খাঁচার পাখি

কবির মাহমুদ

0
34

শপিংমলে ঢুকেই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল আরিয়ান। এটা কিনবে ওটা কিনবে। সামনে যা পায় তা নিয়ে খেলতে থাকে। রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় মা হামিদাকে। আর হবে না কেন! ছয় বছরের ছোট্ট আরিয়ান কি আর বোঝে! শিশুদের মন তো এমনই। শিশুরা উন্মুক্ত পরিবেশে ছুটে বেড়াবেই। যেখানে যায় সেখানেই তারা হইচই করতে ভালোবাসে। আর এটাই, স্বাভাবিক। তাদের মন মুক্ত ডানা পাখির মতো। তারা উড়তে চায়, ঘুরতে চায়, খেলতে চায়। তারা জানে না কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। তাদেরকে যা বুঝানো হয় তাই বুঝে। আরিয়ানের এমন চঞ্চলতায় মা হামিদা তাকে ধমক দিয়ে বকতে শুরু করলেন।

ধমক খেয়ে টলমল চোখে মায়ের গলায় জড়িয়ে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত হাসিতে কপালে চুমু দিয়ে বলে- তুমি আমাকে বকলে কেন মা?
– আমি না তোমার আব্বু।
– আব্বুকে কি কেউ বকে?
– আব্বু দুষ্টোমি করলে মাঝে মাঝে বকতে হয় বললেন হামিদা। তুমি না গতদিন শাফিকে ধমক দিয়ে কথা বলায় নিলা আন্টিকে বকেছ। আর আজ নিজেই আমাকে বকছো।
এমন হৃদয় ছোয়া মিষ্টি কথা শুনে কোলে তুলে আদরে আদরে মা হামিদা বললেন কোথাও গিয়ে এসব করতে নেই বাবা। লোকে তোমাকে দুষ্টু বলবে। কেউ আদর করবে না। ভালোবাসবে না।
– তাই।
– হ্যাঁ বাবা।
– বুঝে নিলো আরিয়ান।
– ঠিক আছে মা তাহলে আমি আর এসব করবো না।
– আমায় ভালোবাসবে তো!
– হ্যাঁ বাসবো বাবা।
– তুমি তো আমার চোখের মণি।
এভাবে ভালোবাসা দিয়েই শিশুদের কোমল মন কিংবা যেকোনো মানুষকে বদলানো যায়।
– ধমক দিয়ে নয়।
আরিয়ান এখন মায়ের কাছে কাছে হাতে হাত রেখে ঘুরছে। হঠাৎ ডান দিকে চোখ ফেরাতেই কয়েকটি পাখি খাঁচায় বন্দি দেখে চমকে উঠল! খাঁচার কাছে একটি সাদা কাগজের লেখাগুলো বানান করে পড়তে গিয়ে দেখে পাখিগুলো বিক্রয়ের জন্য।
– বিক্রয় কী তা জানে না আরিয়ান।
– মাকে জিজ্ঞেস করল মা, বিক্রয় মানে কী?
– বিক্রয় মানে তুমি চাইলে বা তোমার পছন্দ হলে তুমি টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারবে।
– অহ, তাই।
– হ্যাঁ বাবা।
– আচ্ছা মা পাখিগুলো বন্দি কেন?
– পাখি তো বনে থাকবে। ওদের বাসা বনে।
– ওরা তো বনকে ভালোবাসে।
– তুমি না বলো,
বাঙালি লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন- বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
– যার যেখানে মানায় সেখানেই তাদের থাকা উচিত।
– পাখিকে কি খাঁচায় মানায় বলো?
– পাখিকে খাঁচায় বন্দি রাখা পাপ, অন্যায়।
– ওরা কি জানে না?
– ওরা বিক্রি করে টাকা পাওয়ার জন্য বন্দি করে রেখেছে বাবা।
-কিন্তু, এটা তো পাপ, অন্যায় মা।
-তাহলে পুলিশ ওদের ধরে নেয় না কেন?
-তুমি না বলো খারাপ লোকদের পুলিশ শাস্তি দেয়?
-ওরা তো খারাপ।
– আহাঃ ছাড়তো এসব।
– বাসায় গিয়ে তোমাকে বুঝাবো।
– আর কোনো কথা বলবা না।
– ওকে।
আরিয়ান অনেক কিছু কিনতে এসেছে। মা এটা ওটা অনেকটা দেখিয়ে বললেও কোনো কিছুই কিনতে চায় না। মনটা মলিন হয়ে গেছে। মন পড়ে আছে খাঁচার বন্দি পাখিগুলোর কাছে। মনে মনে ভাবছে এই পাখিগুলো এখানে কেন? মানুষ এতো খারাপ কেন? আহ তাদের কত কষ্ট হচ্ছে! তাদের জীবন তো বন্দি জীবন নয়। আজ ওরা বনে থাকলে কত্তো সুন্দর এডাল ওডাল করে ঘুরে বেড়াতো। আকাশের মুক্ত বাতাসে ডানা মেলে উড়তো। ভোরে ওরা মধুর সুরে কিচিরমিচির করতো। তাদের কলকাকলিতে আমাদের ঘুম ভাঙতো। আর আজ তারা খাঁচায় বন্দি। না না এ হতেই পারে না। এটা অন্যায়। এটা পাপ!
এসব চিন্তা করতে করতে হঠাৎ দেখে মা শপিংমল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে! ঠিক সেই সময় পিছু টেনে বলল মা- আমাকে এই পাখিগুলো কিনে দাও না। আমি আর কিচ্ছু চাই না। প্লি­জ মা। আমি পাখিগুলোকে লালন পালন করবো। এসব বলে কান্না শুরু করল আরিয়ান। এক সময় বাধ্য হয়ে পাখিগুলোর দাম জানতে চাইলেন হামিদা। একসাথে পাঁচটি পাখি। আরিয়ান পাঁচটিই নেবে।
– এগুলোর দাম কতো ভাই?
– পাঁচ হাজার টাকা আপু।
– এত দাম কেন?
– এগুলোকে মানুষের বুলি শেখানো যায়।
– তাই না কি?
– হ্যাঁ আপু!
– ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়ে দেখেন সব মিলিয়ে তার কাছে হাজার তিনেক হবে।
– তিন হাজার হবে?
– দুঃখিত আপু, কম হবে না।
– দেখেন না লেখা আছে একদর!
– চলে এসো আরিয়ান অন্য দিন কিনে দেব বাবা আজ মায়ের কাছে টাকা নেই।
– না মা অন্যদিন তো এগুলো পাব না।
– আমি এগুলোই চাই।
– আরিয়ানের বায়নায়। নিকটের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে পাখিগুলো ক্রয় করলেন হামিদা।
খুব আনন্দে পাখির খাঁচা নিয়ে বাসার দিকে ছুটলো আরিয়ান। গাড়িতে বসে বসে খুব ভাবছে! গাড়ির গ্ল­াস খুলে এক এক করে পাখিগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছে। আর দেখছে পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আনন্দ! হঠাৎ মায়ের খেয়াল হলো।
– এ কি আরিয়ান এতো টাকা দিয়ে পাখি কিনে পাখিগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছ তুমি?
– কেন মা?
– তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছ পাখিকে বন্দি রাখতে নেই। তাই তো আমি পাখিগুলোকে বন্দি জীবন থেকে মুক্তি দিচ্ছি মা। আর মুক্তি দেয়ার জন্যই তো পাখিগুলো কিনেছি। ওরা কি বন্দি থাকতে চায়, বলো মা? ওদের কষ্ট হয় না।
– আচ্ছা মা আমাকে কেউ বন্দি রাখলে তোমার কেমন লাগবে বলো?
– কষ্ট হবে না!
হামিদা ভারাক্রান্ত হৃদয় আর অশ্রুসিক্ত টলমল চোখে আরিয়ানকে বুকে জড়িয়ে বললেন না বাবা এসব বলতে নেই! তুমি ছাড়া আমি কি করে বাঁচবো! তুমি আমার কলিজার টুকরো !
– হ্যাঁ মা, ওদেরও তো বাচ্চা আছে।
– ওদের মন কি কাঁদে না !
– ওরাও তো তাদের মা বাবা সন্তানকে তোমার মতো আদর, ভালোবাসতে চায়! কিন্তু আজ তারা বন্দি! ওদের অপরাধ কী?
– ওরা মুক্তি চায় মা
– ওরা মুক্তি চায়! মনে মনে ভাবলেন সত্যি তো তাই!
আর কোনো কথা না বলে লজ্জিত ও অশ্রুসিক্ত হামিদা হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন- গাড়ির গ্ল­াস খুলে এক এক করে পাখিগুলোকে মুক্তি দেয়ার দৃশ্য। আর ছাড়া পেয়ে মহানন্দে পাখিগুলো মুক্ত কণ্ঠে কলকাকলিতে বাতাসে ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার আনন্দ তাকেও বিমোহিত করছে! মুক্তি দেয়ার আনন্দে হাততালিতে লাফাচ্ছে ছোট্ট আরিয়ান! যতক্ষণ দেখা যাচ্ছে ততক্ষণ তাকিয়ে থাকলো পাখির মুক্ত ডানার দিকে। এক সময় পাখিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল তার দৃষ্টি থেকে!