বন্ধুরা, আমাদের কানের ভেতরের অংশে তিনটি করে অর্ধ বৃত্তাকার নালী আছে। এগুলো এক ধরনের তরল পদার্থে পূর্ণ। আমাদের মাথা যখন ডান দিকে ঘোরে স্থিতি জড়তার কারণে এগুলো প্রবাহিত হয় বাম দিকে। মাথা বাম দিকে গেলে এরা যায় ডানে। ওপরে-নিচেও একইভাবে উল্টা দিকে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহের মাধ্যমে এরা নিখুঁতভাবে মস্তিষ্ককে জানান দেয়, আমাদের মাথা কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কত খানি ঘুরেছে আর ঘোরার গতিবেগ ছিল কত।
আমরা যদি আমাদের মোবাইল ফোনের ভিডিও ক্যামেরাটি অন করে শার্টের পকেটে রাখি, ক্যামেরার ফোকাস রাখি সামনে, তাহলে যে ভিডিওটি পাবো তা দেখব যে, প্রতিনিয়ত কাঁপছে, দুলছে। কারণ হাঁটার সময় আমাদের শরীর কেঁপেছে, দুলেছে; সাথে ক্যামেরার ফোকাসও প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের চোখ ভিডিও ক্যামেরার মতোই সারাক্ষণ ছবি তুলে যাচ্ছে। এগুলো মাথার সাথে সেট করা। মস্তিষ্ক অনেকগুলো মাংসপেশির সঙ্কোচন-প্রসারণের মাধ্যমে চোখের ফোকাস ঠিক করে। হাঁটার সময় আমাদের চোখের সামনের জিনিসগুলো কাঁপে না। কারণ কানের অর্ধ বৃত্তাকার নালী নিখুঁতভাবে আমাদের মাথা তথা শরীরের নড়াচড়ার সঙ্কেত পাঠায়। নড়াচড়ার পরিমাণ মেপে মস্তিষ্ক নিখুঁতভাবে চোখের মাংসপেশিগুলোকে সঙ্কোচন-প্রসারণের নির্দেশ পাঠায়।
ফলে আমাদের মাথা দোলে, শরীর দোলে কিন্তু চোখের ফোকাস দোলে না। ক্যামেরা এক জায়গায় স্থির রেখে ভিডিও করলে যে রকম সুন্দর ছবি পাওয়া যায় আমাদের শত নড়াচড়ার পরও আমরা সে রকম সুন্দর ছবিই আমাদের চোখে দেখতে পাই। আমাদের হাত-পা সঞ্চালনের জন্যও শরীরের নড়াচড়া পরিমাপের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও আরো অন্যান্য প্রয়োজন আছে।
বন্ধুরা, আমাদের ডান কান ও বাম কান থেকে সবসময় পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ সঙ্কেত মস্তিষ্কে আসে। যদি কোনো এক পাশের অর্ধ বৃত্তাকার নালী, তার সঙ্কেতবাহী স্নায়ু বা মস্তিষ্কের সঙ্কেতগ্রাহী অংশে কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে দুই পাশ থেকে আসা সঙ্কেতগুলোর মধ্যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না কোনটা ঠিক, তার কী করা উচিত। সে তখন তার সাথে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে উল্টাপাল্টা সঙ্কেত পাঠায়। আমাদের মাথা ঘুরতে থাকে, চোখগুলো ইতস্তত নড়াচড়া করতে থাকে। আমরা শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি, বমি আসে ইত্যাদি।
এটা হচ্ছে সত্যিকারের মাথাঘোরা। এই অভিজ্ঞতা যার হয়নি সে ছোটবেলার ঘূর্ণি খেলার কথা মনে করতে পারে। ছোটবেলায় শিশুরা খেলাচ্ছলে হাত দুটোকে পাখির ডানার মতো মেলে দিয়ে লাটিমের মতো ঘোরে। তারপর একসময় থেমে গিয়ে মজা দেখে। চারপাশের সবকিছু ঘুরছে, ভূতল দুলছে। এটাই হচ্ছে সত্যিকারের মাথা ঘোরার অনুভূতি।
সত্যিকারের মাথাঘোরা বলা এ কারণে যে, আরো অনেকগুলো অনুভূতিকে মানুষ মাথাঘোরা বলে প্রকাশ করে থাকেন। যেমনÑ চোখ অন্ধকার হয়ে আসা, শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, হাত-পায়ের অবস্থান বুঝতে সমস্যা হওয়া ইত্যাদি। এগুলো প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি। এগুলোর কারণ ও চিকিৎসাও ভিন্ন।
বন্ধুরা, চোখ অন্ধকার হয়ে আসার অনুভূতি অনেকেরই হয়ে থাকবে। বিশেষ করে বয়স্করা বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে হঠাৎ উঠতে গেলে এই সমস্যার সম্মুখীন হন। স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেকে চোখ অন্ধকার হয়ে পড়ে গেছে বা কাউকে পড়ে যেতে দেখেছ। এটা মাথাঘোরা নয়। কিন্তু অনেকেই এভাবে বলে, আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম বা পড়ার উপক্রম হয়েছিলাম। এটা আসলে মূর্ছা যাওয়া।
মস্তিষ্কের কিছু অসুখ আছে যেখানে রোগী তার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারেন না। হাঁটতে গেলে পড়ে যান। কখনো বা যেতে চান একদিকে কিন্তু যেতে থাকেন অন্যদিকে। শরীর যেন কথা শোনে না। বয়স্করা বিশেষ করে এসব রোগে বেশি ভোগেন। অবশ্য কম বয়সীদেরও এসব সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাথাঘোরার অনুভূতি না হলেও রোগীরা অনেক সময় বলেন, আমি মাথা ঘুরে পরে যাই বা আমার মাথা ঘোরে।
আমাদের শরীরের বা হাত-পায়ের অবস্থান জানিয়ে প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কে সঙ্কেত পাঠাচ্ছে কিছু স্নায়ু। ফলে আমরা না দেখেও বলতে পারি আমাদের পা’টা কী ভঙ্গিতে আছে, হাতটা কোথায় আছে। অন্ধকারেও এক হাত দিয়ে অন্য হাতের আঙুল অনায়াসে ধরে ফেলি। এটা আমাদের কাছে এত সহজ যে, কখনো চিন্তাও করে দেখি না এটা কিভাবে পারলাম। এসব স্নায়ু বা মস্তিষ্কের সঙ্কেতগ্রাহী অংশে কোনো সমস্যা হলে তখন আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থান বুঝতে অসুবিধা হয়। এটাকেও অনেক সময় রোগীরা বলেন মাথাঘোরা।
বন্ধুরা, কেউ যখন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বলে, আমার মাথা ঘুরছে তখন চিকিৎসক প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করেন আসলে রোগী কী বোঝাতে চাচ্ছে। কারণ শুধু আমাদের দেশে না, সারা দুনিয়াজুড়েই মানুষ নানা রকম অর্থে ‘মাথাঘোরা’ কথাটা ব্যবহার করে। আবার সত্যিকারের মাথাঘোরাকে একেকজন একেকভাবে প্রকাশ করে থাকে। যেমনÑ আমার প্রেসার কমে যায়, মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে, শরীরে ব্যালান্স পাচ্ছি না, আরো অনেক কিছু।
কারণ ভেদে মাথাঘোরা নানারকমের হতে পারে। কখনো এটা শুধু নড়াচড়ার সময় অনুভূত হয়। আবার কখনো সবসময় ঘুরতে থাকে। কখনো মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে আবার নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। কখনো বা কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কখনো একটানা চলতে থাকে কখনো আবার থেমে থেমে ফিরে ফিরে আসে। মাথাঘোরার সাথে যুক্ত হতে পারে মাথাব্যথা, ভারসাম্যহীনতা, অনুভূতিহীনতা, চোখে এক জিনিস দুইটা করে দেখা ইত্যাদি। এসব কিছুই কারণ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
মাথা ঘুরলে সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়। অনেক সময় তা ভয়ের ব্যাপারও বটে। কিন্তু সবসময় নয়। কিছু অসুখ আছে যেগুলো শুধু কাজেকর্মে অসুবিধা সৃষ্টি করে, বড় কোনো ক্ষতি করে না। তবে কিছু অসুখের আবার দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কখনো অনির্দিষ্টকাল ধরে এর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। মাথাঘোরার এমন কিছু কারণ আছে যেগুলো সার্জারি পর্যন্ত গড়ায়। আবার কখনো কখনো রোগীর জীবন হয়ে পড়ে হুমকির সম্মুখীন।
মাথাঘোরা সমস্যা
ডা: আশরাফ হোসেন