যুদ্ধে শান্তি নেই

কবির কাঞ্চন

0
49

ক বনে বাস করতো এক বাঘ। বয়স ও শক্তিমত্তার বিচারে বনের অন্য সব প্রাণী তাকে সমীহ করতো। সবাই তাকে সেই বনের রাজা মনে করতো। বাঘটিও সবার সাথে সুন্দর আচরণ করতো। নিজ বনের প্রাণীদের আপন মনে করতো সে। তার বনে কেউ কারো ওপর জুলুম করছে শুনলে সেখানে ছুটে যেতো সে। জুলুমবাজের কাছ থেকে নিরীহ প্রাণীটিকে রক্ষা করতো। সেই সাথে জুলুমবাজ প্রাণীকে উচিত শিক্ষা দিতো। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সে ছিল বদ্ধপরিকর। বনের সব প্রাণীর সুখশান্তির জন্য সে সারাক্ষণ ব্যস্ত সময় পার করতো।
দিনেদিনে সেই বাঘটির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আশপাশের বনের প্রাণীরাও তার সুনাম করতে লাগলো। সে বনের পাশের বনের রাজা ছিল পশুরাজ সিংহ। এক কান দুই কান হয়ে একসময় পশুরাজ সিংহের কানেও এই সংবাদ পৌঁছে যায়। সিংহ তার এলাকায় অন্য কারোর গুণকীর্তন হোক তা মানতে নারাজ। একদিন মন্ত্রী সভার সবাইকে নিয়ে পশুরাজ এক জরুরি বৈঠকে বসলেন।
বৈঠকে সে রাজ্যের মন্ত্রী ভাল্লুক মশাই বললেন,
– আমাদের মহামান্য রাজা, আপনি আমাদের কতো সুখেশান্তিতে রেখেছেন। আপনার রাজ্যের কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে কিছু করতে পারে না। আপনি কঠোরভাবে তা দমন করেন। সবার দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করছেন। বনে সবাই যার যার মতো করে সুখেশান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু এতো এতো সুবিধা দেয়ার পরও রাজ্যের কিছু কিছু প্রজা আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজার গুণকীর্তনে মগ্ন। এ বড় অন্যায়। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। তাছাড়া এই সুযোগে আমাদের হারানো ঐতিহ্যও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

পাশ থেকে প্রধান সেনাপতি গন্ডার বলল,
– আমাদের মন্ত্রী মহাশয় যে কথা বলেছেন তা নিয়ে এখনই আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে।
আমি চাই আমাদের প্রাণপ্রিয় রাজার রাজ্যে অন্য কারো প্রশংসা মেনে নেয়া যায় না। এরা দেশদ্রোহী। এদের ছেড়ে দেয়া যায় না। জাঁহাপনা, আপনি আমায় হুকুম করুন। আমি এখনি ওদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে চাই।
সবার কথা শুনে পশুরাজ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। কী করতে হবে এমন উপায় নির্ধারণ করতে রাজা যখন সময় নিচ্ছিল তখন রাজ্যের প্রধান পÐিত শিয়াল হাত উঁচিয়ে বলল,
– আমি কিছু বলতে চাই।
সভার সবাই শিয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। পশুরাজ শিয়ালকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
– আজকের সভার আলোচ্য বিষয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি না। শিয়াল পÐিত, তুমি বল, এমুহূর্তে আমার কী করা উচিত?
শিয়াল একটু ভেবে নিয়ে বলল,
– মহারাজ, বেয়াদবি মাফ করবেন। আমার মনে হয়, যে যাই বলুক না কেন এই বিষয়ে আমাদেরকে খুব সাবধানে এগুতে হবে। আমি বলি কি- কোনো রাজা যদি তার প্রজাদের সাথে ভালো আচরণ করে ভালো রাজা হতে পারেন তিনি প্রশংসার যোগ্য। এ নিয়ে তার বিরোধিতা না করে আমরা কি তার আদর্শকে গ্রহণ করতে পারি না? আমরা কি আরো ভালো হতে পারি না?
শিয়াল মশাইয়ের এমন মন্তব্য মেনে নিতে না পেরে সেনাপতি তার প্রতিবাদে বলেন,
– একি বললেন! আপনি এ রাজ্যের প্রধান পÐিত। আপনার কাছ থেকে এমন মন্তব্য আশা করা যায় না। আমাদের রাজ্যের প্রজারা আমাদের রাজাকে বাদ দিয়ে অন্য রাজ্যের রাজার প্রশংসা করবে। এ কি মেনে নেয়া যায়? এভাবে প্রশ্রয় দিতে থাকলে কিছুদিন পরে তো প্রজারা রাজ্যের নিয়মকানুনও মানতে চাইবে না। আমার মতে, এখনই এর কিছু একটা বিহিত করা দরকার।
– দেখুন, সেনাপতি মহাশয়, প্রজারা কিন্তু আমাদের রাজার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বললে দোষের কী?
– এখানে ভালো-খারাপ বলতে আপনি কাকে কাকে বোঝাতে চাইছেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে- আপনিও পাশের রাজ্যের রাজাকে ভালো রাজা মনে করছেন। প্রজাদের সুরে সুর মিলাচ্ছেন।
– সবাই তো তাই বলে। তাছাড়া কোন রাজ্যের রাজা ভালো হলে সে রাজ্যের প্রজারা ভালো থাকে। আর পার্শ্ববর্তী রাজ্যে শান্তি থাকলে আপন রাজ্যের জন্যও ভালো। এদিক থেকে আমাদের উচিত তাদের বিপক্ষে না গিয়ে তাদের ভালোবাসা।
মন্ত্রী মহাশয় রেগে গিয়ে বললেন,
– অবশেষে আপনিও সেই প্রজাদের দলে ভিড়ে গেলেন?
– আমি কি দোষের কিছু বলেছি?
রাজা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
– পÐিত মশাই। আপনার বক্তব্যে আমি মোটেও খুশি হতে পারিনি। আমার রাজ্যের এতো বড় পদে থেকেও কী করে আপনি আমাকে বাদ দিয়ে পাশের রাজ্যের রাজার প্রশংসা করতে পারেন? আপনার উপযুক্ত সাজা হওয়া জরুরি।
– আমায় ক্ষমা করুন, জাঁহাপনা।
– না, আপনার কোনো ক্ষমা নেই। সেনাপতি, সেনাপতি।
সেনাপতি সামনে এগিয়ে এসে নতশিরে বলল,
– জো হুকুম, জাঁহাপনা।
– এই অবাধ্য পÐিতকে অন্ধকার কারাগারে নিয়ে যাও।
এরপর সেনাপতি তার সৈন্যবাহিনী দিয়ে পÐিত মশাইকে কারাগারের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।
এমন সময় শিয়াল পÐিত পশুরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– মহামান্য পশুরাজ, নিঃসন্দেহে আপনিই এই রাজ্যের একজন ভালো রাজা। তবে আপনি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না যার জন্য পরবর্তীতে আফসোস করতে হয়।
পশুরাজ রাগত স্বরে বললেন,
– তুমি কি বলতে চাও?
– আমি বলতে চাই, আপনার শান্তির রাজ্যে যেন শান্তি বলবৎ থাকে। যুদ্ধ, হানাহানি কোনো দিন সুফল বয়ে আনে না। শুধু ধ্বংসই বয়ে আনে।
সেনাপতি গন্ডার পশুরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– দেখেছেন মহারাজ, এখনো কিভাবে কথা বলছে? ওকে নিয়ে যেতে আমায় হুকুম করুন।
– যাও, ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।
এরপর সেনাপতি পÐিত মশাইকে অন্ধকার কারাগারে বন্দী করে ফিরে আসে। সভায় সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা পাশের রাজ্যকে আক্রমণ করে তা দখল করে নেবে। সেই সাথে সে রাজ্যের রাজার পতন ঘটাবে। তখন আর কেউ তার প্রশংসা করবে না।
যেই ভাবনা সেই কাজ। কয়েক দিনের মধ্যে সে রাজ্যে একজন দূত হিসেবে টিয়াপাখিকে যুদ্ধের বার্তা দিয়ে প্রেরণ করা হলো। টিয়াপাখির কাছ থেকে এমন অনাকাক্সিক্ষত বার্তা পেয়ে বাঘরাজা উত্তেজিত না হয়ে তাকে তার অতিথিশালায় আরাম করতে বললেন। ওদিকে রাত বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে টিয়াপাখি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
রাতে খুব আদরযতœ করে তাকে খেতে দেয়া হয়। বাঘরাজা একজন অতিথি হিসেবে টিয়াপাখির সাথে সুন্দর ব্যবহার করেন। খাওয়াদাওয়ার পর নিজে এসে বেশকিছু সময় টিয়াপাখির সাথে গল্প করে কাটান। টিয়াপাখির রাজ্যের সুখদুঃখের খবরাখবর নেন।
রাজার এমন আচরণে টিয়াপাখিও মনে মনে লজ্জিত হয়ে ভাবতে থাকে- আমরা শুধু শুধু এমন একটা ভালো রাজার বিপক্ষে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। আসলেই তো বাঘরাজা ভালো। না, আমি রাজ্যে ফিরে গিয়ে পশুরাজকে সব খুলে বলবো।

পরদিন সকালবেলা টিয়াপাখির ফিরে যাবার সময় হলো। বাঘরাজা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন,
– এই চিরকুটখানা তোমাদের রাজাকে দিয়ো। আর তোমার মন চাইলে তুমি আমার রাজ্যে আসতে পারো। আমি তোমার আসার অপেক্ষায় থাকবো।
টিয়াপাখি বাঘরাজাকে কুর্নিশ করে উড়তে উড়তে নিজ রাজ্যে ফিরে এলো।
পশুরাজ টিয়াপাখির এতো দেরি করে ফেরার কারণ জানতে চাইলে টিয়াপাখি বলল,
– মহারাজ, আসলে বাঘরাজা একজন ভালো রাজা। গত রাতে তার সাথে থেকে আমি নিজেও তা উপলব্ধি করতে পেরেছি।
– তুমি কিভাবে তা বুঝতে পারলে?
এরপর টিয়াপাখি গতরাতে তার সাথে বাঘরাজার ব্যবহারের বর্ণনা দিয়ে পশুরাজের কাছে চিরকুটটি তুলে দিলো।
পশুরাজ চিরকুটটি পড়ে মনে মনে ভাবতে থাকে- একটা বিষয় পরিষ্কার না। সবাই বাঘরাজার প্রশংসাই বা করে কেন? আমি নিজে তা প্রত্যক্ষ করতে চাই।
এই ভেবে পশুরাজ টিয়াপাখিকে একখানা আমন্ত্রণপত্র দিয়ে আবার বাঘরাজার কাছে পাঠালো।
আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে বাঘরাজা তা সাদরে গ্রহণ করলো। এবারও বাঘরাজার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে টিয়াপাখি আবার পশুরাজের রাজদরবারে ফিরে আসে। টিয়াপাখি পশুরাজকে বাঘরাজার আগমনের দিনক্ষণ জানিয়ে দরবার থেকে প্রস্থান করে।

এদিকে বাঘরাজাকে বরণ করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। নির্দিষ্ট সময়ে খুব আড়ম্বরপূর্ণভাবে বাঘরাজাকে সাদরে গ্রহণ করা হয়। পশুরাজ বাঘরাজাকে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তার রাজ্য বেড়াতে আসায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানায়।
বাঘরাজাও পশুরাজকে বন্ধুত্বের আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানায়। দুই রাজা কথা বলতে বলতে একদিন পার করলেন। বাঘরাজার সাথে যতই কথা বলেন ততই তার ব্যবহারে পশুরাজ মুগ্ধ হয়ে ওঠেন। এভাবে দুই দিন পার হলো। তৃতীয় দিন বাঘরাজার ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো।
বাঘরাজাকে বিদায় জানাতে শেষসাক্ষাতের জন্য রাজ্যের মন্ত্রী সভার সবাইকে ডাকা হলো। একে একে সবাই এলো। পশুরাজ সবাইকে কাছে পেলো। হঠাৎ তার শিয়াল পন্ডিতের কথা মনে হলো। শিয়াল পন্ডিতের সাথে সেদিনের ঘটে যাওয়া বিষয়ের কথা মনে পড়তেই তিনি লজ্জিত হয়ে সেনাপতি গন্ডারকে হুকুম করলেন,
– সেনাপতি, সেনাপতি।
– জো হুকুম, জাঁহাপনা।
– যাও, শিয়াল পÐিতকে সসম্মানে দরবারে নিয়ে এসো।
– আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য, জাঁহাপনা।
এই বলে সেনাপতি গন্ডার রাজদরবার ত্যাগ করলো। মন্ত্রিসভার সবাই একে অন্যের দিকে তাকাতাকি করতে লাগলো।
একটু পর শিয়াল পÐিতকে সাথে নিয়ে সেনাপতি গন্ডার রাজদরবারে ফিরে এলো।
শিয়াল পÐিত পশুরাজকে কুর্নিশ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর পশুরাজ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– শিয়াল পÐিত সেদিন যথার্থই বলেছিলেন। আমরা কেউই তার বক্তব্যের মানে বুঝতে পারিনি। তাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়েছি। সত্যি তো কারো ব্যাপারে পুরোপুরি না জেনে বিরূপ মন্তব্য করা ঠিক নয়। আর কেউ ভালো হলে তাকে নিয়ে ঈর্ষা করা উচিত নয়। তার ভালো গুণকে নিজের জীবনে অনুপ্রবেশ করাতে পারলেই জীবনের সার্থকতা আসে।

পশুরাজের কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই করতালির মাধ্যমে পশুরাজকে স্বাগত জানায়। এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাঘরাজা নিজ রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।