আজকের মতো কাজ শেষ করে সবাই ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলে গেলেন ডিনার করতে।
করিমন বিবির মনটা আজ ভালো নেই। থাকার কথাও না। এরকম

দুই
পরিস্থিতিতে কার মন ভালো থাকে? সকাল থেকে ফুলি ঘ্যান ঘ্যান করে বিরক্ত করে রেখেছে। বোবা মেয়ে ফুলি, কথা বলতে পারে না। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর কী যেন চিন্তা করে। করিমন বিবি সেটা খেয়াল করেছেন কয়েকবার। আহা, বাপমরা মেয়ে আমার! এমন পোড়া কপাল, আল্ল­াহ তার জবানটাও কেড়ে নিয়েছেন!! তবুও, করিমন বিবি নিজেকে সান্তনা দেন, হোক সব মালিকের পরীক্ষা। আল্ল­াহ কাকে কখন কেমন রাখবেন সেটা তিনি ভালো বোঝেন। তবুও তার কষ্ট হয়। একটা চাপা কষ্ট। মাঝে মাঝে রাতের বেলা বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। ফুলির ফ্যাল ফ্যাল চাহনি দেখে বড্ড মায়া হয়। হায়রে, কিছু একটা বলতে চায় মেয়েটা, বলতে পারে না তাই এ্যাঁ.. এ্যাঁ… করে হাত, মাথা নাড়িয়ে মায়ের কাছে ভাত খেতে চায়। করিমন বিবি নিজ হাতে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে মেখে খাওয়ান। এক লোকমা দুই লোকমা খাওয়ার পর এ্যাঁ.. এ্যাঁ… করে পানি খেতে চায়। ঢক্ ঢক্ করে এক নিঃশ্বাসে গোটা গ্ল­াস সাবাড় করে। ফুলির বয়স যখন ৬ মাস তখন ট্রাকের চাপায় তার বাপটাও গেলো। আজ প্রায় ৫ বছর হয়ে গেলো, করিমন বিবি এই বস্তিতে ফুলিকে নিয়ে থাকেন। পাশের ফ্ল্যাটের ইতুদের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে যা পান তাই দিয়ে মা-মেয়ের দিন চলে যায়। ফুলির বাবার স্বপ্ন ছিল, শহরে বড় ডাক্তার দেখিয়ে ফুলিকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। লোকে তার কথায় হাসতো। বলতো, বোবা মেয়ে কি আর ভালো হয় নাকি? লোকের কথায় মজিদ মিঞা একটু মন খারাপ করতেন। আহারে, লোকটা মরেই গেলো। মাঝে মাঝে করিমন বিবি মজিদ মিঞাকে স্বপ্নে দেখে। লোকটা কিছু বলতে চায়। তারপর ঘুম ভেঙে যায় করিমনের। করিমন আজ ভীষণ ব্যস্ত। আজ তাড়াতাড়ি ইতুদের বাসায় যেতে হবে। কারণ ড. শফিক চৌধুরীর একমাত্র ছেলে ইতুর জন্মদিন। আজ রাতে ওখানেই থাকবে তারা। তাড়াতাড়ি ফুলিকে সাজিয়ে রওনা দিলো তারা। ৫ মিনিট লাগে ইতুদের বাসায় যেতে। ইতুর বয়স ১৩ বছর। শহরের নামী স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে ইতু। ওর মা কলেজের শিক্ষিকা। আর বাবা শফিক চৌধুরী দেশের নামকরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী। হিউম্যান DNA নিয়ে অনেক গবেষণা করে গোটা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছেন। খুব ভালো মানুষ তারা। করিমন ও ফুলিকে তারা নিজের মতো দেখে। ইতুও ফুলিকে অনেক আদর করে। ইতুদের গোটা বাড়ি বিভিন্ন রঙের আলোয় ঝলমল করছে। বাড়িটা নতুন করে রঙ করা হয়েছে। বিভিন্ন ফুল ও লতাপাতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ইতুর বন্ধুরা এসেছে। দেশের নামকরা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও এসেছেন। তারা ইতুর জন্য অনেক কিছু উপহার এনেছেন। এদিকে গাইডরা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিথিদের আপন আপন আসনে বসতে সাহায্য করছেন। রান্নাঘরে বড়খালামণি মা ও করিমন বিবিকে রান্নায় সাহায্য করছেন। যদিও বাবুর্চিরা ইতোমধ্যেই রান্না শেষ করেছে, তবুও এ বাড়ির রীতি অনুযায়ী বাড়ির বউকে অবশ্যই কিছু রান্না করতে হবে। একদম ট্রপিক্যাল ডিস। কেককাটা পর্ব শেষ হয়ার পর খাওয়াদাওয়া শেষে মেহমানরা চলে গেলো। ফুলিকেও ইতুর মতো নতুন জামা দেয়া হয়েছে। এভাবেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো সেদিনের মতো। পরের দিন, ইতু বাবার সাথে ল্যাবে বসে আছে। আজ ফুলি আসেনি। ইতু তাই বাবার সাথে বসে বসে ল্যাবে কাজ দেখছে। দুজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টসহ কমপক্ষে পাঁচ জন কাজ করে শফিক চৌধুরীর ল্যাবে। বিশাল বায়োনিক ল্যাব। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কেমিক্যালে ভর্তি ল্যাব। তাছাড়া বিভিন্ন জাতের পাখি, খরগোশ, শামুক ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছের DNA এর নমুনা রাখা আছে। বিজ্ঞানীরা বহু আগেই DNA রিকম্বিনেশন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। তবে সেটা উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, মাছ প্রচ- ঠা-ায় বেঁচে থাকতে পারে। আবার শীতকালে ঠা-ায় টমেটোর ফলন কমে যায়। তাই, বিজ্ঞানীরা মাছের যে DNA ঠা-া সহ্য করার জন্য দায়ী সেটা শনাক্ত করে ল্যাবে রিকম্বিনেট করে টমেটোর মধ্যে ট্রান্সফার করেন। ফলে শীতেও টমেটোর প্রচুর ফলন হয়। কাজটি একটু নিখুঁত। এজন্য DNA কাটার বিশেষ কাঁচি রেস্ট্রিকশনস এনজাইম ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে ই-কলি ব্যাকটেরিয়া বাহক হিসেবে কাজ করে। এটা হলো পুরনো গল্প। শফিক চৌধুরী এবার প্রথম মানব দেহে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। ফলে মানুষের অনেক জটিল রোগ নির্মূল হতে পারে এ প্রযুক্তি আবিষ্কার হলে। তাছাড়া দুর্ঘটনায় আঘাত বা অঙ্গহানি হলে আর নকল অঙ্গ নয় বরং বায়োনিক অঙ্গ যা বাস্তব অঙ্গের ৯৫% অনুভূতিসম্পন্ন হাত ও পা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন শফিক চৌধুরী ও জার্মান বিজ্ঞানী ড. সামুয়েল থমসন। ইতু বাবাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা আব্বু ফুলি তো কথা বলতে পারে না। ও বোবা, কিন্তু কেন? বোবারা কি কথা বলতে পারবে না কোনো দিন? তোমরা বিজ্ঞানীরা ওদের কথা কখনও ভাবো?
ইতুর কথা শুনে বাবা কিছুটা বিস্মিত হয়ে জবাব দেন,
– না বাবা, এরকম কোনো চিকিৎসা আজো আবিষ্কার হয়নি। তবে মানুষ কেন বোবা হয় সেটার কারণ এখনো বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন নি।
– জানলে কী হতো? ইতুর প্রশ্ন।
– হুম, জানলে বোবারাও কথা বলতে পারবে।
– আমি জানতে চাই আব্বু।
– তাই বুঝি বাবা, তুমি বড় হও তখন জানতে পারবে। শফিক চৌধুরী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ইতু বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওর রুমে চলে গেলো। সারারাত বিষয়টা নিয়ে ভাবতে থাকে। আচ্ছা, যদি মাছের DNA ট্রান্সফার করে টমেটো তে দিয়ে সমস্যা সমাধান হয় তাহলে যারা কথা বলতে পারে তাদের কণ্ঠনালীর যে DNA কথা বলার কারণ সেটা যদি বোবাদের কণ্ঠনালীতে রিকম্বিনেট করে সংস্থাপন করা হয় তবে তো বোবারাও কথা বলতে পারবে। এটা এক ধরনের সার্জারি যাকে আমরা ‘বায়োনিক থেরাপি’ বলতে পারি। ইউরেকা! পেয়েছি!! আব্বুকে সকালেই বলবো। পরের দিন ইতু নাশতার টেবিলে বিষয়টা নিয়ে আব্বুর সাথে গল্প করে। আব্বু শুনে তো রীতিমতো অবাক।
– হ্যাঁরে ইতু, আমি তো কখনো এভাবে ভাবিনি?
– ভাবোনি এখন ভাবতে হবে। তবে আমরা কীভাবে এ কাজ করবো? মানুষের ওপর এর পরীক্ষা করতে গেলে মানুষেরও তো মৃত্যু হতে পারে?
– হুম, তবে আমরা হোমোসেপিয়েন্স গোত্রের অন্য প্রজাতি যেমন, বানর বা শিম্পাঞ্জির ওপর পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
– এতে কী লাভ হবে আব্বু? মানুষের বিষয়টি বুঝবে কীভাবে?
– শোন ইতু, যেহেতু মানুষ হোমোস্যাপিয়েন্স তাই তার এবহঁং-এর ঝঢ়বপরবং-এর গঠনগত মিল থাকতেই পারে। তাই বলে, আমি মূর্খ বুদ্ধিজীবীদের মতো বলছি না যে, মানুষ বানর থেকে এসেছে? শফিক সাহেব বলেই হেসে ফেললেন।
– হুম, বাবা ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বে কিছু ভুল রয়েছে যেটা আজ আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। তারপরও ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বে যে হিন্টস্গুলো রয়েছে সেগুলো তো মিথ্যা নয়। তবে, অনেকে বলছেন ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বে কিছু ভুল থাকায় অনেকে বিবর্তন বিষয়টিকে ভুল ব্যাখ্যা দেন। বিষয়টি সেরকম নয়। DNA রিকম্বিনেশন প্রযুক্তি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
– হুম, এটাই ঠিক। যা হোক, আমি আগে বিষয়টি নিয়ে ড. সামুয়েল থমসনের সাথে পরামর্শ করি। দাঁড়াও উনাকে টেলিফোন করি। শফিক চৌধুরী প্রায় এক ঘণ্টা টেলিফোনে ড. সামুয়েল থমসনের সাথে কথা বললেন। ড. সামুয়েল শিগগিরই বাংলাদেশে আসবেন। আপাতত জার্মানির মিউনিখে কিছু দিন একটা কাজে ব্যস্ত আছেন। ইতু ফুলির কথা বাবাকে বলল আর বাবাও রাজি হয়ে গেলো। করিমন বিবিকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলায় সে তো খুশিতে কেঁদেই ফেলল। বললো, স্যার, আমার ফুলি ভালো হইয়া যাইবো তো?
– সেটা তো বলতে পারবো না করিমন। তবে আমরা আশা করছি আমরা সফল হবো। আল্ল­াহর কাছে সাহায্য চাও। তিনি চাইলে সব সম্ভব। শফিক সাহেবের কথা শুনে করিমন বিবি মাথা নাড়লো। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সেই-ই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। মায়ের মন বলে কথা।

তিন
এক সপ্তাহ পর ড.সামুয়েল থমসন জার্মানি থেকে বাংলাদেশে এলেন। মিউনিখ বিমানবন্দর থেকে লুফথানসা এয়ারওয়েজের একটি বিশেষ বিমানে তাকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। ইতুদের বাসায় এসে তিনি ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমালেন। রাতে শুরু হলো DNA টেস্ট পরীক্ষা। দুটি বিশেষ বাঁদর আনা হয়েছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে বলেছে, একটি বাঁদর জন্ম থেকে চুপচাপ। মানে শব্দ করতে পারে না। যাকে বোবা বলা যেতে পারে। আরেকটি সুস্থ। ড. সামুয়েল থমসন বাঁদর দুটোর ফিটনেস টেস্ট করে চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ঊষবপঃৎড়-গধমহধঃরাব ঝবহংড়ৎ দ্বারা ইলেকট্রোলাইড করে দেখলেন। স্ক্রিনে টুথ টুথ শব্দ করে DNA ম্যাপ ভেসে উঠলো। DNA১ এ রেড সিগন্যাল। মানে একটি বানরের থাইরয়েড গ্ল­ান্ডস- এর DNA নিষ্ক্রিয়। DNA২ এ সবুজ সিগন্যাল। মানে আরেকটি বানরের থাইরয়েড গ্ল­ান্ডস সক্রিয়। ইলেকট্রোলাইড করার পর বানর দুটিকে জাতীয় DNA রিকম্বিনেশন প্রযুক্তি ও গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানো হলো মাইক্রোসার্জারির জন্য। সেখানেই তারা DNA রিকম্বিনেশন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন যে, বানর দুটোর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? যদি না হয় তবে, হোমোস্যাপিয়েন্স মানে মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানোর ঝুঁকি নেয়া যাবে। শুরু হলো DNA রিকম্বিনেশন সার্জারি। সার্জারির পরও বানর দুটির জ্ঞান ফিরে আসতে সময় লাগায় তাদের লাইফসাপোর্টে পাঠানো হয়েছে। অবশেষে জ্ঞান ফিরে পেলো বানর দুটো। ওদের জুস খেতে দেয়া হলো। রাতে বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানীরা ওদের সাথে বিশেষ কম্পিউটারের সাহায্যে কথা বলবেন। দুজনের ভয়েসের ফিল্টারেশন করে বুঝবেন, এদের টাইপ ঞ-অ এবং অ-ঞ হবে কি না। ঞ/অ হলো একটি আরেকটির পরিপূরক এবং সমান। মানে তখন দুটো বানরই স্বাভাবিক। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গোটা পৃথিবী সরাসরি লাইভে দেখলো, কিভাবে একটি বোবা বানর আরেকটি সুস্থ বানরের DNA ধার নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেলো। বিবিসি, আলজাজিরা, ডিসকভারি, অ্যানিমেল প্ল­ানেট এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সরাসরি সম্প্রচার হলো। গোটা বিশ্বে তোলপাড় উঠলো। বোবা শিশুদের পিতা-মাতারা স্বস্তি ফিরে পেলো। তবে, বিজ্ঞানীরা জানালেনÑ মানুষের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন বিষয়। তবে, তারা এমন দুজন মানুষকে খুঁজচ্ছেন যারা এ ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষায় নিজেদের স্বেচ্ছায় সমর্পণ করতে রাজি হবে। আর, এ চিকিৎসার নাম ইতুর দেয়া নাম ‘বায়োনিক থেরাপি’ হিসেবে পেটেন্ট করে দেয়া হলো। এবং ইতুকে এর আবিষ্কারক ঘোষণা করলো রয়্যাল সোসাইটি ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সমিতি। গত ছয় মাসেও কেউ রাজি হলো না এ পরীক্ষায় অংশ নিতে। ফলে, মানুষের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করা নিয়ে ঝামেলায় পড়লেন বিজ্ঞান মহল। শুরু হলো নতুন গবেষণা।

চার
আজ দুই বছর হয়ে গেলো। আজও ইতু ফুলিকে নিয়ে নানাভাবে কথা বলা শেখানোর চেষ্টা করে। ফুলি শুধু এ্যাঁ.. এ্যাঁ… করে। শফিক চৌধুরী ও তার গবেষক দল চুপ করে নেই। চলছে ‘বায়োনিক থেরাপি’ নিয়ে বিস্তর গবেষণা। ইতুও স্কুলে তার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে কিভাবে কী করা যায়। ইতুর স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে গেলো। মাঝে মাঝে করিমন বিবি স্বপ্নে দেখেন, ফুলির কন্ঠনালীর সার্জারি হচ্ছে। কিন্তু তার আর জ্ঞান ফেরে না। একসময় ফুলি কোমায় চলে গেল। ডাক্তাররা ফুলিকে ক্লিনিক্যালি ডেথ ঘোষণা করলো। করিমন চেঁচিয়ে উঠলো, আল্ল­াহগো!! তারপর ঘুম ভেঙে যায় আর পাশে ফুলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, খোয়াব দেখছি মা রে! থাউক, মাইয়াটা বাঁইচ্চা থাকলেই হইবো!! ফুলি কিছু বুঝতে পারে না। মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সকাল হয়। করিমন প্রতিদিনের মতো কাজে যায়। শফিক চৌধুরীরা তাকে বুঝান, ধৈর্য ধরতে বলেন। ইতুটাও একসময় মনটা খারাপ করে। তবে কি তার স্বপ্ন পূরণ হবে না? নাকি আরেক শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা সফল হবেন? কিন্তু তখন তো আর ইতু থাকবে না, ফুলিও না। তবে, ইতুর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বিজ্ঞান মহলে। আজও ফুলি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চুপচাপ কিছু একটা বলতে চায়। কী সেটা? পৃথিবী কি জানে সে কথা? নাকি ইতু?