শিশুর ডেঙ্গু প্রতিরোধ

ডা. আশরাফ হোসেন

0
227

বন্ধুরা, একটি অশনি সংকেত হলো, এবার অসময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে এবং কিছু কীটতত্ত¡বিদ বলছেন রাজধানীতে সারা বছরই ডেঙ্গু জ্বর থাকতে পারে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ২৬ শতাংশই শিশু। করোনা মহামারী অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে শিশুরা। একসঙ্গে অনেক শিশু ক্লাস করে। দিনের বেলায় ক্লাসে এডিস মশার কামড়ে অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ও মশা তাড়ানোর শক্তির অভাবে বেশি ঝুঁঁকিতে রয়েছে শিশুরা।
অন্যান্য বছর ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন-১ বা ডেন-২ ধরনের সংক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু এবার এই ভাইরাসের ডেন-৩ ও ডেন-৪ ধরনের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এ কারণে জটিলতাও বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা দ্রæত কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই যকৃৎ আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে, কিডনির কার্যকারিতায়ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। পানি আসছে বুকে ও পেটে এবং মাঝে মাঝে নিউমোনিয়া দেখা যাচ্ছে। কারোও কারোও ক্ষেত্রে ঘাম, হাত-পা ঠাÐা হয়ে আসা, রক্তচাপ কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এবার তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর কথাও মাথায় রাখতে হবে।
শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর উপসর্গ বড়দের মতো নাও হতে পারে। ছোট শিশুর পক্ষে অনেক উপসর্গের কথা সঠিকভাবে প্রকাশ করাও সম্ভব হয় না।
মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, হাত-পায়ে ব্যথার মতো যন্ত্রণার কথাও অনেকে বোঝাতে পারে না। অনেক শিশুর খাওয়া কমে যায়। দেখলেই বোঝা যায়, সে কোনো অস্বস্তিতে ভুগছে। চারপাশের পরিবেশের প্রতি বিরক্ত থাকতে পারে, অভিভাবককেও অতিরিক্ত বিরক্ত করতে পারে।
নিচের লক্ষণ গুলোর যেকোনোটি দেখা দিলেই সত্বর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে : প্রস্রাব কম হওয়া, নেতিয়ে পড়া, পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, কিছুই খেতে না পারা, জ্বর একেবারেই না কমা, হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, হঠাৎ করেই শান্ত শিশুর চঞ্চল হয়ে যাওয়া কিংবা চঞ্চল শিশুর একদম শান্ত হয়ে যাওয়া, শিশু অতিরিক্ত ত্যক্ত-বিরক্ত করা এবং যে কোনো রক্তক্ষরণ যা চামড়ার নিচেও হতে পারে।
বন্ধুরা, ডেঙ্গুজ্বর ৩ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত থাকে। জ্বর চলে যাওয়ার পরই সাধারণত অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তাই জ্বর দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িঘর, কার্নিশ ও ছাদে আটকে থাকা স্থির পানি এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র, এসব দূর করতে হবে। শিশুদের ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরাতে হবে। দিন বা রাত যখনই শিশু ঘুমাক, মশারির ভেতরে রাখতে হবে। হাতে-পায়ে মশা নিরোধক মলম লাগানো যেতে পারে।
এর আগের বছরগুলোয় শিশুরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে জ্বর কমার পর শক হতো। তবে এবার শরীরে জ্বর থাকা অবস্থায় শক সিনড্রোম দেখা দিয়েছে শিশুদের। এটা সবচেয়ে ভয়াবহ। এবার ডেঙ্গুতে শিশুদের ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি, খাদ্যনালিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। হৃদযন্ত্রের জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে হৃদকম্পন বাড়তে পারে আবার কমতেও পারে। নিউরোলজিক্যাল সমস্যাও হচ্ছে। অনেক সময় শিশুদের শরীরে জ্বর না থাকলেও ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে। এটি ডেঙ্গুর প্রভাবে হচ্ছে। হাফহাতা জামা, হাফপ্যান্ট পরার কারণে স্কুল ও কোচিং সেন্টারে মশা বেশি কামড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। ডেঙ্গুতে এক বছরের কম ও বেশি ওজনের বাচ্চাদের ঝুঁঁকি বেশি।
বন্ধুরা, ডেঙ্গু শনাক্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিতে হবে। অল্প অল্প করে বারবার তরল খাবার খেতে হবে। পানি, লেবুর শরবত, ফলের শরবত, স্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে হবে। এসময় তোমাদের নিয়মিত প্রস্রাব হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে। ছয় ঘণ্টায় একবারও প্রস্রাব না করলে সতর্ক হতে হবে। জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
শিশুকে বাড়িতে পর্যাপ্ত তরল খাওয়ানো না গেলে হাসপাতালে নিতে হবে। বাড়ি বা ওষুধের দোকানে নিয়ে শিরাপথে স্যালাইন দেয়া যাবে না। কেননা, প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি তরল শিরাপথে দেওয়া হলে শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হয়।
যেকোনো জ্বরের রোগীরই ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করানো উচিত হবে। তবে জ্বর যদি পাঁচ দিনের বেশি থাকে, তাহলে ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে আনুষঙ্গিক অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে। এর মধ্যে কমপ্লিট বøাড কাউন্ট অন্যতম। এই পরীক্ষায় প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি শিশুর রক্তের গ্রæপ জেনে নিতে হবে। ডেঙ্গুর পরীক্ষার পাশাপাশি করোনার পরীক্ষাও করাতে হবে। কারণ, কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এখন দুটি সংক্রমণ একসঙ্গেই হতে দেখা যাচ্ছে।
জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ইত্যাদি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ধরা পড়লে শিশুকে বিশ্রামে রাখতে হবে, প্রচুর পানি বা তরল খেতে দিতে হবে। ডেঙ্গুতে ২-৩ দিন পর যখন জ্বর কমে যায়, তখনই জটিলতা দেখা দেওয়ার সময়। এ সময় প্রায় প্রতিদিন রক্তের অণুচক্রিকার পরিমাণ দেখা উচিত। অণুচক্রিকার সংখ্যা কমতে থাকলে শিশু বারবার বমি করলে, খেতে না পারলে, পেটে ব্যথা হলে, শিশুর মধ্যে অতি অস্থিরতা বা নিস্তেজ ভাব দেখা দিলে, মুখ-দাঁত-নাক দিয়ে রক্তপাত হলে কিংবা কালো পায়খানা অথবা কালো রক্তবমি কিংবা রক্তের মতো প্রস্রাব করলে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে। মুখ-চোখ ফ্যাকাশে মনে হলে, হাতপা অতিরিক্ত ঠাÐা মনে হলে, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না করলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
বন্ধুরা, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের পুষ্টিকর খাবার খুব জরুরি। এ সময় পানিশূন্যতা, দুর্বলতা, ক্লান্তির পাশাপাশি রক্তে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। খাবার তালিকায় অবশ্যই প্রোটিন বা আমিষ যুক্ত খাবার রাখতে হবে। প্রোটিন দ্রæত আরোগ্য লাভে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ সময়ে তাই মাছ, গোশত, ডাল, ডিম ও দুধ খাবার তালিকায় রাখতে হবে। দই বা দইয়ের লাচ্ছিও খুব উপকারী খাবার। এটা প্রোবায়োটিকের ভালো উৎস। দইয়ে অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা আমাদের অন্ত্রের জন্য দরকারি। এসব ব্যাকটেরিয়া সহজে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।
চিকেন স্যুপ, বাদাম ও দুধের শেক, ডিমের পুডিং উপকারী। জ্বরে আক্রান্ত রোগী যেহেতু ভারী খাবার খেতে পারে না, তাই এমন পুষ্টিকর হালকা খাবার একটু পরপর খেলে শরীরে শক্তি পাওয়া যায়। পাশাপাশি শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ হয়। প্রোটিনের পাশাপাশি আয়রনযুক্ত খাবারও খেতে হবে। খেজুর, কলা, বেদানা, তরমুজ, ছোলা, শিমের বীজ, মিষ্টিকুমড়ার বীজ, কলিজা, গোশত নিয়মিত খেতে হবে।
ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার যেমনÑ লেবু, কমলা, মালটা, আমলকী, জলপাই, জাম্বুরা, আনারস, কিউই, বেরিস, কাঁচামরিচ খেতে হবে। ভিটামিন সি আমাদের শরীরে সহজে আয়রন শোষণে সাহায্য করে। পাশাপাশি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের খাবারে ভিটামিন কে-যুক্ত খাবার রাখা খুব জরুরি। ভিটামিন কে রক্তপাতের ঝুঁঁকি কমায়। পালংশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, বিট, টমেটো, ধনেপাতা, লেটুসপাতা খাবার তালিকায় রাখতে হবে।