বাবা, মা, বোন আর ভাইয়ের সাথে ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়েছিলো জাবির ইব্রাহিম (৬)। দক্ষিণখানের কে.সি মডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্র জাবিরের ছোট্ট মনে ছিলো দেশপ্রেমের অদম্য বাসনা। উত্তরা স্কলাসস্টিকা স্কুলের উল্টো পাশে আন্দোলনকারীদের সাথে অবস্থান করছিল তারা। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ রাস্তার উত্তর দিক থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি করতে করতে সামনে আসতে থাকে। আতঙ্কে সেখানে অবস্থানকারী ছাত্র-জনতা প্রত্যেকেই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে থাকে। জাবিরকে কোলে নিয়ে বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়াও পুরো পরিবার নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে কিছু দূর এগুতেই জাবিরের পায়ে একটি গুলি লাগে। শিশু জাবিরের রক্তে বাবার পুরো শরীর ভিজে যায়। হাসপাতালে নিতে নিতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শিশুটির মৃত্যু হয়। এক নিমিষেই সব শেষ। বাবার ডান হাতের উপর শহিদ হয় সে। প্রিয় ছোট ভাইকে হারিয়ে বড় ভাই মাহতাব আব্দুল্লাহ (১২) এবং ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া বড় বোন নেহা আজ বাকরুদ্ধ। শিশুটির বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, দেশের জন্য নিজের প্রাণ প্রিয় ছেলেকে উৎসর্গ করেছি। ছেলের প্রাণের বিনিময়ে যদি দেশ আর দেশের মানুষ ভালো থাকে, তবেই আমার এবং আমাদের পরিবারের আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে। সেই সাথে এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান তিনি।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জাবিরের মতো অনেক শিশুকিশোর প্রাণ দিয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আমরা ফিরে পেয়েছি হারানো অধিকার। বছর ঘুরে জুলাই এলো, মনে করিয়ে দিলো তাদের কথা।
সাড়ে ৬ বছর বয়সী রিয়া গোপ মা-বাবার সঙ্গে থাকত নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায়। জুলাইয়ের কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের রেশ নারায়ণগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছিল। চারতলা বাড়ির উপরের তলায় থাকত ওরা। দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিল মেয়েটি। খানিক পরেই রাস্তায় সংঘর্ষ বাঁধে। বাসার সামনে হট্টগোল শুনে বাবা ছুটে যান ছাদ থেকে মেয়েকে ঘরে আনতে। মেয়েকে কোলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় শিশুটির মাথায়। বাবার কোলেই গুলিবিদ্ধ হয় সে। মুহূর্তেই ছোট দেহটি ঢলে পড়ে বাবার কোলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়, গানশট ইনজুরি। শিশুটি দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর এ দম্পতির ঘর আলো করে আসে রিয়া। মর্গ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে স্ট্রেচারে রাখা মেয়ের মুখটি যখন স্বজনদের দেখানো হয়। মুহূর্তেই স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। একটি গুলিতে পুরো পরিবারের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন দীপক কুমার ও তার স্ত্রী। সন্তান হারানোর ব্যথা তাদের সারাক্ষণ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
এক পাশে বাবা, আরেক পাশে মা, মাঝে দাঁড়িয়েছিল ৪ বছর বয়সী ছোট্ট আবদুল আহাদ। বাসার বারান্দায় দাঁড়ানো তিন জোড়া চোখ ছিলো নিচের দিকে তাকিয়ে। বাসার নিচে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছে। আচমকা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে যায় সে। বাবা ভেবেছিলেন ছেলে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ছেলেকে ধরে তুলতে গিয়ে ছেলের সারা শরীর রক্তে ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেখে নিঃস্তব্ধ হয়ে যান বাবা আবুল হাসান। আহাদের চোখ, মুখ, মাথা রক্তে ভেসে যায়। ১৯ জুলাই বিকাল ৪টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার বাড়িটিতে এ ঘটনা ঘটে। বাবা আবুল হাসান রক্তাক্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসেন। আহাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তার পরিবারকে জানান, গুলি মাথার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু কোন অবস্থানে আছে, তা বোঝার জন্য সিটিস্ক্যান করতে হবে। কিন্তু সিটিস্ক্যান করতে নেওয়া হলে আইসিইউর যন্ত্রপাতি সব খুলে ফেলতে হবে। এতে শিশুটির মৃত্যুও হতে পারে। তবে, সিটিস্ক্যান করাও জরুরি। সেদিনই রাত সাড়ে ৮টার দিকে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তারপর অ্যাম্বুলেন্স করে শিশুটির গ্রামের বাড়ি ভাঙার পুখুরিয়া গ্রামে বাদ মাগরিব পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। শিশুটির বাবা আবুল হাসান জানান, বাড়িতে আগে পারিবারিক কবরস্থান ছিল না। আহাদকে দাফনের মধ্য দিয়েই কবরস্থানটির যাত্রা শুরু হলো বলেও জানান তিনি।
ছবি আঁকতে পছন্দ করত নাঈমা সুলতানা (১৫)। সেদিনও আঁকছিল। আঁকতে আঁকতেই মাকে বলছিল, সে পিৎজা বানাবে। এক ফাঁকে মাকে বলল, সে বারান্দায় যাচ্ছে শুকনা কাপড় আনতে। মেয়ের পেছন পেছন মাও যাচ্ছিলেন। নাঈমা বারান্দার দরজাটা খোলামাত্রই গুলিটা এসে তার মাথায় ঢুকে যায়। এভাবেই সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মা আইনুন নাহার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের পাঁচতলা ভবনের চারতলার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয় নাঈমা।
আন্দোলনে অংশ নেয়া কিশোর শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ (১৭) গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে নিহত হয়। মা-বাবাকে সে সব সময় বলত, বড় হয়ে এমন কিছু করবে, যার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে গর্ব করবে। বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের ক্লাস রুমের শূন্য আসনে ফুল রেখে শিক্ষকরা শ্রদ্ধা জানান। জামিল হোসেন ও সামিরা জাহান দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মাহিন (১৬)। ৪ আগস্ট উত্তরার আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে ছররা গুলিতে নিহত হয় সে। অভ্যুত্থানে শহিদ শিশুকিশোরদের মধ্যে মাহিন, আহনাফদের মতো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি।
ইতিহাস :
২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করে, যার ফলে জুলাইয়ের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলন পুনরায় জোরদার হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভের পর, ১৫ জুলাই সংঘর্ষের মাধ্যমে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। পরবর্তী দিনগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যার মধ্যে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি, সেইসাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সাথে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের ফলে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে রয়েছে আন্দোলনকারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, দলীয় সদস্য, পথচারী ও শিশুরাও। জুলাই আন্দোলনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় হাজারের বেশি, এবং আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে মোট ১৩২ শিশুকিশোর শহিদ হয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা অধিকার ফিরে পেয়েছি। তাদের আমরা স্মরণ করবো যুগের পর যুগ। আমরা তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। ০