কাশীতে না ফাঁসিতে

এম শায়েস্তা খান

0
27

ব্যবসায়ী অতুল রায়ের স্ত্রী গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আর বিয়ে করেননি, পুত্র অসীত রায়ের মুখ চেয়ে। দু’তিন বছরের মধ্যে পুত্রকে বিয়ে করিয়ে পুত্রবধূ ঘরে আনবেন এরকম ভাবনা সব সময় করতেন। এবং এটা তার ঘনিষ্ঠজনদেরও বলে বেড়াতেন। পুত্রকে অর্থনৈতিকভাবে আরো বেশি সচ্ছল করতে চান অতুল রায়। সে লক্ষ্যে ন্যায়-অন্যায়ের দিকে না তাকিয়ে পণ্যে ভেজাল মেশানোসহ দলীয় প্রভাবে নেশা ও মাদকের ব্যবসার দিকে অগ্রসর হলেন। যদিও সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে অতুল রায়ের কোনো কালেই তেমন খ্যাতি ছিল না। পুত্রকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ করার পরিবর্তে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স শিক্ষায় শিক্ষিত করলেন। ফলে সনদ সার্টিফিকেট হলো, কিন্তু মানবিকতা লোপ পেল।
ভোগের পরিবেশে অসীত রায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। পরিশ্রমবিহীন উপার্জন ব্যক্তিকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয় এবং তার নীতি-নৈতিকতাবোধ অনেক ক্ষেত্রেই উঠে যায়। অর্থাৎ মানবিকতা লোপ পায় বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রেই। অসীত রায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অসীত রায় ভাবে পিতা না থাকলে এ বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক সে একাই হবে। পিতা জীবিত থাকায় সে এখনো পিতার মুখাপেক্ষী, অন্যথায় সে-ই হতো সর্বেসর্বা। তখন ইচ্ছার স্বাধীনতার পুরোপুরি স্বাদ সে নিতে পারত।
কিছুদিন পর অতুল রায় জমি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে এক নামকরা উকিলের সাথে পরামর্শের জন্য শহরে রওনা হন। পথিমধ্যে তার গাড়ি ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়েমুচড়ে খাদে পড়ে যায়। অতুল রায় ও ড্রাইভার ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। আর কাগজের ফাইল পানিতে বিলীন হয়ে যায়। খবরের কাগজ তথা মিডিয়ার কল্যাণে অসীত রায় পিতার মৃত্যুর খবর জেনে ঘটনাস্থলে গিয়ে পিতার লাশ শনাক্ত করে।
পিতার মৃত্যুতে অসীত রায় এখন পিতার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পদের মালিক। কিন্তু পিতার ব্যবসা পরিচালনার মতো তার কোনো অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকায় পদে পদে সমস্যার মুখোমুখি হতে লাগলো। বাস্তব অভিজ্ঞতার দাম যে কত তা সে বুঝতে পারলো। সে জন্য কাউকে কোনো কিছু না বলে বাস্তব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে বাড়ির কাছের রেলস্টেশনে মাঝে মাঝে যাতায়াত শুরু করে। সেখানে বিভিন্ন বয়সী ও বিভিন্ন ধরনের লোক দেখতে পায় অসীত। যখন ট্রেন স্টেশনে আসে ওঠানামার জন্য অপেক্ষমাণ লোকজনের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। ট্রেন চলে গেলে অল্পক্ষণের মধ্যে কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায় সব।
একদা অসীত রায় রাস্তা দিয়ে স্টেশনে আসার সময় এক জ্যোতিষীর (গণকের) দেখা পেল। অসীত রায় গণককে তার হাত দেখে ভবিষ্যৎ জানাতে বলল। গণক তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অসীত রায়কে জানালো যেÑ তার মৃত্যু হবে মথুরার গয়া কাশী বৃন্দাবনে! কাশী ভারতের উত্তর প্রদেশের বানারস এলাকায় অবস্থিত। হিন্দুধর্মাবলম্বীগণের তীর্থস্থান। সেখানে মৃত্যুবরণ করা অতীব পুণ্যময় হিসেবে বিবেচিত। সুতরাং এতে অসীত রায় বেজায় খুশি হয়ে গণককে তার যথোপযুক্ত বখশিশ দিলো। গণকও এতে খুব খুশি!
অসীত রায় তার ধর্মের পুণ্যময় স্থানে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী জানতে পেরে পিতার মৃত্যু শোক ভুলে গেল। প্রাচুর্যের গন্ধে খুব অল্প সময়েই অনেক বন্ধু জুটে গেল। ফলে হিতাকাক্সক্ষী আত্মীয়স্বজনকে দূরে ঠেলে দিতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার। রক্তের গরম, টাকার আধিক্য আর অনৈতিকতায় ভরা ভোগবাদী শরীরকে সাথী করে পূর্বের তুলনায় আরো অধিক মাত্রায় স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করতে থাকে সে। এতে খুব অল্প সময়েই তার ব্যবসাপাতি বন্ধ হয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল সব মূলধনও। এখন সে নিঃস্ব আর রিক্তহস্ত। ফলে বন্ধু-বান্ধব সবাই তাকে ফেলে চলে যায়। এমতাবস্থায় নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে অসীত রায় অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পথ ধরে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পথ চলতে চলতে অসীত রায় দূরের এক রেল স্টেশনে এসে থামল। মনঃস্থির করল, ট্রেনযোগে কোথাও চলে যাবে। টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়ে অসীত।
ট্রেনের কামরায় তার পাশে ট্রাঙ্কসহ পোশাক-আশাকে স্বগোত্রীয় এক লোক এলো। উভয়ের পরিচয় ও কুশল বিনিময় শেষে বিভিন্ন বিষয়ে কথা শুরু হচ্ছে। অসীত রায় তার অতীত ইতিহাস বলতে শুরু করল। হঠাৎ সেই যাত্রী অসীত রায়কে বলল, আপনি আমার ট্রাঙ্কটি কিছুক্ষণ দেখুন, আমি পাশ থেকে প্রাকৃতিক প্রয়োজনটা সেরে আসি। অসীত রায় সরল বিশ্বাসে ট্রাঙ্কটি পাহারা দিতে থাকে। ইতোমধ্যে ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা হয়ে যায়। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যায়। কিন্তু লোকটি ততক্ষণেও আসে না। এমতাবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অসীত রায় দোটানার মধ্যে ট্রাঙ্কটি নিয়ে তার সিটে বসে থাকে।
কিছুদূর যাবার পর ট্রেনে মোবাইল কোর্ট তথা তল্লাশি শুরু হয়। এক পর্যায়ে অসীত রায়ের কাছে আসে তল্লাশি টিম। তাকে ট্রাঙ্ক খুলে দেখাতে বলে। সে আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি উল্লেখ করে এবং বলে, ট্রাঙ্কের প্রকৃত মালিক সে নয়, অন্য আরেকজন। তাই তার কাছে ট্রাঙ্কের চাবি নেই। কিন্তু সন্দেহ হয় তাদের। তাই নাছোড়বান্দা চেকাররা ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে ফেলে। চমকে ওঠে সবাই। একটা মানুষের খÐিত মৃতদেহ দেখতে পায় ট্রাঙ্কের মধ্যে। সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। নরহত্যার এক জঘন্য মামলায় জড়িয়ে দেয় তাকে।
সুসময়ের বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনরা কেটে পড়েছে আগেই। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সহায় স¤পত্তি সব তদারকির অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। হাজতাবদ্ধ অসীত রায় এখন সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত। তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত সে। সরল বিশ্বাসের কারণে জীবনকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করালো আজ! আমলি আদালত থেকে মামলাটি যখন বিচারের জন্য দায়রা আদালতে গেল, তখন মোবাইল কোর্টের (চেকারদের) সাক্ষ্যই আদালতের কাছে গৃহীত হলো এবং আসামি অসীত রায়ের নিজের সাফাই সাক্ষী ধোপে টিকলো না। বিজ্ঞ আদালত বললেনÑ ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স। ফলে রায় ঘোষিত হলো- দÐবিধির ৩০২ ধারায় মৃত্যুদÐ।
প্রদত্ত মৃত্যুদÐের কথা চিন্তা করে অসীত রায় ভাবলো- কাশীতে যার মৃত্যু হবার কথা, তার মৃত্যু কেন ফাঁসিতে হবে? ক-বর্ণটি কেন আজ একটু ফাঁকা ফ-বর্ণ হয়ে গেল? সে তো জ্ঞাতসারে কোনো অপরাধ করেনি। তবে তার ফাঁসি হবে কেন? এ কেমন বিচার!