দ্বিতীয় পর্বের ফুলকুঁড়ি

মাহবুবুল হক

0
316

মাসিক ফুলকুঁড়ি পত্রিকার প্রকৃত কাহিনী ও ঘটনা বলতে পারবেন আমাদের অগ্রজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাসুদ আলী। তিনি এখন কানাডা প্রবাসী। ১৯৭৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ফুলকুঁড়ি আসর। আর এর পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে সচিত্র শিশুকিশোর মাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘ফুলকুঁড়ি’। অবশ্য এর আগে দুটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে এবং সেপ্টেম্বর মাসে। সম্পাদক ছিলেন মাসুদ আলী। তার মানে মাত্র এক বছর পর আসরের মুখপত্র হিসেবে ফুলকুঁড়ি পত্রিকার জন্ম। আরেকটা বড় কারণেও এ বিষয়টি আমার কিছুটা মনে আছে। কারণ, আমি তখন তথ্যমন্ত্রণালয়ে চাকরি করি। পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়ার ব্যাপারে আমি তখন বেশ দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম সে কথা আমার মনে আছে। মনে আছে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ১-৮ সাইজে। অর্থাৎ আবার এখনকার সাইজে। পত্রিকার হেডিং এ এখনকার মতই লেখা থাকত সচিত্র শিশুকিশোর মাসিক ফুলকুঁড়ি। শিল্পী হামিদুল ইসলামের আঁকা ছবি ও ইলাস্ট্রেশন দিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। বাজারের অন্যান্য চালুকৃত পত্রিকাগুলো ছিলো রঙিন, সে তুলনায় ফুলকুঁড়ি ছিল একান্ত সাদামাটা। অল্পকিছু কপি ছাপা হতো এবং বিলি-বন্টন হতো ফুলকুঁড়ি আসর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে। আবার প্রতি মাসে নিয়মিতও বের হতো না। মাঝে মাঝে বাদ যেতো। তখন মাসুদ আলীর সাথে দেখা হলে তার হাসি-খুশি থাকা উজ্জ্বল মুখটা ¤øান মনে হতো। আমি মাসুদ আলীকে খুব ভালোবাসতাম। শিশুদের সবকিছু তার আয়ত্বের মাঝে ছিল, যেমন তিনি ছড়া কাটতে পারতেন, তেমন পারতেন শিশুদের জন্য গদ্য ও পদ্য লিখতে। গানও লিখতে পারতেন, ¯েøøাগানও তৈরি করতে পারতেন একটুও সময় লাগতো না। হুট-হাট করে সব করেও ফেলতে পারতেন। দশদিগন্তজানা অমন একজন শিল্পীর তখন ছিল বড় অভাব।
আমার সঙ্গে দেখা হলেই লেখা চাইতেন, লেখা দিতাম। শেষে বললেন একটা ধারাবাহিক লেখা দিতে। আসাদ বিন হাফিজের চাপে সেই ধারাবাহিক লেখাটাও দিয়েছিলাম।
কিছু পরেই আমরা একদল বন্ধু ঢাকা মহানগর ফুলকুঁড়ি আসরের উপদেষ্টা হয়ে গেলাম। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, ব্যাংকার তাজুল ইসলাম, ডা. জিনাত হোসেন গাজী, ব্যাংকার আবদুল মান্নান, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট জহুরুল ইসলাম, ডা. নাসিম আলী, মাহবুবুল হক, ব্যবসায়ী রহমতুল্লাহ প্রমুখ।
বেশ জড়িয়ে গেলাম। এখনকার খ্যাতিমান ফিজিশিয়ান ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন তখন মিটর্ফোট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ছাত্র। তার একান্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমরা এই এক দঙ্গল প্রফেশনাল ফুলকুঁড়ি আসরে উপস্থিত হয়েছিলাম। এসব আশির দশকের প্রথম দিককার কথা। ঢাকা মহানগরীর উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক তখন হাসি-ঠাট্টায় যেমন মুখর ছিল তেমনি প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল উচ্ছ¡ল ছিলো পরামর্শ ও উপদেশ দানে। ১৯৮৪ সালে আমার কাছে প্রস্তাব এলো ‘আমরা এখন দারুণ আর্থিক সংকটে আছি, পত্রিকাটি আপনি নিয়ে আপনার মতো চালান, আমরা আপাতত আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না’। আমি তখন সরকারি চাকরি ছেড়ে মাত্র উদীয়মান শিল্পপতি হয়েছি। আমার সামনে অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনা। জড়িয়েও গিয়েছি বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানার সাথে। বললাম, মাসুদ আলী ভাই সম্পাদক থাকুক বাকিটা আমিই না হয় দেখলাম। প্রকাশকের প্রতিনিধি রাজি হলেন না। বললেন, না দায়িত্ব নিলে সব দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। মনে মনে ভাবলাম আমার তো ছেলে মেয়ে বেশি নাই। একটি ছেলে বা মেয়ের খরচই না হয় বাড়বে, আল্লাহ ভরসা।
এলিফ্যান্ট রোডে ফুলকুঁড়ি আসরের তখন কেন্দ্রীয় দফতর। সেখানেই একটি রুম নিয়ে ১৯৮৫ সালে সার্বজনীন ফুলকুঁড়ি আসরের পত্রিকার দ্বিতীয় অভিযাত্রা শুরু হলো। পত্রিকা আমরা হকারকে দিতে শুরু করলাম, সবার কাছে লেখা চাইলাম, বাংলাদেশের সেরা সেরা কবি-সাহিত্যিকরা লেখা দিতে শুরু করলেন, পত্রিকা জেগে উঠল। পত্রিকা ছোট করলাম, বড় করলাম, আরো জেগে উঠল। জেগে উঠল ফুলকুঁড়ি আসরের বাংলাবান্ধা থেকে বরগুনার সদস্যরা। তখনো বাংলাদেশের সকল রেলওয়ে স্টেশনের বুকস্টলের মালিক ছিলেন প্রখ্যাত প্রকাশক রুহুল আমিন নেজামি। মাত্র কয়েক বছরে এর প্রচার সংখ্যা বাড়লো বারো’শ থেকে বারো হাজারে।
২০০০ সালে ফুলকুঁড়ি পত্রিকার দায়-দায়িত্ব থেকে আমি মুক্ত হলাম।
২০০১ থেকে তৃতীয় পর্বের শুরু হয়, এখনো তা জাজ্জল্যমান আছে। সামগ্রিকভাবে ফুলকুঁড়ি পত্রিকার বৈশিষ্ট্য হলোÑ এটা শুরু হয়েছিল আর আছে। এবং আশা করি আগামীতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ।ভুলেভালে বা অভাবে ও দারিদ্রে যখনই পত্রিকাটি গÐিবদ্ধ হয়েছে তখনই তা প্রাকৃতিক নিয়মে আড়ষ্ট হয়েছে। এর সৃজনশীলতা কমেছে।
যখনই পত্রিকাটি বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন হওয়ার চেষ্টা করেছে তখনই তা ফুলে পত্রে ফুটন্ত হয়েছে। সবাইকে নিয়ে সবার যখন পত্রিকাটি কাজ করার চেষ্টা করেছে তখনই সে উজ্জ্বল হয়েছে, সমুজ্জ্বল হয়েছে ও সমুন্নত হয়েছে। পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে, পত্রিকাটির প্রয়োজনে একটি প্রাণবন্ত সার্বজনীন একটি সাহিত্যসভা শুরু করেছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় তা এখনো চলমান আছে। আশা করি থাকবেও। এই সাহিত্যসভাটিই পত্রিকার প্রাণ।
পত্রিকাটিও আছে, সাহিত্যসভাটিও আছে। সুতরাং আমরা ব্যর্থ হয়েছিÑ একথাটি বলার কি অবকাশ আছে!