স্যাটেলাইটের কতকথা

আবরার হক

0
219

পৃথিবীর উপগ্রহ কয়টি? আগেকার সময়ে এ প্রশ্নের উত্তরে কেবল আমদের প্রিয় চাঁদমামার নাম বললেই হতো। কিন্তু গত শতাব্দি থেকে ব্যাপারটা আর অত সহজ নেই। কারণ, আমরা সবাই জানি উপগ্রহ বলতে এমন কিছুকে বোঝায়, যা নিজের অক্ষে থেকে কোনো গ্রহকে আবর্তন করতে থাকে, অর্থাৎ গ্রহের চারপাশে ঘুরতে থাকে। আগেকার দিনে তো কেবল অক্লান্তভাবে চাঁদমামাই এই কাজ করত। এখন পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার মতো আরো অনেক বস্তু যুক্ত হয়েছে। এদেরকে বলা হয় কৃত্রিম উপগ্রহ। যাদেরকে আমরা ইংরেজি ভাষায় স্যাটেলাইট বলেও জানি। আজ আমরা এই কৃত্রিম উপগ্রহর ব্যাপারে জানার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।
স্যাটেলাইট আমাদের কী কাজে লাগে, এবং কত রকমের স্যাটেলাইট মহাকাশে এখন ঘুরছে শুরুতেই সেদিকে যাওয়া যাক।
প্রথমেই আসি কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ স্যাটেলাইটের কথায়। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহারের ইন্টারনেট, টেলিভিশন, টেলিফোন, রেডিও ইত্যাদির জন্য এই স্যাটেলাইটগুলো কাজ করে। মহাকাশে এরকম স্যাটেলাইটের সংখ্যা ২২০০-এরও বেশি (১ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত তথ্য)। এ স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫৯০০ কিলোমিটার ওপরে স্থাপিত।
এরপর আসি অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল বা জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট প্রসঙ্গে। পৃথিবীতে বসে বসেই আমরা যে অনেক দূরের গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি বা বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি, তা কিন্তু এই ধরনের স্যাটেলাইট গুলোর কারণেই।
তারপর আসতে পারি আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট। এগুলোর কাজ ওপরে বলা অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল স্যাটেলাইটের উল্টো। এরা মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করে। পৃথিবীর পরিবেশ ও আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ, পৃথিবীর নিখুঁত মানচিত্র তৈরি, মহাকাশ থেকে পৃথিবীর ছবি তোলা ইত্যাদি কাজে এই স্যাটেলাইটগুলো ব্যবহৃত হয়।
এরপর আসি নেভিগেশনাল বা দিকনির্দেশক স্যাটেলাইটের কথায়। বিভিন্ন ম্যাপ, যেমন গুগল ম্যাপে আমরা যে আমাদের সঠিক অবস্থান দেখতে পারি, তা কিন্তু এই ধরনের স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমেই সম্ভব হয়ে থাকে। এখন তুমি গাড়িতে, হেঁটে এমনকি প্লে­নে চড়ে গুগল ম্যাপে দেখতে পারো তোমার অবস্থান কিভাবে পরিবর্তন বা আপডেট হচ্ছে। এসব কিন্তু সম্ভব হয় এই স্যাটেলাইটগুলোর সাহায্যেই।
এরপর বলা যায় বায়োস্যাটেলাইটের কথা। পৃথিবীর কোনো প্রাণিকে মহাকাশে নিয়ে গেলে তার প্রভাব কেমন পড়ে তার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের জন্য এগুলো কাজ করে। তুমি নিশ্চয়ই লাইকার কথা পড়েছ। লাইকা ছিল একটি কুকুরের নাম, যে কুকুরটিকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার ওপর সেখানকার আবহাওয়া ও অবস্থানের প্রভাব দেখার জন্য। কুকুরটি সেখানে প্রায় ৩ বছর ছিল। তত দিন সে বায়োস্যাটেলাইটেই অবস্থান করছিল।
কতগুলো স্যাটেলাইট আছে যাদের বলা হয় কিলার বা হত্যাকারী স্যাটেলাইট। এগুলো মহাকাশে শত্রুপক্ষের স্যাটেলাইট ধ্বংস করার কাজ করে। এছাড়া মহাকাশ থেকে পৃথিবীর কোনো টার্গেটে হামলা করা বা মিসাইল নিষ্ক্রিয় করার কাজেও ব্যবহৃত হয়। ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বজুড়ে উত্তাপ ছড়িয়েছিল, তখন এই উত্তাপ ভূপৃষ্ঠ পেরিয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ধরনের স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে।
কতগুলো স্যাটেলাইট আছে, যেগুলো স্পেসশিপ বলে পরিচিত। এগুলোর মাধ্যমে মানুষ বা কোনো কিছু মহাকাশে নিয়ে যেতে এবং সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার কাজে ব্যবহৃত হয়।
এরপর পর্যবেক্ষক স্যাটেলাইটের কথা বলা যায়, এগুলো সামরিক কাজে বা গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর কাজের মধ্যে থাকে মিসাইল এটাকের ব্যাপারে আগেভাগে সতর্ক করা, পারমাণবিক বিস্ফোরণের তথ্য দেয়া, অন্ধকার বা কুয়াশার মধ্যেও রাডারের কাজ করা, গোপনভাবে যোগাযোগ করা ইত্যাদি। তবে এসব স্যাটেলাইটের কাজ সম্পর্কে বেশি জানা যায় না। কারণ, জানা গেলে শত্রুপক্ষ সতর্ক হয়ে যাবে যে!
এরপর বলা যায়, স্পেস স্টেশনের কথা। তোমরা অনেকেই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথা জেনেছ ইতোমধ্যে। এগুলোতে মানুষ বসবাস করতে পারে এবং সেখান থেকে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। এগুলোকেও স্যাটেলাইট বলা যায়।
নতুন এক ধরনের স্যাটেলাইটের কথা ব্যবহৃত হচ্ছে, যাদের বলা হচ্ছে সোলার পাওয়ার স্যাটেলাইট। এগুলো সূর্যের আলো থেকে সৌরশক্তি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে বা প্রয়োজনে অন্য জায়গায় সরবরাহ করতে পারবে।

আমরা একই সাথে স্যাটেলাইট কী কাজ করে আর কত ধরনের কাজ করে, তার আইডিয়া নিয়ে নিলাম। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের এত স্যাটেলাইট তো আকাশে একসাথে এসে হাজির হয়নি। কিভাবে স্যাটেলাইট আসলো? এবার আমরা সেটাই জানার চেষ্টা করব। প্রথম স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আজকের রাশিয়া। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর ছিল সেই ঐতিহাসিক দিন, যেদিন স্পুটনিক-১ নামের সেই স্যাটেলাইট মহাকাশের উদ্দেশ্যে উৎক্ষেপিত হয়েছিল। তার প্রায় ২৭০ বছর আগে প্রকাশিত আইজ্যাক নিউটনের বিখ্যাত বই ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকাতে প্রাকৃতিক উপগ্রহের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম উপগ্রহের আইডিয়া নিয়ে লেখা হয়েছিল।
১৯৫৫ সালের ২৯ জুলাই হোয়াইট হাউস থেকে ১৯৫৮ সালের বসন্তকাল অর্থাৎ মার্চ থেকে জুনের মধ্যে প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘোষণা দেয়া হয়। এর ২ দিন পরই চমক নিয়ে হাজির হয় রাশিয়া। ৩১ জুলাই তারা ঘোষণা দেয়, ১৯৫৭ সালের নভেম্বরের আগেই তারা তাদের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে।
শেষ পর্যন্ত ঘোষণা অনুযায়ী রাশিয়াই প্রথম তাদের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়, যার নাম ছিল স্পুটনিক-১। এটি বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার কাজ করেছিল। এরপর ৩১ জানুয়ারি ১৯৫৮ সালে আমেরিকা তাদের স্যাটেলাইট এক্সপ্লোরার-১ মহাকাশে প্রেরণ করে।
তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মহাকাশে গিয়েছে প্রায় ৬০টি দেশের ৯ হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইট। এর মধ্যে প্রায় ৫০০০ এখনো মহাকাশে রয়ে গেছে। তবে, মাত্র হাজার দুয়েক কার্যরত অবস্থায় আছে আর বাকিগুলো এখন মহাকাশ বজ্য। মহাকাশ বজ্য চেনো? মহাকাশে কোনো কিছু প্রেরণের পরে যখন তা আর কোনো কাজে লাগে না এবং তা ময়লা আবর্জনার মতই মহাকাশে যত্রতত্র পড়ে থাকে, তাকে মহাকাশ বজ্য বলে।
একেকটা স্যাটেলাইট কত দিন কাজ করতে পারে? এদের জীবনাবসান হয় কি? হ্যাঁ, একেকটি স্যাটেলাইট সাধারণত ৩-৪ বছর কার্যকর থাকে। এরপর? এরপর কয়েকটি বিষয় ঘটতে পারে। স্যাটেলাইটটিকে তার কক্ষপথচ্যুত করা যেতে পারে, যে কক্ষপথে ছিল সেখানেই ছেড়ে দেয়া যেতে পারে অথবা তাকে স্যাটেলাইটদের কবরস্থানে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। স্যাটেলাইটের কবরস্থানের কথা প্রথম শুনলে? স্যাটেলাইটের কবরস্থান বলতে মহাকাশের এমন কক্ষপথকে বুঝায়, যেখানে কার্যকর বা অ্যাক্টিভ স্যাটেলাইটগুলো থাকে না, বরং তার থেকে বেশ দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এগুলোর কোনটা করা হবে, তা অবশ্য পুরোটাই নির্ভর করে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের ওপর।
স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত দুইটা অংশ নিয়ে গঠিত। মূল কন্টেইনার আর অ্যান্টেনা। মূল কন্টেইনারে থাকে স্যাটেলাইট চলার জন্য ব্যাটারি অথবা সোলার প্যানেল। এর বাইরে থাকে অনবোর্ড কম্পিউটার, যা এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন সিস্টেমকে মনিটরিং করে। অ্যান্টেনা তথ্য সংগ্রহ ও পৃথিবীতে প্রেরণের কাজ করে। যেগুলো পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণের কাজ করছে, সেগুলোতে পৃথিবীর দিকে তাক করা ক্যামেরা আর সেন্সর থাকে। আর যেসব বাইরের দিকে পর্যবেক্ষণের জন্য দেয়া, সেগুলো তার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে থাকে।
স্যাটেলাইট কত উপরে থাকে? স্যাটেলাইটের অবস্থানকে ৪টি রেঞ্জে বা সীমায় ভাগ করা হয়। লো-আর্থ অরবিট বা পৃথিবীর নিকটতম কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮০-২০০০ কিমি উপরে থাকে। এরপরে মধ্যম উচ্চতার স্যাটেলাইটগুলো ২০০০ থেকে ৩৫,৭৮৬ কিমি উচ্চতায় থাকে। এরপর হচ্ছে জিওসিনক্রোনাইস বা ভূস্থির কক্ষপথ। এই কক্ষপথের সকল স্যাটেলাইট ৩৫,৭৮৬ কিমি উচ্চতায় থাকে। এই কক্ষপথের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। অন্যান্য কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলো নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু এই কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর গতির সাথে সমানুপাতে চলে। অর্থাৎ এগুলো পৃথিবীর কোন স্থানের সাপেক্ষে নিজের জায়গায় স্থির থাকে। আরেকটু সহজ করে বলি। মনে করো তোমার বাসার ঠিক ৩৫,৭৮৬ কিমি ওপরে একটা স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে। এখন পৃথিবী তো ঘুরছে। তাহলে ঐ স্যাটেলাইট কি তোমার বাসার ওপর থেকে সরে যাবে? অন্য স্যাটেলাইটগুলো সরে গেলেও এই উচ্চতার স্যাটেলাইটগুলো সরবে না, বরং, সেই জায়গাতেই স্থির থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রেরিত স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এই ধরনেরই স্যাটেলাইট। যাই হোক, অবস্থানের বিচারে সর্বশেষ হচ্ছে হাই আর্থ অরবিট বা পৃথিবী থেকে দূরতম দুরত্বে অবস্থান করা স্যাটেলাইট। এগুলো ৩৫,৭৮৬ কিমি এর চেয়ে উঁচু অবস্থানে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
স্যাটেলাইটগুলো কেমন গতিতে চলছে? সকল স্যাটেলাইটের গতি সমান নয়। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, স্যাটেলাইটগুলো ঘন্টায় প্রায় ১৮,০০০ মাইল গতিতে চলে, যেভাবে প্রতিদিন পৃথিবীকে প্রায় ১৪ বার প্রদক্ষিণ করতে পারে।
আমরা মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো উল্কাপিণ্ডের কথা জানি। আচ্ছা, এই উল্কার আঘাতে স্যাটেলাইট ধ্বংস হতে পারে না? হতে পারে। কিন্তু এটা প্রায় অসম্ভব পর্যায়ের ব্যাপার। এ পযন্ত মহাকাশে প্রেরিত স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে কেবল ১টি স্যাটেলাইট উল্কার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রায় ৯০০০-এর মধ্যে মাত্র ১টি। কারণ, স্যাটেলাইটগুলো যেন উল্কাকে এড়িয়ে চলতে পারে, সে অনুযায়ী প্রোগ্রাম করা আছে।
বন্ধুরা, শেষ করতে যাচ্ছি আজ। তোমাদের জানার তীব্র আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি হবে এবং মানুষের উপকারে তোমার জ্ঞানকে কাজে লাগাবে। সে প্রত্যাশায় শেষ করছি।