মহাকিপটে ও ভিখিরি

হাসান হাফিজ

0
68

বহুদিন আগেকার কথা। এক যে ছিল ভিখিরি। আর ছিল এক মহাকিপটে। অনেক সহায় সম্পত্তি তার। টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই। ভিখিরি লোকটা বেশ বুড়ো। হাড় জিরজিরে শরীর। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া জোটে না। অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। যেদিন ভিক্ষে মেলে না, সেদিন উপোস থাকতে হয়।

অন্য দু’দশ দিনের মতোই লোকটি ভিক্ষে করতে বের হয়েছে। কপাল ভালো হলে কিছু না কিছু জুটবে। আর যদি মন্দ হয়, তাহলে তো কম্ম কাবার। স্রেফ না খেয়েই কাটাতে হবে। আজ কি মিলবে কিছু? নাকি খালি হাতেই ফিরতে হবে? কে জানে! আনমনে এসব কথাই সে ভাবছিল আর পথ চলছিল। দেখাই যাক, কী ঘটে শেষ পর্যন্ত।

হঠাৎই তার চোখ যায় ঝকমকে একটা বাড়ির দিকে। চমৎকার সুন্দর একটা বাড়ি। পাশেই গোলাঘর। দেখেই বোঝা যায় এ বাড়ির মানুষেরা খুবই সুখী। কোনো অভাব অনটন নেই তাদের। এত সুন্দর বাড়ি এই এলাকায় আর নেই। বাড়িটার গেটও ভারি সুন্দর দেখতে। সেখানে ঝুলছে লোহার তালা। ভিখিরি এখানে আগে আর কখনো আসেনি। সে কারণে এই বাড়ি, তার লোকজন সম্পর্কে কিছু জানা নেই। আসলে হয়েছে কী, এই বাড়িটার ভীষণ বদনাম আছে। বাড়ি তো নয়, বাড়ির মানুষ নিয়ে এই বদনাম। বাড়ির মালিক ভীষণ কঞ্জুস ধরনের লোক। হাড়কিপটে যাকে বলে। কিপটেমির জন্য কেউ তাকে পছন্দ করে না। এলাকার লোকজন তার সঙ্গে মেলামেশাও করতে চায় না। সব্বাই জানে, লোকটি ধনী হলে কী হবে, সে কারো কোনো উপকারে লাগে না। গরিব দুঃখী লোকজন কাউকে কখনো সে দুই পাঁচ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে, এমন নজির নেই। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে তাই।

ভিখিরি লোকটা দরজায় কড়া নাড়ে। আজ হয়তো ভালো কিছু পাওয়া যাবে। এত বড় বাড়ি, তার মালিক নিশ্চয়ই বড় মনের মানুষ। তেমনটাই তো হওয়ার কথা। ভিখিরির মনে অনেক আশা। মিনতি করে সে বলে, ‘বাবাগো, মাগো। কে আছো এই বাড়িতে? দয়া করে আমাকে  কিছুমিছু খেতে দাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে। খিদের চোটে আর টিকতে পারছি না। একটু দুধ বা মাংস থাকলে আমাকে দাও। তোমাদের কাছে মিনতি করি।’

কিপটে লোকটা বিরক্ত মুখে দরজা খোলে। ভাবে, সাত সকালে এই আপদ এলো কোত্থেকে? যত্তসব ঝামেলা! এরা কী একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না?

ভিখিরির দিকে চোখ পাকিয়ে সে বলে, ‘জলদি ভাগো এখান থেকে। খাবার দাবার কিছু নেই।’

ভিখিরি এমন কিছু আশা করেনি। সে ভেবেছিল, আজ হয়তো আর কোথাও না গেলেও চলবে। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হাল ছাড়লে তো চলবে না। কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘বাবা গো। আপনার তো কোনো কিছুর কমতি নেই। দুধ বা মাংস না হলেও আমার চলবে। একটু ভাত কিংবা রুটি পেলেও চলবে। পেটের আগুন নেভানো বলে কথা। খিদের জ্বালা সহ্য করা যায় না বাবা। কিছু একটা এনে দাও না, গরিবের দিকে একটু মমতার চোখে তাকাও! দোহাই লাগে।’

কিপটে লোকটা শুরু থেকেই রেগে আছে। রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার। ভিখিরির উল্টাপাল্টা কথা শুনে মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছে। উটকো এই ঝামেলাটা কোত্থেকে যে উদয় হলো! যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, একে বিদায় করতে হবে। নাহলে স্বস্তি-শান্তি নেই। ইশ, কীভাবে যে মুক্তি পাওয়া যাবে! গলা চড়িয়ে সে ভিখিরিকে বলে, ‘না না। কিচ্ছু হবে না বলছি। তোমাকে তো বোঝাতে পারছি না যে, এখানে কোনো সুবিধা হবে না। অন্য কোথাও যাও। সেখানে চেয়েচিন্তে নাও। সরে পড়ো বলছি। একই কথা কয়বার বলবো তোমাকে? আমার বাড়িতে কোনো ভাত বা রুটি নেই। সুতরাং তুমি আসতে পারো।’

শুনে ভিখিরি হতবাক। লোকটা কী বলছে? ওর বাড়িতে কোনো খাবারদাবার নেই? এটা কী কখনো হতে পারে? কেউ বিশ্বাস করবে এই কথা? সে আবারও করুণ কণ্ঠে আরজ করে, ‘একটু পানি হলেও দাও বাবা। খুব তেষ্টা পেয়েছে আমার। একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়ো না। ভিখিরিকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলে গেরস্তের অকল্যাণ হয় বাবা!’

মহাকিপটে লোকটি আরো বিরক্ত হয়। ভাবে, এ দেখছি রীতিমতো উপদেশ দিতে শুরু করেছে। ধমক দিয়ে বলে, ‘পানিও নেই এ বাড়িতে। বলি, কী পেয়েছো তুমি? ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো। নয় তো বিপদে পড়বে। কেন আমাকে এত বিরক্ত করছো বাপু?’

ভিখিরি লোকটা একথা শুনে আরো অবাক হয়। তারও মেজাজ খারাপ হয়। সেটা সামলে নেয় অবশ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির মালিককে বলে, ‘তাই বলো বাবা! তা, কেন তুমি এখানে বসে আছো? উঠে দাঁড়াও। আমার মতো ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ো। যারা ভালো মনের মানুষ, তুমি চাইলে তারা তোমাকে দুধ-মাংস, ভাত-রুটি, পানি- সবই দেবে। তুমি দেখছি আমার চাইতেও বেশি গরিব, একেবারে সর্বহারা। তোমার জন্য তো করুণা হয় বাছা!’