বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠে-পুলির কথা

আহমদ মতিউর রহমান

0
180

শীত এলেই শিশুদের কী মজা। পরীক্ষা আর লেখাপড়ার ঝামেলাটা কমে আসে। করোনাকালে হয়েছে আরো সুবিধে। অল্প অল্প লেখাপড়া করলেই চলে। কেননা পরীক্ষাও অল্প অল্প। ফলে দাদু বা নানু বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ এসে যায়। যারা একটু উপরের ক্লাসের তারা ছোটে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। সিলেট, রাঙামাটি, উত্তরবঙ্গ আর চট্টগ্রাম, যেখানেই আত্মীয়বাড়িতে যাওয়া হোক না কেন, সকালে বা বিকেলে নাস্তার টেবিলে পিঠা হাজির। অনেকে আবার বলে পিঠে। এর সঙ্গে আসে পুলির কথা। দুয়ে মিলে হলো পিঠে-পুলি। এটা বাঙালির একটা নিজস্ব ঐতিহ্য। হ্যাঁ, সময়ের অভাব, ভালো কারিগর আর খালামাসিদের নানা কাজের হুজ্জত বেড়ে যাওয়ায় অনেক পিঠা হারিয়ে যেতেই বসেছে। পিঠার ইংরেজি প্রতিশব্দ কেক। কিন্তু কেক বললে এখন আর পিঠা বোঝায় না। কেক আলাদা জাতের খাবার। বিশেষ করে শহরে জনপ্রিয়, অধিকাংশ বাণিজ্যিকভাবে তৈরি, কেউ কেউ বাসাতেও বানায়। অভিধান মতে পিঠা বা পিঠের অর্থ হচ্ছে পিষ্টক। চাল পিষ্ট বা গুঁড়ো করে পিঠা বানানো হয় বলে এই নাম। চোখের এক ধরনের অসুখের নামও পিষ্টক। আবার পিঠা বা পিঠের সাথে সাথে উচ্চারিত হয় পুলি। এর অর্থ এক প্রকার পিঠা, যেমন ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি।
ধান কাটা উৎসবে কৃষকের ঘরে যখন নতুন ধান ওঠে সেই ধান ঢেঁকিতে ভেঙে তৈরি হয় নানা রকম পিঠা। এ উপলক্ষে হয় নবান্ন উৎসব। নবান্ন অর্থ নতুন অন্ন, নতুন চালের অন্ন বা ভাত। হেমন্তে ধান কাটার পর দুধ, গুড়, নারিকেল, কলা ইত্যাদির সাথে নতুন আতপ চাল খাওয়ার উৎসব হচ্ছে নবান্ন। হেমন্তের পরেই শীত। শীতকালে আবার খেজুরগাছের রস জ্বাল দিয়ে গুড় বাড়িতেই বানিয়ে ফেলে গ্রাম গঞ্জের বৌ ঝিয়েরা। তাই দিয়ে শীতকালজুড়েই চলতে থাকে বাড়িতে বাড়িতে পিঠাপুলি তৈরির গমগমে আমেজ।
পিঠা বাংলার নিজস্ব আভিজাত্যপূর্ণ খাদ্যদ্রব্য। এটি চালের গুঁড়ো, আটা, ময়দা অথবা অন্য কোনো শস্যজাত গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করা হয়। অঞ্চলভেদে পিঠার ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত নতুন ধান তোলার পর থেকেই পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। শীতের ও পৌষপার্বণের সময় বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে পিঠে তৈরি করা হয়। পিঠে সাধারণত মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকলেও ঝাল, টক বা অন্য যেকোনো স্বাদ হতে পারে।
মনে পড়ে ছোট বেলায় শীতের পিঠার কথা। পিঠা ছাড়া বাংলার শীত যেন পরিপূর্ণ হয় না। ঐতিহ্যবাহী শীতের বাহারি পিঠা খাওয়ার রীতি বাংলার সংস্কৃতির অংশ। একসময় পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় ছোট-বড় সকলেই পিঠা খাওয়ার আনন্দে মেতে উঠত। কিন্তু এখন তা আর চোখে পড়ে না। কর্মচঞ্চল এই ব্যস্ত জীবনে তা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে বা যাওয়ার পথে, যে কথা আগে বলছিলাম।
সুন্দরী পাকন পিঠা

একসময় এমন ছিল যতই শীত বাড়ত, ততই যেন মানুষের পিঠা বানানোর ব্যস্ততা বেড়েই চলত। ঘরে ঘরে রকমারি পিঠা তৈরির উৎসবে মেতে উঠত গৃহস্থ বাড়ির গৃহিণীরা। এ সময় শিশু-কিশোররা হতো আনন্দে আত্মহারা। পিঠা পাঠানো হতো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও। অথচ শীতের পিঠা বানানোর ধুমধাম আয়োজন পাড়া-গাঁয়ে কিংবা কৃষকপল্লীতে আর তেমন চোখে পড়ে না। আত্মীয়স্বজন আছে আগের মতোই, নেই শুধু মধুর সম্পর্ক। মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেলেও আগের সেই বন্ধন আর নেই। সবাই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত কেউ কারো খোঁজ রাখতে চায় না। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা, বদলে যাচ্ছে রুচি। হারিয়ে যাচ্ছে পিঠা তৈরির সেসব উৎসবমুখর আমেজ। আমন ধান কাটার পরই শুরু হয় নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের নতুন পিঠা, পোলাও, পায়েস, ক্ষীর এবং রকমারি খাবার তৈরি এ সময়ের নিত্যদিনের চিত্র। এটা করা হতো কৃষকের ঘরে ঘরে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা এবং বাড়ি বাড়ি নতুন চাল রান্নার ম-ম ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত, খেতেও বেশ লাগত। ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব উপলক্ষে গ্রামগঞ্জের কৃষক পরিবারের ঝি-জামাই এবং আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে নতুন চালের বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি করে ভ‚রিভোজের আয়োজন করা হতো। নবান্নের উৎসব কৃষকপাড়ায় খুব একটা দেখা না গেলেও শীতে পিঠা খাওয়ার পুরনো অভ্যাস বদলাতে পারেনি এখনো গ্রামীণ জনপদের মানুষ। কোথাও কোথাও হয়ে থাকে নবান্ন উৎসবও।
শীতের সাথে পিঠার যোগসূত্রটা কী করে হলো? পিঠা বাঙালির প্রিয় খাবার। এ দেশে এমন মানুষ কমই আছে, যারা পিঠা পছন্দ করেন না। পিঠা নিত্যদিনের খাবার না হলেও শীতকালে বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠার ব্যাপক কদর রয়েছে। উৎসব আয়োজনেই পিঠা নামের বাড়তি খাবার তৈরি করা হয়। আগে শীতের শুরুতেই গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে পৌষপার্বনের রকমারী পিঠার আয়োজন করা হতো। দাদী-নানী, মা, খালারা পরম মমতায় তৈরি করত বিভিন্ন ধরনের রসালো পিঠা। সন্ধ্যা হলেই গ্রামে চাল গুঁড়া করার শব্দে মুখরিত হতো চারদিক। রাতভর চলতো পিঠা তৈরির কাজ। অনেকে আবার পিঠা তৈরির সময় গীত গেয়ে রাত পার করত। পিঠার অন্যতম উপাদান চালের গুঁড়ো হলেও এর সঙ্গে লাগে গুড়, ক্ষীরসহ নানা উপকরণ। এ উপকরণের সঙ্গে শীতের একটা যোগসূত্র আছে। তাই হেমন্ত থেকে শীতকাল পর্যন্ত পিঠা তৈরির ধুম পড়ে।

পিঠাপুলি ও শহুরে বাঙালির উৎসব : পিঠা-পুলির দেশ বাংলাদেশ। তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পিঠা দেশীয় ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলে। পিঠা ধরে রাখছে আত্মীয়তার বন্ধনও। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি পিঠা পাঠানোর রীতি বাঙালি পালন করে আসছে বহুকাল ধরে। শহরবাসীর পিঠার চাহিদা মেটাতে অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে বসেছে ছোট ছোট পিঠার দোকান। বলতে গেলে মানুষ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিবছরই শীতের মৌসুমে ঢাকাসহ প্রায় সব জেলা শহরগুলোতে বিভিন্ন পিঠা উৎসব হয়।
ফুলঝুড়ি পিঠা

বিভিন্ন নামের পিঠা : প্রতিটি পিঠা শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, এদের এক একটি উপকরণে পরম মায়ার পরশ মাখা থাকে। বেশিরভাগ পিঠা মিষ্টি হলেও স্বাদ কিন্তু একরকম নয়। এদের কোনটা রেখে কোনটা বেশি মজাদার তা বলা কঠিন। শুধু স্বাদই নয়, নামেও এদের বিশেষত্ব রয়েছে। যেমন- গরম ভাপে তৈরি ভাপা পিঠা, সুন্দর নকশা আঁকা হয় বলে নকশী পিঠা, দুধে ভিজে চিতই হয় দুধ চিতই, লবঙ্গের ঘ্রাণে সাজে লবঙ্গ লতিকা, মুঠ পাকিয়ে সেদ্ধ দিলেই মুঠোপিঠা। আবার গোলাপ ফুলের আকারে হল গোলাপ পিঠা। এছাড়াও মুখে রোচে পাটিসাপটা, কুলি, দুধ কুলি, চিতই, বিয়ের অনুষ্ঠানের বিশেষ পিঠা বিবিয়ানা, মেরা পিঠাসহ আরও কত কী!
লবঙ্গ লতিকা পিঠা

প্রায় ১৫০ রকমের পিঠা পুলির নাম জানা যায়। প্রতিটির স্বাদ, উপাদান, বানানোর কৌশল আলাদা। আগে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করে পিঠা তৈরি হতো। এখন ঢেঁকি উঠেই গেছে বলতে গেলে। ভোররাত থেকে শুরু হতো পিঠা তৈরির কাজ। ভোরে গরম গরম পরিবেশন। যেসব পিঠার নাম জানা যায় তার মধ্যে আছে চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, সবজি কুলি, পুলি পিঠা, তারা পিঠা, পাটিসাপটা, সুজি পিঠা, সেমাই পিঠা, নৌকা পিঠা, পয়সা পিঠা, কাটা পিঠা, ম্যারা
দুধ খেজুরের রসে ঝিনুক

পিঠা, বেনী পিঠা, তালের পিঠা, ক্লিপ পিঠা, কলা পিঠা, শামুক পিঠা, ফুলকপি পিঠা, আঙ্গুরী পিঠা, চপ পিঠা, গজা পিঠা, টক পিঠা, বৈশাখী পিঠা, সেমাই বরফি, স্পেশাল নঙ্গা পিঠা, ডোনাট পিঠা, শিমফুল পিঠা, নকশি পিঠা (ঝাল), ঝুড়ি পিঠা, নকশি পিঠা (মিষ্টি), গোলাপ ফুল পিঠা, মসলা পিঠা, বস্তা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকন পিঠা, পাকড়া পিঠা, তেলের পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, ঝাল মসলা পিঠা, দুধ পুলি পিঠা, চকলেট পিঠা, সংসারী পিঠা, বিস্কিট পিঠা, পুলি পিঠা (ভাপা) ও মালাই পিঠা, ভেজিটেবল ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, খোলাজালি পিঠা, চুটকি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চাঁদ পাকন পিঠা, ছিট পিঠা, সুন্দরী পাকন, পাতা পিঠা, মালাই পিঠা, আন্দশা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, তেজপাতা পিঠা, সন্দেশ পিঠা, দুধরাজ, ফুল ঝুরি পিঠা, ফুল পিঠা ইত্যাদি। চিতই পিঠায় ডিম দিয়ে তৈরি পিঠা, দৌলা পিঠা বা গুলি­ পিঠা, কাউন চালের পিঠা, খাঁজে বানানো পিঠা ইত্যাদিও আছে।

ভাপা পিঠার রয়েছে তিনটি ধরণ, প্রতিটির আলাদা স্বাদ। সাধারণত ভেতরে খেজুরের গুড় ও কোরানো নারকেল দিয়ে তৈরি হয় এ পিঠা। গ্রামাঞ্চলে বড় আকৃতির ভাপা পিঠা তৈরি হয় শুধুমাত্র চালের গুঁড়ো দিয়ে। আবার পুরো চালের গুড়োয় খেজুরগুড় মিশিয়ে একই ধরনের বড় আকারের ভাপা পিঠা তৈরি হয়। এগুলো শক্ত হয়ে গেলে ছুরি দিয়ে কেটে খেতে হয়। খাঁজকাটা পিঠা বানাতে প্রয়োজন হয় খেজুর কাঁটা। গ্রামের নারীরা আশ্চর্য কুশলতায় তা দিয়ে বানিয়ে ফেলে বাহারি পিঠা, যা নতুন জামাইয়ের পাতে দেয়া হয়। টিনের খাঁজে তৈরি পিঠাও বাহারি সৌন্দর্য নিয়ে পরিবেশন করা হয়। গ্রামীণ পিঠা বানানোর আরো কিছু উপকরণ আছে, যেগুলো সহজলভ্য।
খেজুরের রসে তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েস গ্রাম-বাংলার মানুষের নবান্নের সেরা উপহার। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা হতো পাটালিগুঁড়, মিঠাইসহ নানা রকমের মজার মজার
নকশি পাকন পিঠা

খাবার। প্রতি বাড়িতে সকালবেলা খেজুরের রসে ভেজানো
পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ত। পিঠা আর খেজুরের রস একটি আরেকটির পরিপূরক যা বাঙালির নাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রামীণ
সংস্কৃতি একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের গৃহিণীদের মধ্যে আগের মতো পিঠা বানানোর উৎসব নেই। আমাদের নতুন প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পিঠা।