হাসতে হবে আর কাঁদতে হবে

এ কে এম বদরুদ্দোজা

0
121

শিশুকিশোরদের বিচরণভূমি ছোট হয়ে আসছে। নাগরিক জীবনে এই সংকোচন তীব্র রূপ নিয়েছে। স্কুলভবনে সবুজ মাঠ নেই, নেই এলাকাতেও। মাঠ থাকলেই বা কী হতো। খেলার সময় কই? স্কুল কোচিং পাশাপাশি নাচ গান ড্রয়িং শেখার হজ্জত। বাকি সময়টায় ঝটপট পড়াশোনার পাট চুকিয়ে টিভি কম্পিউটারে বিচরণ। নীলাকাশের নিচে সবান্ধব ফুটবল μিকেটে মেতে ওঠার সুযোগ নেই। দু’দশক আগেও নগরীর শিশুকিশোরদের অপরাহ্নে বিপুল সংখ্যায় পাড়া বা মহল্লার মাঠে হৈ-হুল্লোড় করে খেলাধুলায় মত্ত থাকতে দেখা যেত। এখন তারা ওই সময়টা সোফায় গা এলিয়ে টিভি দেখে, ফেসবুকে ভেসে বেড়ায়। এভাবেই μমশ নরম সোফায় গা এলিয়ে মোটাতাজা হওয়া শিশুরা যথার্থ এই অভিধায় ভূষিত হয়েছে। বাংলাদেশের বড় বড় শহরে পটেটো কাউচের সংখ্যা বাড়ছে। এরা চোখ ভরে নীল আকাশ দেখতে পায় না। মাটির সোঁদা গন্ধ শোকার সুযোগও বিরল। যন্ত্রসভ্যতা আমাদের মনের আনন্দ কেড়ে নিয়ে দিচ্ছে ইন্দ্রীয় সুখ। মানবশিশু পরিণত হচ্ছে মাংসের রোবটে। প্রযুক্তি তাদের দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ। যন্ত্র বয়ে এনেছে গতি তাতে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল আনন্দফুর্তি। হাসিখুশি আনন্দের শৈশব-কৈশোরকে গ্রাস করছে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়ন। পরিবারের মমতার বন্ধনে হানা দিচ্ছে অপয়া বৈরিতা। মায়ার বাঁধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের গ্রন্থিগুলো কেমন জানি অসংবদ্ধ হয়ে নতুন প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতায়। দেশ, মাটি ও মানুষের সাথে শিকড়ের সাথে প্রকারান্তরে নিজস্ব কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সাথে কোন সেতুবন্ধণ তৈরি হচ্ছে না। আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যতের কোনো যাচ্ছে না তাদের মুখাবয়বে। এ বৈরী সময়ে শিশুকিশোরদের দিকে মমতার হাত বাড়াতে হবে। তাদের এনে দাঁড় করাতে হবে নীল আকাশের নিচে। তাদের জড়ো করতে হবে সবুজ ঘাসে শোভিত মাঠে। কাদাপানিতে একাকার হয়ে ফুটবল, হা-ডু-ডু, কাবাডি খেলে তাগড়া তরুণ হয়ে উঠবে তারা। রিমোট টিপে ধ্যানী শিশু স্বাস্থ্যবান শিশু তৈরি করা যাবে না। সে জন্য শিশুদের নির্মল আনন্দের দুয়ার খুলে দিতে হবে। ঘরের কোণে নয়, তা আছে মুক্ত আঙিনায়। তারা চোখ ভরে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখবে, বুক ভরে নেবে নির্মল বাতাস। তারা এদেশের সব নদীর পানিতে অবগাহন করবে। ফসলের ঘ্রাণ মাটির সোঁদাগন্ধে বিমোহিত হবে। নতুন প্রজন্মকে প্রযুক্তির দাস হতে দেওয়া যায় না। তাই বলে তারা প্রযুক্তিবিমুখও হবে না। প্রযুক্তি হবে জ্ঞান আহরণের বাহন। এমনকি আনন্দ বিনোদনের। সোফায় বসে টিভি দেখে ফেসবুকে আবগাহন করে অগণিত পটেটো কাউচ তৈরির ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না। শিক্ষা বিনোদনের জন্য সীমিত আকারে প্রযুক্তি বাঞ্ছনীয়। এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু রাত জেগে কম্পিউটারে ব্রাউজিং করে ঘুম জড়ানো চোখে আমাদের নতুন প্রজন্ম স্কুল কলেজে গিয়ে কতটা ধ্যানী আর জ্ঞানী হবে সেটা গভীর ভাবনার বিষয়। এই প্রজন্মকে আমাদের বোঝাতে হবে রোগ শোকে বিছানায় পড়ে সে যখন কাতরায়, তখন কম্পিউটার তার কপালে সেড়বহের পরশ বুলাতে পারে না। এ সময় তার চাই মমতাময়ী মায়ের বা সেড়বহশীলা বোনের হাতের ছোঁয়া। এই মমতার ছোঁয়া বাদ দিয়ে নিছক প্রযুক্তির হাত ধরে সে এগোতে পারবে না। প্রযুক্তির আরেকটা মন্দ দিক হলো বই পাঠে অনীহা। পাঠ্যপুস্তকের কথা বলছি না। জীবন গড়ার পাথেয় জোগায় যেসব বই সেসবের কথা বলছি। কালজয়ী এক দার্শনিক বলেছিলেনÑ

তোমার হৃদয়ে দ্বিতীয় একটি ভুবন তৈরি করো। যখনই বিষণড়বতায় ভুগবে ডুবে যাও সেই ভুবনে। দ্বিতীয় ভুবন আপনা আপনি তৈরি হয় না। প্রধানত বই পড়েই সে জগৎ নির্মাণ করা যায়। বইয়ের কি অভাব? বই বেরুচ্ছে অগণিত সংখ্যায়। পাশাপাশি শিশুকিশোর পত্রিকাও কম বেরুচ্ছে না। কিন্তু পাঠক হাতে গোনা। এখন মানুষের হাতে যত মোবাইল ফোন আছে তত বই নেই ঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পাঠাগারে। নতুন প্রজন্ম কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে কিন্তু দ্বিতীয় ভুবনের তাকগুলো জ্ঞান ও মেধা দিয়ে পূর্ণ করছে না। যখন সে বিষণড়বতায় ভোগে মনটা বিচলিত হয় তখন তার কোনো অবলম্বন থাকে না। তাই শিশুর জন্য উপরিকাঠামোর আয়োজন যেমন স্কুল কলেজ মাঠ পার্ক বিনোদন কেন্দ্র পাঠাগারের পাশাপাশি তার মনোজগৎ তৈরির কাজটিতে জোর দিতে হবে। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা তাতে বিদ্যালয় একটি শিশুকে শিক্ষায়, চরিত্রে, স্বাস্থ্যে, মননে ও মানসিকতায় পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে না। এগুলো নিছক বিদ্যাশিক্ষার কেন্দ্র। পঠন, লিখন আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণে তার দৌড় শেষ। সমান্তরালে এক্সট্রা কারিকুলার কার্যμম নেই বললেই চলে। নামীদামি স্কুলে শিশুরা ভেতরে বসে জ্ঞানার্জন করে, বাইরে অভিভাবক প্রধানত মায়েরা হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটায়। শিশুরা স্কুলের ভেতরে বসে জ্ঞানার্জন করে, বাইরে অভিভাকদের নিয়ে বসতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীরা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে মতবিনিময় করতে পারে।

অনেক এনজিও কাজ করছে দেশে। স্কুল গেটে দীর্ঘ সময় প্রতীক্ষারত মায়েদের দিকে কারো দৃষ্টি নেই। এই মায়েদের অডিও-ভিডিও মাধ্যম ব্যবহার করে শিশু পালনে শিশুর মেধা মননের বিকাশ ও তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো বিষয়ে সচেতন করা যায়। তা করা গেলে শিশুর বিকাশ নিশ্চিত হতো, মায়েরাও আলোকিত হতেন। পরিবারেও শিশুর বিকাশ উপযোগী পরিবেশ μমশ লোপ পাচ্ছে। বসবাসের জমির দাম বাড়ছে। নগরে মধ্যবিত্ত ও নিমড়বমধ্যবিত্ত স্বল্পপরিসর বাড়িতে বাস করছে সপরিবারে। সেখানে মুক্ত বাতাস ও পর্যাপ্ত আলো নেই। শিশু যখন হাঁটতে শিখছে তখন পাচ্ছে না সুপরিসর মেঝে বা সবুজ চত্বর। বার বার হোঁচট খাচ্ছে সে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অভ্যাসটাই তার হচ্ছে না। ছোট শিশুটিকে খাওয়ানোর চেষ্টায় মা বেচারার সব কৌশল ব্যর্থ হবার পর টিভি অন করেন। অপেক্ষায় থাকেন বিজ্ঞাপন বিরতির। বিজ্ঞাপন এলে ধুন্ধুমার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ শিশু মুখ খোলে। মা ঘন ঘন খাবারের দলা মুখে দিয়ে হাঁফ ছাড়েন। সেই খাবার শিশু চিবোয় না। খাবারের স্বাদও বোঝে। এক ঢোকে খাবার গিলে ফেলে সে। তাই খাবারের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায় না। বার বারই অপেক্ষা করতে হয় বিজ্ঞাপন বিরতির। এই যে টিভির সাথে শিশুর সখ্যতা দিন দিন বাড়ে। তার সাথে যোগ হয় কম্পিউটারের ইন্টারনেট।

এরা ডাল মাছ ভাতে স্বাদ পায় না। ফাস্টফুড পেলে বর্তে যায়। একটা জীবনী বা গল্পের বই দশ বিশ পাতা পড়ার ধৈর্য্য নেই কিন্তু টিভি বা ল্যাপটপে ডুবে থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরা বার্গার পিজা স্যান্ডউইচ পেস্ট্রি পেটিস চেনে। দেশীয় পিঠা খই মোয়া মুড়কির খবর রাখে না। চাইনিজ থাই- টার্কি খাবারও খায় কমবেশি। আতা, লুকলুকি, ভুবি, লটকন, জলপাই আরো সব দেশীয় ফলের সাথে পরিচিত নয়। প্রতিটি জনপদে জন্মানো ফলমূল শাকসবজিতে সেখানকার মানুষেরÑ পুষ্টি চাহিদার সুষম জোগান থাকে। শিশুদের সব ঋতুতে উৎপনড়ব ফলমূল পরিমিত খাওয়ালে তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হতো। এতে খরচও কম। কিন্তু আমরা তা করি না। ফলে আমাদের শিশুরা মসলাবহুল গুরুপাকের খাবার খায় যা শিশুকিশোরদের কুরে কুরে খাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই গায়ে-গতরে নাদুসনুদুস। কিন্তু ভেতরে সারবত্তা নেই। কয়েক হাত দৌড়ানোর পর এরা হাঁপায়।

আমাদের শিশুসংগঠনগুলোও হালকা চালের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। ভাবখানা এই যেন শিশুদের সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাতে পারলেই কেল্লা ফতে। শিশুরা তো হাসছেই। ওদের টিভি হাসাচ্ছে, কম্পিউটার হাসাচ্ছে। আবার শিশুসংগঠনও হাসাবে? মনে রাখতে হবে আনন্দ বিনোদনই শিশুর প্রধান চাহিদা নয়। অবশ্যই শিশুকে সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে। হাসি আনন্দ খেলাধুলার উপায় উপকরণ জোগাতে হবে। কিন্তু তাকে সংবেদনশীল একটি মনেরও অধিকারী করতে হবে। শিশুকে কাঁদতে শেখাতে হবে। কানড়বার চেয়ে বড় শক্তি আর কী আছে? অন্যের ব্যথায় কাঁদলে অন্তর পবিত্র হয়। শিশুসংগঠনগুলোকে তাই কেবল হাসি আনন্দের উপকরণে পরিপূর্ণ এ অনুষ্ঠানের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের কী চাই? একদল ভাবনাহীন আনন্দমুখর শিশু নাকি প্রাণবন্ত, ধ্যানী একটি প্রজন্ম? সেই সজীব চিন্তাশীল প্রজন্ম তৈরি করতে হলে শিশুদের জীবনের গল্প শোনাতে হবে। নাটকে কৌতুকে গল্পে কথকতায় জীবনের কথা আনন্দ বেদনার কথা বলতে হবে। কারণ জীবনের গল্প এত ছোট নয় এক দিনেই তা ফুরিয়ে যাবে। হাসতে হবে আর কাঁদতে হবে, এই নিয়েই তো বাঁচতে হবে।