টন্সিলাইটিস হলে করণীয়

ডা. আশরাফ হোসেন

0
70

বন্ধুরা, গলায় ব্যথা হলেই অনেকে বলে টনসিল হয়েছে। এই টনসিল আসলে কী? টনসিল হলো আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার একটা অংশ। এটি শূন্য থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। টনসিল এক ধরনের লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থি যা আমাদের গলার পেছনের দিকের অংশে থাকে। টনসিল আমাদের দেহে শ্বেতরক্তকণিকা উৎপন্ন করে যা বাইরে থেকে দেহে প্রবেশকারী জীবাণু ধ্বংস করে। কিন্তু কখনো কখনো এসব জীবাণুকে ধ্বংস করতে গিয়ে টনসিল গ্রন্থি নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে ইনফেকশন বা জীবাণু সংক্রমণ হয় এবং এই গ্রন্থি ফুলে যায়। একে মেডিকেলের ভাষায় টনসিলাইটিস বলা হয়। আমাদের মুখের ভেতরেই চারটি গ্রুপে এগুলো অবস্থান করে। এগুলোর নাম লিঙ্গুয়াল, প্যালাটাইন, টিউবাল ও অ্যাডেনয়েড। এই টনসিলগুলোর কোনো একটির প্রদাহ হলেই তাকে বলে টনসিলাইটিস। টনসিল বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি, তা কিন্তু আসলে টনসিলাইটিস। টনসিলাইটিস যে শুধু শিশুদের হয়, তা নয়। এটা শিশুদের বেশি হলেও যেকোনো বয়সেই হতে পারে।

আর প্যালাটাইন টনসিলেই সবচেয়ে বেশি প্রদাহ সৃষ্টি হয়, ফলে গলা ব্যথা হয়। এই প্রদাহ সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটি তীব্র বা অ্যাকিউট। আর অন্যটি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক টনসিলাইটিস। স্ট্রেপটোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বেশিরভাগ টনসিলাইটিস হয়ে থাকে।
বন্ধুরা, কিছু লক্ষণ দেখে আমরা টনসিলাইটিস বুঝতে পারি। সেগুলো হলো তীব্র গলাব্যথা, মাথাব্যথা, উচ্চ তাপমাত্রা, খাবার খেতে কষ্ট ও মুখ হাঁ করতে অসুবিধা হয়, কানে ব্যথা হতে পারে, মুখ দিয়ে লালা বের হয় ও কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে যেতে পারে। মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে পারে। স্বরভঙ্গ, গলায় ঘাসহ টনসিল স্ফীতি, ঢোঁক গিলতে কষ্ট হয়, গলা ফুলে যাওয়া।
পুষ্টির অভাব, আইসক্রিম, ফ্রিজে রাখা শীতল পানি বেশি পান করা টনসিলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। স্যাঁতসেঁতে স্থানে বাস করলে, আবহাওয়ার পরিবর্তনে শীতের প্রকোপ বেশি হলে, রোদ থেকে এসে ফ্রিজের ঠা-া পানি পান করলে, গরমে ঘাম বসে গেলে টনসিলের প্রদাহ বেড়ে যেতে পারে।

বন্ধুরা, টনসিলাইটিস হলে প্রচুর পানি পান করতে হবে। পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে যত দিন সুস্থ না হবে। ওরাল হাইজিন (মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য) ঠিক রাখতে হবে। মাউথ ওয়াশ দিয়ে বারবার কুলি করতে হবে। সাধারণ স্যালাইন বা লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে বারবার কুলি করতে হবে। লেবু বা আদা চা-ও খেতে পারো। গলায় ঠা-া লাগানো যাবে না। যেহেতু তীব্র ব্যথা থাকে এবং জ্বর থাকে, সে ক্ষেত্রে জ্বরের ওষুধসহ কিছু ওষুধ দেওয়া হয় এবং এটা ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে। ওষুধ নিয়মিত খেলে ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।
দীর্ঘমেয়াদি টনসিলাইটিসের চিকিৎসা সাধারণত অস্ত্রোপচার। যদি বারবার টনসিলাইটিস হয় বা এর জন্য অন্য কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে টনসিল অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেয়াই ভালো।
কী কী কারণে টনসিলের অস্ত্রোপচার করা দরকার? দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক টনসিলাইটিস, টনসিল বড় হয়ে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে গেলে এবং নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হলে। টনসিলে ফোঁড়া হলে অর্থাৎ ইনফেকশন হলে। বছরে চার-পাঁচবারের বেশি টনসিল ইনফেকশন হলে। এসব কারণ ছাড়াও যদি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ক্রিপটোকক্কাল ইনফেকশন হয়।
কখন অস্ত্রোপচার করা যাবে না? অ্যাকিউট ইনফেকশন থাকলে টনসিলে অস্ত্রোপচার করা যাবে না। কারণ, তখন ইনফেকশন সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং রক্তপাত বন্ধ না-ও হতে পারে। জ্বর বা ব্যথা থাকা অবস্থায় করা যাবে না। যদি কারো রক্তরোগ থাকে, যেমন থ্যালাসেমিয়া। রক্তনালি এবং রক্তরোগ থাকলে টনসিলে অস্ত্রোপচার করা যাবে না। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ থাকলে অস্ত্রোপচার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে যদি করতেই হয়, তাকে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এনে অস্ত্রোপচার করতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে অস্ত্রোপচার করা যাবে না। অস্ত্রোপচারের আগে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

বন্ধুরা, টনসিল অপারেশন বা অস্ত্রোপচার নিয়ে আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সেটা হলো টনসিল ফেলে দিলে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এটা ঠিক নয়। কারণ, টনসিল হলো প্রথম পাহারাদার। এর পরও গলায় ৩০০-এর বেশি লালাগ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড আছে, যেগুলো রোগ প্রতিরোধ করে। অনেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, টনসিলে অস্ত্রোপচার করার আগে ও পরে রোগপ্রতিরোধে কোনো তারতম্য হয় নাই।
অনেক সময় গলার বাইরের দিকে দুই পাশে বরই বিচির মতো দুটি দানা ফুলে উঠতেও দেখা যায়, অনেকে এগুলোকে টনসিল মনে করলেও এগুলো কিন্তু টনসিল নয়। রোগী বড় করে মুখ হাঁ করলে ভেতরের দিকে যে দুটি বড় দানার মতো দেখা যায়, তাই-ই হলো টনসিলাইটিসে আক্রান্ত টনসিল।