হাইডি

মূল : জোহান্না স্পাইরি অনুবাদ : রেজা কারিম

0
87

(গত সংখ্যার পর)

জনাব সিম্যানের বাড়িতে কিছু খুব অবাক করা ঘটনা ঘটছিল। একদিন সকালে সেবাস্টিয়ান বাড়ির সদর দরজাটা খোলা পেলেন। “একটা চোর ঘরে ঢুকেছিল।” তিনি ভাবলেন। কাজের লোকেরা প্রতিটি রুম খুঁজে দেখলো। কিন্তু কোনো কিছুই চুরি যায়নি। ঐ রাতে সেবাস্টিয়ান খুব সতর্কতার সাথে দরজাটি বন্ধ করলেন। কিন্তু সকালে দরজাটি আবারও খোলা পাওয়া গেলো। একই ব্যাপার দিনের পর দিন ঘটতে লাগলো। অবশেষে মিস রোমার বললেন, “সেবাস্টিয়ান, তুমি ও জন দুজনে মিলে আজ রাত জেগে বসে থাকবে। দেখো, কী ঘটে।”
এ দুজন কাজের লোক মূল দরজার সামনে পাহারায় মগ্ন হলো। কিন্তু রাতে তারা খুব বেশি খেয়েছিল। তাই রাত ১২টা বাজতেই দুজন ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ জন জেগে উঠলো। “আমি কিছু শুনেছি।” সে চিৎকার করলো ও ঘর থেকে দৌড়ে বের হলো। সেবাস্টিয়ান তার চিৎকার শুনলেন। এমন সময় জন ফিরে এলো। সে বললো, “আমি এটি দেখেছি, একটা সাদা কিছু সিঁড়ির উপর। আর দরজাটি আবারও খোলা পেলাম!”
পরদিন জনের কাছ থেকে বিস্তারিত ঘটনা শুনে বাড়ির চাকরেরা খুব ভীত হলো। তারা বললো, “এটি একটি ভ‚ত। এ বাড়িতে ভ‚ত আছে।”
ক্লারা ঘটনাটি শুনলো। সে ভীত হলো। তাই মিস রোমার জনাব সিম্যানকে চিঠি লিখলেন। তিনি যেন বাড়িতে আসেন কারণ ক্লারা খুব মনমরা হয়ে আছে।
জনাব সিম্যান এলেন, কিন্তু তিনি ভ‚তের গল্প বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, “এটা অবশ্যই কোনো মানুষ। আজ রাতে আমি জেগে বসে থাকবো। তোমাদের ভ‚তকে হাতেনাতে ধরবো।”
তিনি তার পুরনো বন্ধু ডা. ক্লাসেনকে ডেকে পাঠালেন। যিনি আবার ক্লারার ডাক্তারও। হাইডি আসার পরেও তিনি এ বাড়িতে একবার কি দুইবার এসেছেন।
“ক্লারা কি অসুস্থ?” ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করলেন। “না, সে তার বিছানায় ঘুমাচ্ছে। আমি তোমাকে ডেকেছি আমাকে সাহায্য করার জন্য। আমরা একটা ভ‚ত ধরবো।” তিনি ডাক্তার বন্ধুকে সব বললেন।
সামনের দরজার কাছে একটি ছোট রুমে তারা দুজন বসলেন। তারা গল্পগুজব করে সময় পার করতে লাগলেন। তাই সময় দ্রæত গড়িয়ে গেলো। তাদের পাশেই টেবিলের উপর দুটি বন্দুক।
রাত তখন প্রায় একটা।
“সিম্যান, তুমি কি কিছু শুনছো?” হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার বন্ধু।
তারা উভয়ই শুনলো। কেউ একজন দরজা খুলছে।
ধীরে চুপিচুপি তারা রুম থেকে বের হলেন। দুজনের হাতে দুটি বন্দুক। সামনের বড় দরজাটি পুরোপুরি খোলা। চাঁদের আলোয় একটি সাদা মূর্তি দেখা গেলো। দরজার সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
“কে ওখানে?” চেঁচালেন ডাক্তার। সাদা মূর্তিটি তাদের দিকে ফিরলো।
এটি ছিল হাইডি। গায়ে তার রাতের সাদা পোশাক। সে খুবই ভয় পেলো। তার দিকে দুটি বন্দুক তাক করা।
“আচ্ছা এটি তাহলে আমাদের ছোট্ট সুইস মেয়েটি। তুমি এখানে কী করছো?” জনাব সিম্যান অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি জানি না।” অদ্ভুত গলায় বললো হাইডি।
“সে ঘুমের মাঝে হাঁটছে।” ডাক্তার বললেন।
“তাকে আমার কাছে দাও। আমি তাকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি।”
ডাক্তার হাইডিকে তার বেডরুমে নিয়ে গেলেন। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
“তুমি এখন ঠিক আছো। আচ্ছা আমাকে বলো তো তুমি কোথায় যেতে চেয়েছিলে?”
“আমার মনে হলো আমি আমার দাদার ছোট্ট বাড়িতে ছিলাম। আমি ফের গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত বাতাসের শব্দ শুনছিলাম। আমি আকাশের তারাগুলো দেখতে চেয়েছিলাম। তাই আমি দরজায় ছুটে যাই এবং তা খুলে দেই। প্রতি রাতেই আমার এমনটি হয়। কিন্তু জাগার পরে আমি নিজেকে ফ্রাঙ্কফুর্টেই দেখি।” বললো হাইডি।
“তুমি কি ফ্রাঙ্কফুর্টে সুখী?” তিনি জানতে চাইলেন।
হাইডি উত্তর দিলো না।
ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার দাদার বাড়ি কোথায়?”
“পর্বতে। খুবই সুন্দর। আমি যেতে চাই।” সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।
“আচ্ছা মামণি তুমি এখন ঘুমাও। আগামীকাল সব ঠিক হয়ে যাবে।” ডাক্তার তার কাছ থেকে সরে এলেন। “মেয়েটি ঘুমের মাঝে হাঁটে কারণ সে এখানে অসুখী। সে বাড়ি যেতে চায়। দেখছো না সে শুকিয়ে গেছে আর চেহারাটাও বেশ মলিন?”
ডাক্তার সিম্যানকে লক্ষ করে বললেন।
সিম্যান অবাক হলেন।
“অসুখী! মলিন! আমার বাড়িতে থেকে সে শুকিয়ে গেছে অথচ কেউ লক্ষই করেনি।”
“তুমি তাকে এক্ষুণি তার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।”
“কিন্তু আমি তাকে এ অবস্থায় তার দাদার কাছে পাঠাতে পারি না। তাকে প্রথমে সুস্থ করতে হবে। তারপর পাঠাতে হবে।” বললেন সিম্যান।
“না। দেরি করলে তার ক্ষতি হবে। তাকে আগামীকালই পাঠানো দরকার।”

বারো
দিনের প্রথম প্রহরে সিম্যান মিস রোমার ও অন্যান্যদের খাবার ঘরে ডাকলেন। সবাই ভাবলো তিনি ভ‚ত নিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। তিনি তাদের বললেন যে হাইডি তার বাড়িতে যাচ্ছে।
“মিস রোমার, তুমি শিশুটির সবকিছু একটি বড় বাক্সে সাজিয়ে দাও। সেবাস্টিয়ান, তুমি হাইডির খালা ডেটেকে নিয়ে এসো। সে যেখানে কাজ করে সেখানে যাও। জন, তুমি একটি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসো। আর টিনেট্টি, তুমি হাইডিকে ঘুম থেকে জাগাও আর জামাকাপড় পরিয়ে দাও।”
তারপর তিনি দ্রæত ক্লারার কাছে গেলেন। তিনি ক্লারাকে সব বললেন। তার ছোট বন্ধুর চলে যাওয়ার খবর শুনে ক্লারার খুব মন খারাপ হলো। তবে তার বাবা তাকে বললেন যে আগামী গ্রীষ্মে সে তার বন্ধু হাইডিকে দেখতে সুইজারল্যান্ড যেতে পারবে। তারপর হাইডির বাক্সটা ক্লারার রুমে আনা হলো, যাতে ক্লারাও তার কিছু সুন্দর পোশাক হাইডিকে দিতে পারে।
সেবাস্টিয়ান ডেটেকে নিয়ে ফিরে এলেন। সিম্যান তাকে হাইডির সমস্যার কথা বললেন।
“আমি চাই আপনি তাকে আজই তার দাদার কাছে নিয়ে যাবেন। বললেন তিনি।
“আমি দুঃখিত। আমি যেতে পারবো না। আজ আমি খুব ব্যস্ত। আগামীকালও না। এমনকি এর পরের দিনও পারবো না।” একদমে বললেন ডেটে।
“ও আচ্ছা।” তিনি ডেটেকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি সেবাস্টিয়ানকে বললেন হাইডিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি হাইডির দাদার কাছে একটি চিঠি লিখলেন।
তিনি হাইডিকে খাবার রুমে ডাকলেন।
“হাইডি, এ বিষয়ে তুমি কি বলো?” প্রশ্ন করলেন তাকে।
সে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। টিনেট্টি তাকে জাগিয়েছিলো ও ভালো কাপড় পরিয়েছিল, কিন্তু তাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি।
“তুমি জানো না? তুমি আজ বাড়ি যাচ্ছ।”
“বাড়ি?” তার চেহারায় আলো খেলে গেলো।
“তুুমি কি যেতে চাও না?”
“হ্যাঁ আমি যেতে চাই।” এটা কি সত্যিই? সে দ্রæত ক্লারার রুমে দৌড়ে গেলো। ক্লারা তাকে সবকিছু দেখালো যা সে তার বাক্সে রেখেছিল। সে তাকে একটা ঝুড়ি দিলো। এর মধ্যে দাদিমার জন্য বারোটি সাদা রোল ছিল। হাইডি তার বড় বইটিও এর ভেতর রাখলো।
গাড়ি প্রস্তুত। এখন হাইডির বিদায় নেবার পালা। মন খারাপ করার সময় নেই। হাইডি ও সেবাস্টিয়ান গাড়িতে উঠে বসলো।
ঘোড়ার গাড়ি তাদের রেলস্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ট্রেন চড়ে তারা ব্যাসল পৌঁছায়। রাতে তারা একটি হোটেলে রাত কাটায়। তারপর তারা একটি ধীরগতির ট্রেন চড়ে ছোট শহর মায়েনফেল্ড পৌঁছায়। সেখান থেকে তারা ডরফ্লির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে।
সেবাস্টিয়ান তার এই জার্নিটা একদমই উপভোগ করেননি। তিনি পর্বতে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন এবং দীর্ঘ হাঁটা তার অপছন্দ হলো।
এসময় বড় বড় বস্তা বহন করা একটি মালগাড়ি যাচ্ছিল। গাড়ির চালককে তিনি ডরফ্লি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।
“ডরফ্লি? আমি নিজেই সেখানে যাচ্ছি। আমি এ শিশুটিকে ও তার বাক্স আমার সাথে নিয়ে যেতে পারবো।” বললেন গাড়িচালক সেই লোকটি।
সেবাস্টিয়ান খুশি হলেন। তিনি হাইডির দাদাকে লেখা চিঠিটি হাইডির কাছে দিলেন। সাথে একটি ছোট ব্যাগও।
“এটি সিম্যানের পক্ষ থেকে একটি উপহার। যতœসহকারে এর দেখাশোনা করো। এটি ঝুড়ির ভেতরে রোলগুলোর নিচে রেখে দাও।”
মালবাহী গাড়িটি ডরফ্লির যতই কাছে এলো, হাইডি ততই আনন্দিত হলো। সে আল্ম পর্বতকে তার সামনেই দেখতে পেলো। অন্য পর্বতগুলোও তার চোখে ভেসে উঠলো। গ্রামে পৌঁছে সে গাড়ির চালককে ধন্যবাদ জানালো। সে ঝুড়িটি নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। সে পাহাড়ি পথে দৌড়াতে থাকলো। মনে মনে ভাবছিল, “দাদিমা কি এখনো বেঁচে আছেন?” সে ছোট পিটারের বাড়িতে পৌঁছায় ও দরজার সামনে থেমে যায়। ভেতরে যেতে সে অপ্রস্তুত হলো। কিছুটা ভয়ও লাগছিল। অবশেষে সে ভেতরে গেলো। ঘরের কিনার থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো।
“ও পভু! একেবারে হাইডির পায়ের আওয়াজ এর মতো। কে এখানে?
“আমি হাইডি; দাদিমা।” সে দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে। দাদিমা হাইডির মাথায় তার হাত রাখেন।
“ধন্যবাদ প্রভু। এইতো তার চুল, তার গলার স্বর। ওহ আমার হাইডি। দাদুভাই।”
“আমি তোমার জন্য কিছু চমৎকার সাদা রুটি এনেছি।” বলেই সে দাদিমার কোলে রোলগুলো রাখলো।
“চমৎকার। এতগুলো।” তিনি ছুঁয়ে অনুভব করলেন। “তুমি রুটির চেয়ে ভালো মানের কিছু এনেছো।”
“আমি এখন দাদার কাছে যাবো। আগামীকাল আবার আসবো।” কিছুক্ষণ পর বললো হাইডি। সে আল্মের উপরে উঠতে লাগলো। দূর থেকে সে পুরনো ফির গাছগুলোর মাথা দেখতে পেলো। দেখতে পেল বাড়ির ছাদটি। একসময় পুরো ঘরটি দেখা গেলো। দেখা গেলো দাদাকেও। তিনি তার চেয়ারে বসে ছিলেন।
“দাদা, দাদা।” সে খুশিতে ডাকতে ডাকতে তার কাছে দৌড়ে গেলো। কিছুক্ষণ তারা কেউই কথা বলতে পারেনি।
“তারা তোমাকে পাঠিয়ে দিলো?” দাদা অবশেষে বললেন।
“না দাদা। তারা খুব ভালো, কিন্তু আমি খুব করে তোমার কাছে আসতে চেয়েছিলাম। এই নাও, এই চিঠিটি তারা তোমাকে দিয়েছেন।”
সে চিঠিটি ও ছোট ব্যাগটি দাদার হাতে দিলো। তিনি ব্যাগের ভেতর দেখলেন।
“এই ব্যাগে তোমার জন্য টাকা আছে। অনেক টাকা। কাপবোর্ডের ভেতর রেখে দাও।”
তারা ভেতরে গেলো। সে পুরো ঘর দৌড়ে বেড়ালো। সে মই বেয়ে উপরে উঠলো। “খড়ের উপর আমার বিছানাটি কোথায়? এটি এখানে আর নেই!”
“তোমার বিছানাটি আবারও পাতা হবে। এখন এসো। দুধ খেয়ে নাও।”
হাইডি পাত্রের সবটুকু দুধ খেলো। সে বললো, “পৃথিবীতে আমাদের দুধের মতো ভালো আর কিছু নেই।”
বাইরে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ হলো। হাইডি খুশিতে লাফ দিলো। সে দৌড়ে বেরিয়ে ছাগলগুলোর কাছে গেলো। তাদের পেছনে ছিলো পিটার।
“শুভ সন্ধ্যা, পিটার।” বললো হাইডি।
পিটার কিছু বললো না। মুখ হা’করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওদিকে হাইডি ছাগল নিয়ে মেতে উঠলো।
“তাহলে তুমি ফিরে এলে? খুব ভালো হয়েছে।” বলেই কাছে এসে হাইডির হাত ধরলো। তারপর খুশি মনে সে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলো।

খড়ের ওপর হাইডির বিছানা প্রস্তুত করা হলো। সে ¯্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিলো তাকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য। তারপর ঘুমিয়ে গেলো। ঐ রাতে তাকে আর ঘুমের মাঝে হাঁটতে হয়নি।
চলবে…