পদ্মাপাড়ের বিলু

হোসেন মাহমুদ-এর আত্মজৈবনিক উপন্যাস

0
55

পর্ব : চার
পঁয়ষট্টির যুদ্ধ

ক্লাস ফাইভের কথা। ১৯৬৫ সাল। সেপ্টেম্বর মাস এসে গেছে। সে বয়সে মাস-তারিখের হিসাব তেমন রাখে না কেউ। হঠাৎ বিলু শুনল যে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ লেগে গেছে। খুব যুদ্ধ চলছে। একদিন সকালে ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই হেড স্যার ক্লাস ফোর ও ফাইভের ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। বললেন, আজ ক্লাস হবে না। তোমরা যুদ্ধের কথা শুনেছ। ৬ সেপ্টেম্বর ভোরে হানাদার ভারত আমাদের দেশ পাকিস্তানকে অন্যায় ভাবে আক্রমণ করেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে তাদের সাথে। আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সাথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কিন্তু যুদ্ধ চালাতে অনেক খরচ। এখন আমাদের সবার উচিত সরকারকে সাহায্য করা। জনসাধারণের কাছ থেকে সাহায্য তুলতে হবে। তোমরা এ দুই ক্লাসের ছেলেরা কাল স্কুলে এসেই সাহায্য সংগ্রহ করার জন্য বেরিয়ে পড়বে। এলাকার বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় ও বাড়িতে যাবে। সবার কাছে দেশের যুদ্ধ তহবিলের জন্য সাহায্য চাইবে। যে যা দেয় নেবে। কোনো জোর জবরদস্তি করবে না। একেবারে গরিব মানুষদের কাছে কিছু চাইবে না। বিকেলের আগেই ফিরে আসবে সবাই। যা পাওয়া যায় জমা দেবে।
সাহায্য সংগ্রহের জন্য দুটি দল করে দিলেন হেডস্যার।
পরদিন স্কুলে এসে দুদিকে বেরিয়ে পড়ল দু দল। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। শুধু সচ্ছল লোকদের বাড়িতে গেল তারা। একদল স্কুল ছাত্রকে বাড়িতে দেখে সবাই অবাক। কী ব্যাপার? দলের একজন বা দুজন মিলে বলল, যুদ্ধের জন্য সাহায্য চাইতে এসেছে তারা। দেখা গেল সবাই যুদ্ধের কথা জানে। তবে তা নিয়ে কারো মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। লোকে যে যা পারে দিলো। কেউ আট আনা, কেউ চার আনা, কেউ দু বা এক আনাও দিলো। কয়েকজন ধনী লোক দিলেন এক টাকা করে। কেউ ঘরে পয়সা নেই বলে এক সের, আধ সের চাল দিলো। একটা ঝোলা জোগাড় করে তাতে ব্যবস্থা হলো চাল রাখার। দু দল মিলে ধোকড়াকোল ও গোসাইডাঙ্গি গ্রামের সব পাড়া থেকে দু দিন ধরে সাহায্য সংগ্রহ করল। শেষ দিনে সব টাকা-পয়সা গুণলেন স্যারেরা। সংগৃহীত চালও বিক্রি করা হলো। মোট হলো একশ’ সাতাত্তর টাকা নয় আনা। স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান মমতাজ উদ্দিন আহমদের কাছে গিয়ে সে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে এলেন তাদের প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার অরবিন্দ পাল।
সে সময় এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো বিলুর। তাদের বাড়িতে রেডিও নেই। পাড়ায় দু’তিনজনের বাড়ি আছে। কিন্তু কারো বাড়ি গিয়ে রেডিও শুনতে একদম ইচ্ছে করে না তার। ভারি লজ্জা করে। তাই রেডিও শোনা হয় না। যুদ্ধের পুরো খবরও জানতে পারে না। চাঁদা তোলা শেষ হওয়ার পর দিন দুপুর বেলা। অরবিন্দ স্যার ভবানিগঞ্জ গোলায় যাবেন একটা কাজে। সাথে বিলুসহ তিনজনকে ডেকে নিলেন তিনি। হেড মাস্টারের সাথে কোথাও যাওয়া সম্মানের ব্যাপার। চলল তারা। স্কুল থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের দূরত্ব। ভবানিগঞ্জ গ্রামের মাঝখানটায় হাট বা গোলা। হাট বসে সপ্তাহে দু দিন বিকেলে। হাটে শত শত মানুষ আসে। সেদিন উৎসবের মত অবস্থা। তবে সারা বছর জায়গাটা সরগরম থকে গোলার জন্য। হাট এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় পাঁচ-ছটি মনোহারি দোকান। এ দোকান-পাট ঘেরা জায়গাকে লোকে বলে গোলা। ভবানিগঞ্জ গোলাতে আছে এ এলাকার পোস্ট অফিস। নাম মহিষ বাথান পোস্ট অফিস। দশটি গ্রামের জন্য একটি পোস্ট অফিস। আর আছে একটা কামারশালা আর একটা দর্জির দোকান। সকাল থেকে রাত প্রায় দশটা অব্দি খোলা থাকে গোলার সব দোকান। আশপাশের মানুষ চাল-ডাল-তেল-নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গোলায় আসে। কাপড়, কাঁচা তরিতরকারি, মাছ আর দুধ ছাড়া সবই গোলার দোকানগুলোতে কিনতে পাওয়া যায়।
হাটে ঢুকেই বাম হাতে বিশে দর্জির দোকান। তার নাম বিশ^নাথ পাল, কিন্তু লোকের মুখে বিশে পাল হয়ে গেছে। তিনি শুধু ভবানিগঞ্জ গোলায়ই নন, এ এলাকারও একমাত্র দর্জি। সে জন্য অনেকে তাকে আবার বিশে দর্জি বলেও ডাকে। তবে জামা-পায়জামা বানান না তিনি, শুধু লুঙ্গি সেলাই করেন। প্রতি হাটে অন্তত ত্রিশ-চল্লিশটা লুঙ্গি বিক্রি হয়। লুঙ্গি সেলাই না করে পরা যায় না। হাটের আশেপাশে আর কোনো দর্জির দোকান নেই। তাই যারা লুঙ্গি কেনে সবাই তা সেলাই করার জন্য বিশে দর্জির দোকানে ভিড় জমায়। হাট বসে বিকেলে। চলে সন্ধ্যা রাতের পর আরো কিছুক্ষণ। বেশির ভাগ মানুষ শেষ বিকেলে ও সন্ধ্যায় কেনাকাটা করে। তারপর সেলাইয়ের জন্য বিশে দর্জির দোকানে দিয়ে অন্য কাজ সারতে যায়। কিন্তু সেই অল্প সময়ে সব লুঙ্গি তিনি সেলাই করে শেষ করতে পারেন না। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর হারিকেনের আলোয় কাজ তেমন এগোয় না। তাই বাকি থাকা লুঙ্গি পরদিন সেলাই করে ক্রেতাদের দেন তিনি। এভাবে শনিবারের হাটের লুঙ্গি রবিবারে আর মঙ্গলবারের হাটের লুঙ্গি বুধবারে সেলাই সম্পূর্ণ হয়। এই চারদিন তার হাতে এক বেলা করে কাজ থাকে। কিন্তু সপ্তাহের সাত দিনই বেলা নয়টার দিকে দোকান খোলেন তিনি। রাত দশটার আগে তা বন্ধ হয় না। কাজ না থাকলেও দোকানে ঠিকই থাকেন তিনি। তার দোকান মানে পুব-পশ্চিমে লম্বা একটি বড় চারচালা টিনের ঘর। দোকানের সামনের দিক মানে পুবের দিকটা পুরো খোলা। নীচে লাঠি দিয়ে ক্যানেস্তারা টিনের তৈরি ঝাঁপ ওপরে তোলা। ডান দিকে হাটে ঢোকার রাস্তা ঘেঁষে কাঠের বেড়া। বেড়ার ঠিক মাঝখানে বড় দরজা। তাই সেদিক দিয়েও দোকানে ঢোকা ও বেরোনো যায়। দোকানের পুব দিকে হাটের দিকে মুখ করে বসানো পায়ে চালানো সিঙ্গার সেলাই মেশিন। মেশিনের সাথে ঘরের প্রায় অর্ধেক জুড়ে বিরাট এক চৌকি। চৌকির মেশিনের লাগোয়া অংশে পাতলা গদি পাতা। সেখানে বসে কাজ করেন বিশে দর্জি। তার দোকানকে ভবানিগঞ্জ গোলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলা যায়। দুপুর বেলায় কর্মক্লান্ত মানুষ এসে সেখানে বসে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। আরো কথা, বিশে দর্জির একটি ট্রানজিস্টর আছে। রেডিও সেন্টার যতক্ষণ খোলা থাকে ততক্ষণ সেটা বাজে। কেউ কেউ শুধু রেডিও শুনতেই আসে দোকানে।
বিলুরা যখন গোলায় পৌঁছলো তখন দেড়টা বেজে গেছে। হেড মাস্টার বিশে দরজির ঘরে ঢুকলেন। সে সাথে বিলুরাও। শেষ ভাদ্রের প্রচণ্ড রোদে প্রায় মাইলখানেক পথ হেঁটে ক্লান্ত সবাই। বিশে দরজি হেডমাস্টারকে দেখে খাতির করে তার চৌকিতে বসাল। দোকানের মধ্যে চার-পাঁচজন মানুষ। রেডিওতে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। শুনছে সবাই। দেখতে দেখতে দুটো বেজে গেল। এ সময় রেডিওতে শুরু হলো খবর। ঘোষক জানালেন, খবরের পরই প্রচারিত হবে যুদ্ধের বিশেষ নাটক। হেডমাস্টার উঠতে গেলেন। বিশে দর্জি বললেন, মাস্টার সাব, বসেন। এ রোদের মধ্যে না বেরিয়ে নাটকটা শুনেই যান। কী মনে করে হেডমাস্টার বসলেন।
বিলু খুব খুশি হলো নাটক শোনার সুযোগ পেয়ে। নাটক শুরু হলো। কাহিনী সংক্ষেপ হলোÑ নায়ক সদ্য বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে পাইলট হয়েছে। ছুটিতে এসে বিয়ে করেছে সে। কিন্তু বাসর ঘরে যাবার আগেই জরুরি টেলিগ্রাম আসে, শত্রু দেশমাতৃভূমির ওপর হামলা করেছে। জরুরি ভিত্তিতে রিপোর্ট করতে হবে তাকে। বাসর রাত নয়, দেশ আগে। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটল তার বিমানঘাঁটিতে। রিপোর্ট করার পরই জঙ্গি বিমান নিয়ে অভিযানে গেল তার স্কোয়াড্রন। সফল অভিযান শেষে সব বিমানই ফিরে এলো, কিন্তু নায়কের বিমান ফিরল না। পরে জানা গেল যে শত্রুপক্ষের গোলায় তার বিমান ভূপাতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে , শহীদ হয়েছে সে। এ মর্মান্তিক খবর যখন তার বাড়িতে পৌঁছল, তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী চিৎকার করে উঠে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
নাটক শেষ হলো, কিন্তু শ্রোতাদের সবার মনেই তখন বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে। একজন বলে উঠলেনÑ আহারে! বোঝা গেল, নাটকটি সবারই মনে নাড়া দিয়েছে। বিলুর দু’চোখও অশ্রুভেজা। মনটা ব্যথায় ভরে উঠেছে তার। নীরবেই সিদ্ধান্ত নিলো, বড় হয়ে সে বিমান বাহিনীতে যোগ দেবে, জঙ্গি বিমানের পাইলট হবে। ততক্ষণে হেডমাস্টার উঠে দাঁড়িয়েছেন। স্কুলে ফিরবেন। বিশে দর্জির দোকান থেকে বেরিয়ে আসে তারা।
১৭ দিন যুদ্ধের পর ২৩ সেপ্টেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলো। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয় সে দেশের তাসখন্দ নগরে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দুঃখের বিষয়, চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই লালবাহাদুর শাস্ত্রী হার্ট অ্যাটাকে সেখানেই মারা যান। বিলু একটু সুযোগ পেলেই বই পড়ে। নতুন কিছু জানার ব্যাপারে তার বিপুল আগ্রহ। সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম আগেই জানত সে। আইয়ুব খানের নাম তো ছোট থেকেই শুনে আসছে। কিন্তু তাসখন্দ ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নাম এবারই প্রথম জানল সে। যাহোক, যুদ্ধ বন্ধ হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলল সবাই। তবে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল যুদ্ধের কথা। পাড়ার মুরব্বিরা এক সাথে বসলে এ যুদ্ধের কথা বলেন। তার চাচারা সবাই কম বেশি লেখাপড়া জানেন। প্রায়ই মামলা-মোকদ্দমাসহ নানা কাজে কুষ্টিয়া, ঢাকা বা অন্য শহরেও যান তারা। তাই দিন-দুনিয়ার কিছু খবরাখবর রাখেন তারা। তাদের আলোচনায় বিলু শুনল যে এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছে। শুনল বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের সাহসের কথাও। তারা লাহোরের কাছে খেমকারান নামক স্থানে যুদ্ধে ভারতের বহু ট্যাংক ধ্বংস করেছে। ফলে ভারতীয় বাহিনী আর সেখানে এগোতে পারেনি। এ যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের বীরত্ব ভীষণভাবে প্রশংসিত হলো। পাকিস্তানিরা আগে বাঙালি সৈন্যদের দিকে অবহেলার দৃষ্টিতে তাকাত। ভাবখানা এমন যে বাঙালিরা আবার যুদ্ধ জানে নাকি! কিন্তু যুদ্ধের পর পরিস্থিতি খানিকটা পাল্টাল। বাঙালিা যুদ্ধ জানে এবং ভালোই জানে, তা প্রমাণিত হয়েছে। কয়েকজন বীর সেনানির কথা শুনল সে। বিশেষ করে শুনল জঙ্গি বিমানের এক দুঃসাহসী পাইলট এম. আলমের কথা। তিনি বাঙালি, তবে এ বাংলায় নয়, কলকাতায় জন্ম তার। ভারত বিভাগের পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। পরে যোগ দেন বিমানবাহিনীতে। এই দুঃসাহসী বীর গোটা যুদ্ধে একাই ১১টি ভারতীয় জঙ্গি বিমান ধ্বংস করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। আরো শুনল মেজর আবদুল আজিজ ভাট্টির কথা। পশ্চিম পাকিস্তানে বাড়ি ওই সেনা অফিসার যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে শহীদ হয়েছেন। এদিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাস দুয়েক পর তার এক চাচার হাতে একটি ঝকঝকে নতুন বই দেখতে পেল বিলুÑ ‘রণাঙ্গনে পাকিস্তান’। বইটি খুব পড়তে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু ওই চাচা খিটখিটে মেজাজের মানুষ। ছেলেপেলেরা তার কাছে ঘেঁষে না। তার কাছে বইটি চাওয়ার সাহস পেল না সে। অথচ বইটি পড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা তার মনের ভেতর অবিরাম পাক খেতে
থাকল।
চলবে…