আল্লাহ সুবহানা ওয়া তাআলা যখন আদম আ. কে সৃষ্টি করলেন, তাঁকে সম্মানিত অবস্থানে আসীন করলেন তখন আরেকজন সম্মানের জায়গায় ছিলো। তার পদবী হয়েছিল মুয়াল্লেমুল মালাইকা। অর্থাৎ ফেরেশতাদের শিক্ষক। ফেরেশতারা তার কাছ থেকে ইবাদাতের নিয়ম কানুন শিখতো। কিভাবে আল্লাহর গুণগান গাইতে হবে তা শিখতো। তার নাম ছিল ইবলিশ। হযরত আদম আ.কে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে আল্লাহ তার সকল সম্মান মর্যাদা কেড়ে নেন। তাকে শায়তানির রাজীম-বা বিতাড়িত শয়তান ঘোষণা করেন। তখনো সে উর্ধ্বজগতে ছিল। কিন্তু সৃষ্টিজগতে তার মধ্যে প্রথম একটি খারাপ বৈশিষ্ট্য শুরু হলো। তা হচ্ছে হিংসা। হযরত আদম আ. এর সম্মান মর্যাদার প্রতি প্রচ- রকম হিংসা শুরু হলো শয়তানের। কিভাবে আদম আ. কে জান্নাত থেকে তাড়ানো যায়, তার কূটকৌশল চালতে শুরু করল সে। একসময় সফল হয়ে গেল। আল্লাহ হযরত আদম আ.কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। একইসাথে শয়তানও পৃথিবীতে চলে এলো। তার হিংসার ভান্ডার নিয়ে। পৃথিবীতে আসার আগেই সে আল্লাহর সামনে শপথ করে এসেছে যে সব মানুষকেই সে পথভ্রষ্ট করবে, আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। মানুষের মধ্যে হিংসা, ঘৃণা আর হানাহানি ছড়িয়ে শয়তান সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। পৃথিবীতে প্রথম হত্যার ঘটনাটিও হিংসার ফলেই সংগঠিত হয়। হাবিলের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে কাবিল তাকে হত্যা করে। শয়তান কাবিলকে হিংসুটে করে তুলেছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছো হিংসার প্রভাব কতটা ভয়াবহ।
হিংসা আসলে কী? ধরা যাক তোমার কোনো বন্ধু ক্রিকেটে খুব ভালো। তার বোলিং, ব্যাটিং অসাধারণ। তোমার ব্যাচের ক্রিকেট টিম গঠন হলে সে অগ্রাধিকার পায় টিমে। তুমি হয়তো মোটামুটি ক্রিকেট খেলো। টিমে তার অগ্রাধিকার দেখে তোমার মধ্যে দুই ধরনের অনুভূতি তৈরী হতে পারে- ১। ওর মতো ভালো খেলা যদি খেলতে পারতাম! ২। ও এত ভালো খেলে কেন? ওর কারণে আমরা দলে জায়গা পাই না, ওরে আর খেলতে দেয়া যাবে না। প্রথম অনুভূতিটা তোমাকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে। তোমার ভেতরে আরো ভালো খেলার উদ্দীপনা তৈরি করবে। এটাকে বলে ঈর্ষা। এটি কল্যাণকর।
দ্বিতীয় অনুভূতি অকল্যাণকর। এই অনুভূতি এলে তোমার মাথায় কূটবুদ্ধি তৈরি হবে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে তুমি সেই বন্ধুটির ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। হয়তো শিক্ষকের কাছে তার নামে অপবাদ অভিযোগ করবে অথবা তার শারীরিক ক্ষতি করবে। এটার নামই হিংসা। হিংসার আগুন তোমার ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। যতক্ষণ ওর ক্ষতি করতে না পারছো ততক্ষণ এই আগুন নিভবে না। আর এই আগুন জ্বলতে থাকা অবস্থায় অন্য কোনো ভালো চিন্তাও তোমার মাথায় ঠিকমত খেলবে না। এজন্য রাসুল সা. বলেছেনÑ ‘হিংসা আগুনের ন্যায়। আগুন যেমন লাকড়িকে খেয়ে ফেলে, হিংসাও তেমনি নেক আমলকে খেয়ে ফেলে। ’
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের উন্নয়ন করতে পারিনা কারণ আমরা অন্যের ক্ষতি করার জন্য নিজেদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে থাকি। সেটা হিংসার কারণেই। শুধুমাত্র হিংসার কারণেই অনেকের অধ:পতন হয়ে যায়। সে বুঝতেও পারে না। নবীজী সা. যখন অল্পবয়স্ক তখনও তিনি সবার কাছে আদুরে ছিলেন। তার চলাফেরায় জ্ঞান এবং সৌন্দর্য ফুটে উঠতো বলে যেকোনো সভায় গেলে বয়স্করা তাকে আদর করে কাছে টেনে নিতেন। সেসময় আবুল হাকাম (পরবর্তীতে যার নাম হয় আবু জাহেল) তাকে হিংসা করতেন। পরবর্তীতে নবীজি সা. দ্বীনের প্রচার শুরু করলেন, তখনও তাঁর জ্ঞানের কারণে আবু জাহেল তাকে হিংসা করত। মক্কার প্রভাবশালীরা নিজেদের প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা নষ্টের ভয়ে নবীজিকে হিংসা করে তাকে হত্যারও ষড়যন্ত্র করেছিল। মদীনাতে যখন নবীজি সা. এলেন তখন মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নবীজির নেতৃত্বকে হিংসা শুরু করে দেয়। নবীজি আসার আগ পর্যন্ত সে ছিল মদীনার অন্যতম বড় নেতা। কিন্তু নবীজি সা. যখন একচ্ছত্র নেতৃত্বের অধিকারী হন, তখনই তার হিংসা শুরু হয়। হিংসার কারণে তার মধ্যে ঈমান কাজ করেনি। সে মুনাফিক অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করে।
হযরত ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাকে হিংসা করত। কারণ তার বাবা তাকে বেশি আদর করতেন। হিংসার কারণে একসময় তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরে হত্যা না করে তাকে কুয়ায় ফেলে দিয়ে আসে। শুধুমাত্র হিংসার ফলে তারা আপন ভাইয়ের ক্ষতি করতে দ্বিধা করেনি।
হিংসা খুবই খারাপ স্বভাব। হিংসুটে ব্যক্তি যেকোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে। সেজন্য হিংসুকের হিংসা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ দোয়া করতে বলেছেন। নবীজি যখন দ্বীন প্রচার করছিলেন তখন এক ইহুদী নারীর মাধ্যমে নবীজিকে জাদু করা হয়। জাদুর প্রভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ সুরা ফালাক এবং সুরা নাস নাযিল করেন। এই সুরার মাধ্যমে তিনি জাদুর ক্ষতি থেকে মুক্তি পান। এই দুটো সুরা পড়লে হিংসুকের ক্ষতি থেকে বাঁচা যাবে। হিংসা যেকোনো বিষয় নিয়েই হতে পারে। কারো জ্ঞান, সম্মান, সম্পদ, গুণ, বংশ, সৌন্দর্য, পেশা, প্রতিষ্ঠান সব কিছু নিয়েই হিংসা হতে পারে।
হিংসুক থেকে নিজেরা বাঁচতে হবে এবং নিজেরাও হিংসা করা থেকে বাঁচতে হবে। সেটা কিভাবে? প্রথমত মানুষের ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করতে হবে। মানুষের ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা নবী রাসুলদের বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়ত, সর্বদা মানুষের কল্যাণ কামনা করা। বেশি বেশি সালামের প্রচলন করা। নবীজী সা. সালাম বা শান্তি ছড়িয়ে দিতে বলেছেন। যাকে অন্তর থেকে সালাম দেয়া হয়, তার প্রতি হিংসা আনা যায় না। তাই সবাইকে সালাম দিতে হবে এবং সেটি অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে দিতে হবে। তার কল্যাণ কামনা করতে হবে। যদি তার মধ্যে কোনো খারাপ বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে যেন আল্লাহ তাকে ভালো পথ দেখান, তার অন্তর পরিবর্তন করে দেন।
তৃতীয়ত, হিংসা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কারো প্রতি হিংসার মনোভাব তৈরি হলে নিজে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং সেই ব্যক্তির জন্যও আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। রাসুল সা. বলেছেনÑ যারা নিজেদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ রাখে, আল্লাহর দরবারে তাদের নেক আমল পৌঁছানো হয় না। সুতরাং হিংসার বাজে স্বভাব থেকে আমরা সবাই দূরে থাকার চেষ্টা করব।
হিংসামুক্ত হলে তোমার উপকার কী? হিংসামুক্ত হলে তোমার বন্ধু সংখ্যা বাড়বে। কারণ হিংসা বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে দেয়। হিংসামুক্ত হলে তুমি নিজের দিকে মনোযোগী হবার সময় পাবে। হিংসামুক্ত হলে তোমার মধ্যে গীবত করা বা গীবত শোনার ইচ্ছে হবে না। কারণ হিংসার প্রথম ধাপই হলো গীবত। কাউকে হিংসা করলে পেছনে আমরা তার বদনাম করি। হিংসামুক্ত হলে তুমি সেটি করতে আগ্রহী হবে না। হিংসামুক্ত হলে তোমার মধ্যে ঈমান পরিপূর্ণ হবে। কারণ যে হৃদয় হিংসার আবর্জনায় পূর্ণ তাকে তাতে ঈমানের নূর প্রবেশ করতে পারে না। হিংসামুক্ত হলে তোমার ইবাদাত, নেক আমলগুলো আল্লাহর কাছে বিশুদ্ধরুপে পৌঁছবে।
আমরা যদি একটি মোটর সাইকেল রেসের কথা কল্পনা করি, তাহলে বিষয়টি আরো সহজভাবে ভাবা যায়। মোটর সাইকেল রেসে তুমি নিজের মোটরসাইকেলের গতি বৃদ্ধি করে, নিজের চালানোর দক্ষতা বাড়িয়ে প্রথম হতে পারো। আবার গেমসে যেমন দেখায়, চলার সময় সামনের মোটর সাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েও নিজে এগিয়ে যেতে পারো। সেক্ষেত্রে নিজেও পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কোনটা ভালো? নিঃসন্দেহে নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধি করে প্রথম হওয়াটাই অভিনন্দনযোগ্য। তাই চলো হিংসামুক্ত কল্যাণকর সমাজ গড়ি।
হিংসুটে মন
শাকের জামিল