বোকা কমান্ডার

আরিফুল ইসলাম সাকিব

0
15

ছোট একটি বাগান। বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলগাছ রয়েছে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা নদী। নদীর পাশেই সবুজঘেরা ছোট একটি গ্রাম। গ্রামে একটি স্কুলও রয়েছে।
এই গ্রামেই ছিল সহজ সরল রহিম মিয়ার বাস। গ্রামের বাগানটি ছিল তার। প্রতি বছর প্রচুর ফল ধরে বাগানের গাছগুলোতে। বাগানটি ছিল তার একমাত্র আয়ের উৎস।

১৯৭১ সাল। দেশে যুদ্ধ লেগেছে। ঢাকায় গোলাগুলি হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। সরকার পাকিস্তান থেকে অগণিত সৈন্যসেনা অস্ত্রসহ পাঠাচ্ছে। গোলাগুলি দিনকে দিন বাড়তে থাকে। কিছু দিন পর রহিম মিয়ার গ্রামেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি ঢুকলো। হানাদার বাহিনী স্কুলে আশ্রয় নিলো। গ্রামের সবার মনে আতঙ্ক। তাদের বিশ্বাস, কেউ আর প্রাণে বাঁচতে পারবে না। পলাশ ছিল সেই গ্রামের নামকরা দুষ্টুছেলে।
একদিন হানাদার বাহিনীর কমান্ডার কয়েকজন সৈন্য নিয়ে বাগানে এলো। গাছে পাকা-পাকা সুস্বাদু ফল দেখে জিভে পানি চলে আসে। কাউকে কিছু না বলেই লিচুগাছ থেকে লিচু ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করে দেয়। এভাবে নানা ফল খেতে থাকে। রহিম মিয়া এ দৃশ্য দেখে ভয়ে চুপচাপ থাকে। প্রাণের ভয়ে কিছু বলার সাহস পায় না। মনে মনে ভাবে, বলা তো যায় না! কখন কাকে ধরে জনমের মতো শেষ করে দেয়। এভাবে রোজ-রোজ এসে বাগান থেকে যা ইচ্ছে খেয়ে যায়। খাওয়া শেষে যা পারে সাথে নিয়ে যায়। রহিম মিয়া খুব চিন্তিত। গ্রামের কয়েকজন লোককে জানাল। ভয়ে কেউ কিছু বলল না। আনমনে ভাবছে, কদিন ধরে বাগানের মালী পলাশও আসছে না। হয়ত হানাদার বাহিনীর কথা শুনেই আসছে না।
পলাশ, রহিম মিয়াকে চাচা বলে ডাকে। রোজ এসে রহিম চাচার সাথে কাজ করতো আর যা খুশি ফল খেতো। পলাশ জানতে পারলো বাগানের সব ফল হানাদার বাহিনী প্রতিদিন খেয়ে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। এক বিকেলবেলা পলাশ রহিম চাচার বাড়ি গেল। রহিম মিয়া পলাশকে দেখেই অবাক!
– তুই এ কদিন কোথায় ছিলি? জানিস বাগানের প্রায় সব লিচু খেয়ে ফেলছে। এ বছর হয়তো আর লিচু বিক্রি করা হবে না।
পলাশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। পরে বলল, একটা বুদ্ধি তো বের করতেই হবে। লিচুও বিক্রি করতে হবে।
– হানাদার বাহিনির কথা শুনেছিস। যাকে ধরে একদম মেরে পুঁতে ফেলে। কি করি বল?

পলাশ, রহিম চাচাকে অনেকক্ষণ বুঝাল। তারপর লিচু বিক্রি করতে রাজি হলো। সাত-সকালে লিচু পাড়তে বাগানে যায় দুজন। এ কথা হানাদার বাহিনীর কানে পৌঁছুতেই কয়েকজন সৈন্য এসে রহিম মিয়াকে ধমকাতে শুরু করল। লিচু যা পেড়েছিল সব নিয়ে যায়। আর বলে যায়, গাছ থেকে লিচু পাড়লে হাত-পা বেঁধে স্যারের (কমান্ডার) কাছে নিয়ে যাবো। স্যারের মেজাজ খুবই গরম। কখন কি করে বলা যায় না। কী আর করার! দুজন এক কোণে চুপচাপ বসে রইল। পলাশ মনে মনে ভাবে, কিছু একটা করতেই হবে। সেদিন দুজন বাড়ি ফিরে যায়।
পরের দিন বিকেলবেলা বাগানে হানাদার বাহিনীর কমান্ডারের সাথে কিছু সৈন্যরাও আসে। আম গাছ। তরতাজা লাল টুকটুকে আমগুলো কেউ পারত না। কারণ পাশেই ছিল বিষাক্ত ভিমরুলের বাসা। তাই ভয়ে কেউ গাছের আশে-পাশেও যায় না। কমান্ডার গিয়ে ওই গাছ থেকে আম পাড়া শুরু করে। একটা পেড়ে দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে খাচ্ছিল। আরেকজন সৈন্য গিয়ে আরেকটি আম পাড়ছিল। সাথেই সাথেই বিষাক্ত ভিমরুল এসে কামড় বসিয়ে দেয়। ভিমরুলগুলো ভন ভন করে সৈন্যদের কামড়ানো শুরু করলে যে যার মতো দৌড়ে পালায়।
সন্ধ্যায় দুষ্টু পলাশ তাদের দেখতে যায়। সবাই তো ওর ওপর খেপে আছে। পলাশ সুন্দর করে তাদের বুঝিয়ে বিষাক্ত জাগায় চুন লাগিয়ে দেয়। পলাশকে এভাবে সেবা করতে দেখে সৈন্যরা সবাই খুশি হয়। সকালবেলা কমান্ডার পলাশকে ডেকে এনে আবার চুন মালিশ করে নেয়।
পাকিস্তানি কমান্ডার ছিল পেটুক স্বভাবের লোক। সারাদিন খাই খাই করে। লোভ সামলাতে না পেরে পরেরদিন আবার গেল বাগানে। এবার কাঁঠালপাকা ঘ্রাণে মাতাল হয়ে গেল। জোর পূর্বক পলাশকে গাছে তুলে দিল। গাছে উঠে দেখল একটি কাঁঠাল পেঁকে একদম নরম হয়ে আছে। ওপর থেকে নিছে ফেললে ফেটে যাবে। তাই কমান্ডারকে বলল স্যার, কাঁঠাল ক্যাচ ধরতে হবে। নরম কাঁঠাল সরাসরি মাটিতে পড়লে ফেটে যাবে।

পলাশের কথায় কমান্ডার রাজি হলো। কাঁঠাল ক্যাচ ধরবে। পশাল, ওপর থেকে ছাড়লো। কাঁঠাল হাতে না পড়ে নিচে পড়ে ফেটে ছন্নছাড়া হয়ে গেল। তা দেখে পলাশ মিটমিট হাসছে!
কমান্ডারের অবস্থা দেখে পলাশ বলল স্যার, এখান থেকে কাঁঠাল নিয়ে যেতে পারেন। এক রাত রাখলেই পেকে যাবে। সবাই মিলে খেতে পারবেন।
পলাশ কাঁঠাল নিয়ে কমান্ডারের সাথে গেল। কাঁঠাল দেখে সৈন্যেরা খুব খুশি। একজন পলাশকে জিজ্ঞাস করল, কখন পাকবে? উত্তরে পলাশ বলে কালকেই খেতে পারবেন। কমান্ডার বলল, কাল বিকেলে তুই চলে আসবি। সবাই একসাথে কাঁঠাল খাবো।

পরের দিন বিকেলবেলা পলাশ গেল। কাঁঠাল ভাঙল। সবাই একসাথে খাওয়া শেষ করলো। তারপর সবার হাতে কাঁঠালের কষ লেগে যায়। এমতাবস্থায় কাঁঠালের কষ ছাড়াতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দুষ্টু পলাশ বুদ্ধি দিলো। স্কুলের পেছনে একটা গাছ আছে। ওইগাছের পাতা দিয়ে ডলা দিলেই চলে যাবে। বোকা কমান্ডার আদেশ দিলো বেশি করে পাতা নিয়ে আসার জন্য। এদিকে পলাশ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে এলো। সৈন্যরা বেশি করে বিছুটি গাছের পাতা নিয়ে আসে। সবাই বিছুটি পাতা দিয়ে হাত ডলা শুরু করলো। একটু পরেই চুলকানি শুরু হয়। চুলকাতে চুলকাতে সবার হাত ফুলে কলাগাছ। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের রক্তিম আভা। সন্ধ্যা নামবে। পলাশ আর দেরি করলনা। সে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিলো। ওই রাতে স্কুলে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। হুম, রাতেই সব হানাদার বাহিনী খতম। পলাশকে মুক্তিযোদ্ধারা স্যালুট জানালো। গ্রামের সবাই পলাশের এমন সাহসী ও মজার কাজে খুবই মুগ্ধ হন। রহিম চাচারও গর্বে বুক ভরে যায়।
নাজিরহাট, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম