কষ্টের ঈদ

ইমাম সাজিদ

0
71

সাদ আর তার মা খুব কষ্ট করে জীবন যাপন করে। ছোটবেলায় আসাদের যখন মাত্র এক বছর বয়স তখন তার বাবা তাকে আর তার মা কে ফেলে রেখে অন্য সংসারে চলে যায়। আসাদ তার বাবার আদর পায়নি বললেই চলে। তার মা মানুষের বাড়ি কাজ করে তাকে বড় করছে, লেখাপড়া করাচ্ছে। সে স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। সে খুবই ভালো ছাত্র। স্কুলের হেড মাস্টার থেকে শুরু করে দফতরি পর্যন্ত সবাই আসাদকে খুব ভালোবাসে। স্কুল তাকে বিনা বেতনে পড়ায়। তার প্রয়োজনের বাহিরে অহেতুক কোনো চাহিদা নেই। সে জানে তারা গরীব। এ কারণে তার মা তাকে অনেক ভালোবাসে। আসাদও তার মাকে অনেক ভালোবাসে।
এবার রোজায় আসাদ তার মায়ের সাথে প্রত্যেকটি রোজা-ই রেখেছে। তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করার পর কখনো কেউ ইফতারির খাবার দিলে একটু ভালো মন্দ খেতে পায়। আর এমনিতে পুরনো ভাত দিয়েই ইফতারি সারে। সাহরির সময় বেশির ভাগ সময় মোটা চালের ভাতের সাথে শাক আর পাতলা ডাল দিয়ে সাহরি করে থাকে আসাদ আর তার মা। আসাদের মা তাকে বুঝতে না দিয়ে গোপনে খুব কান্না করে তাদের অসহায়ত্বের জন্য।

এভাবে দেখতে দেখতে ২০ রোজা পার হয়ে যায়। একদিন ইফতারের সময় আসাদ তার মাকে বলে,
: মা আমার খুব শখ এবার ঈদের জন্য আমি একটি লাল টুকটুকে পাঞ্জাবী কিনবো। তারপর সেই পাঞ্জাবী পড়ে ঈদের সকাল বেলা তোমাকে সালাম জানিয়ে নামাজ আদায় করতে যাবো। নামাজ শেষে বন্ধুদের সাথে অনেক মজা করবো, খেলাধূলা করবো। আরো কত কি।
তারপর তার মা বলেন,
: আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আমি লাল টুকটুকে নতুন পাঞ্জাবী কিনে দেবো। এবার খুশিতো?
একথা শোনার পর আসাদ খুব খুশি হয়ে বলে, হুম মা আমি অনেক খুশি। কিন্তু ঈদ যে প্রায় চলে এলো। আমার অন্য সব বন্ধুরা নতুন জামা কাপড় কিনে ফেলেছে। কবে কিনে দেবে?
তখন তার মা বলেন, সাহেবরা বলেছেন ২৭ রোজায় বোনাস সহ বেতন দেবে। বেতনটা পেলেই কিনে দেবো। বাবা তুমি কোনো চিন্তা করো না। যেদিন টাকা হাতে পাবো সেদিনই বাজারে গিয়ে তোমাকে লাল টুকটুকে পাঞ্জাবী কিনে দেবো।
আসাদ বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। আর হ্যাঁ মা আমি সেমাই খেতে খুব পছন্দ করি। ঈদের দিন সকালে আমার জন্য সেমাই রান্না করো।
তার মা বলেন,
: আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। বেতনটা আগে হাতে পেয়ে নিই। শুধু সেমাই কেন, পোলাও কোরমা সব রান্না করবো তোমার জন্য।
তারপর আসাদ খুব খুশি হয়।

হঠাৎ করে ২৪ রোজায় বিকেলে তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ সেরে বাসায় ফিরে এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। খুব কষ্ট করে এক গ্ল­াস পানি পান করে ইফতার সারে। মায়ের এমন অসুখের কারণে আসাদও ইফতারির সময় এক গ্ল­াস পানি ছাড়া আর কিছুই মুখে দিতে পারেনি। রাতে প্রচ- জ্বর আসে মায়ের। এলাকার ফার্মেসির ডাক্তার আঙ্কেলকে ডেকে আনলে কিছু ওষুধ লিখে দেয়। টাকার অভাবে সব ওষুধ কেনাও হয় না, ফলে খাওয়ানোও হয় না। কিছুতেই জ্বর কমে না। এদিকে সাহেবদের বাড়ি থেকে লোক পাঠানো হয় যে কেন কাজে যাচ্ছে না তার মা।
দেখতে দেখতে ২৭ রোজা পার হয়ে গেল। কিন্তু জ্বর কিছুতেই কমছে না। আসাদের মা তাকে বলে, বাবা তুমি কালকে সকালে একটু সাহেবদের বাসায় যেও। দেখো টাকা দেয় কিনা। বোধয় দেবে না। কারণ তাদের কথা মতো কাজে যেতে পারিনি।
আসাদ বলে, আমার পাঞ্জাবী লাগবে না মা। আগে তুমি সুস্থ হও।
মা বলেন, তুমি কাল যাও তাদের বাসায় দেখো কি বলে।
পরের দিন আসাদ সাহেবদের বাসায় যায়। কিন্তু কেউই টাকা দেয় না। আসাদ মন খারাপ করে চলে এসে মাকে এসে জানায়। আসাদের মায়ের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি বের হতে থাকে।
আসাদ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা তুমি একটুও কেঁদো না। আমি মন খারাপ করিনি। আমার পাঞ্জাবী লাগবে না। তুমি আগে সুস্থ হও। তুমি ছাড়া আমার যে আর কেউই নেই। আমি তোমাকে চাই মা। আর কিছু চাই না।
এদিকে দেখতে দেখতে চাঁদ রাত চলে আসে। আকাশে চাঁদ উঠেছে রাত পোহালেই ঈদ। বাইরে ছেলে মেয়েরা ঈদের গান গেয়ে খুব মজা করছে। মসজিদের মাইক থেকে ঈদ মুবারাকের ধ্বনি ভেসে আসছে। কিন্তু আসাদের মনে একটুও আনন্দ নেই। কারণ মা তার আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সারা রাত আসাদ না ঘুমিয়ে মায়ের কপালে একটু পর পর পানিতে কাপড় ভিজিয়ে ভিজিয়ে জল পট্টি লাগিয়ে দেয়।

শেষ রাতে এক পর্যায়ে তার মা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যায়। আসাদ যখন বুঝতে পারে যে তার মা আর বেঁচে নেই তখন সে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। তার কান্নার আওয়াজ পেয়ে প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসে। আসাদের কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে দিনের আলো স্পষ্ট হতে থাকে। তার মাকে গোসল করানোর কাজ করা হয়। আসাদকে প্রতিবেশীরা গোসল করিয়ে ঈদের নামাজে নিয়ে যায়। তার চোখের পানি একটি বারের জন্য থামে না। ঈদগাহে মানুষ বিষয়টি জেনে অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।

তারপর ঈদের নামাজ শেষে তার মায়ের জানাজা হয়। ঈদগাহের সব লোক জানাজায় আসে। জানাজার পর ওদের বাসার পাশেই তার মাকে দাফন করা হয়। কবর দেয়ার পর সবাই তাকে অনেক ডাকে চলে আসার জন্য। কিন্তু আসাদ কিছুতেই তার মায়ের কবরের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সরে না। এক পর্যায়ে একে একে সবাই চলে যায়। আর আসাদ তার মায়ের কবরের পাশে বসে অনবরত চোখের পানি ফেলতে থাকে।