পাঠক বন্ধুরা, শীতবুড়ির কুয়াশা ভেদ করে বসন্ত কোকিলের কুহুতানে মুখরিত হতে শুরু করেছে বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। বাংলার পরিবেশ প্রকৃতি এখন নতুন সাজে সজ্জিত হচ্ছে। এমন মনমাতানো বর্ণিল রঙ-বেরঙের দেশ পৃথিবীর আর কোথায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মায়াভরা বাংলার আলো বাতাসে গড়েওঠা ক্রিকেটারদের জয়ের গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে এ মাসের লেখাটি। আশা করি ভালো লাগবে।
ম্যাচ উইনার ক্রিকেটার যেকোনো দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ। যারা বিপদের মুহুর্তে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে বর্তমানে ম্যাচ উইনার হিসেবে যারা আছেন তাদের মধ্যে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অন্যতম। তবে চট্টগ্রামের মাটিতে নতুন দুই ম্যাচ উইনার টাইগারের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশসহ গোটা ক্রিকেট বিশ^। তারা হলেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও আফিফ হোসেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দল হিসেবে আফগানিস্তান নতুন হলেও প্রায় সময়ই তারা বাংলাদেশের সামনে আতঙ্ক প্রদর্শন করে থাকে। রশিদ খান, মোহাম্মদ নবীরা ব্যাট-বলের কারিশমাতে এলোমেলো করে দেন বাংলাদেশের জয়ের তরী। এর সাথে যুক্ত হওয়া আরেক বোলার হলেন ফজল হক ফারুকী। যিনি সম্প্রতি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে তামিম-সাকিবদের এমনভাবে ধাক্কা দিয়েছেন, যা কাছে-দূরের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের মনে দাগ কেটেছে।
এই খেলায় প্রতিপক্ষের দেয়া মাত্র ২১৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৫ রানেই ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। বাঁহাতি পেসার ফজল হক ফারুকী ১০ বলের ব্যবধানে তুলে নেন ৪ উইকেট। যার প্রথম দুটি লিটন ও তামিমের। আম্পায়ারকে চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ নিয়ে ফেরান এই দুই ওপেনারকে। পরবর্তীতে মুশফিককে এলবিডব্লিউ ও অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বিকে করেন বোল্ড। বাঁহাতি এই আফগান পেসারের গতি, বৈচিত্র্য বুঝে ওঠার আগেই যেন পথ হারায় স্বাগতিক রা। এমন করুণ পরিস্থিতিতে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ বেশ কয়েকবারই বাংলাদেশকে হাসিয়েছেন।
কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে তাদের জোড়া সেঞ্চুরির কথা নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই দুই নির্ভরযোগ্য ম্যাচ উইনার ব্যাটসম্যানও উইকেট উপহার দিয়ে আসেন আফগান বোলার যথাক্রমে মুজিব ও রশিদকে। বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে তখন লেখা ৪৫ রানে ৬ উইকেট!
সেই অবস্থান থেকে মিরাজ ও আফিফ প্রতিটি বলকে যোদ্ধার মতো লড়ে জীবনের সেরা ইনিংস খেলেছেন এবং বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছেন এক রূপকথার জয়। সঙ্গে নতুন এক সিঁড়িতে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশকে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে নতুন দুই ম্যাচ উইনারকে। যারা হবেন আগামী দিনের কাণ্ডারি, সাকিব-মাহমুদউল্লাহদের উত্তরসূরি।
জয় নিশ্চিতের পর মিরাজ কিছুটা উৎফুল্লতা দেখালেও আফিফ ছিলেন একদমই শান্ত। পরিশ্রান্ত মনে পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন। দুজনের সপ্তম উইকেটে জুটির দ্বিতীয় বিশ্বরেকর্ড ১৭৪ রান জ্বলজ্বল করছিল সেই স্কোরবোর্ডেই। এই জয় যেনো কল্পনাকেও ছাড়ানো জয়! অসাধারণ তাদের লড়াই। ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর যারা খেলা দেখা বন্ধ করেছিলেন এ জয়ের ঘটনা তাদেরকে নিশ্চয়ই চকমিত করে তুলেছে। মনের অকপটে প্রশ্ন উঠেছিলÑ ঘটনাটি কি সত্যি, নাকি সব রূপকথার গল্প!
ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে ফিফটি তুলে ৯৩ রানে অপরাজিত থাকেন আফিফ। অন্য দিকে মিরাজ দ্বিতীয় ফিফটি তুলে অপরাজিত সর্বোচ্চ ৮১ রানে। চার ছক্কা ও বল খেলায় দুজনেই প্রায় সমানতালে এগিয়েছিলেন। বাঁহাতি আফিফ ১১৫ বলে ১১ চার ও ১ ছক্কা হাঁকিয়েছেন। আর মিরাজ ১২০ বলে ৯ বাউন্ডারিতে সাজান স্মরণীয় ইনিংসটি।
এমন একটি জয়, এমন একটি বীরত্বগাথা স্মৃতি আজীবন উৎসাহ আর প্রেরণা জোগাবে আফিফ ও মিরাজকে। নিয়ে যাবে অনেক দূর। এমন একটি বিজয় শুধু বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছেই নয়; বরং বিশ^ ক্রিকেটের সমর্থকের কাছেও স্মরণীয় গল্প হয়ে বেঁচে থাকবে।
এদিকে মিরাজ-আফিফের বীরত্বগাথা জয়ে রেকর্ড ইতিহাসে কিছু ভাঙা-গড়ার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ওলটপালট হয়েছে রেকর্ডবুক। এবার জেনে নিবো সেই রেকর্ডসমূহ-
সপ্তম উইকেটে সামান্যের জন্য বিশ্বরেকর্ড গড়া হয়নি আফিফ ও মিরাজের। ১৭৪ রানের জুটি গড়েছেন তারা। ওয়ানডে ইতিহাসে সপ্তম উইকেটে এর চেয়ে বড় রানের জুটি আছে আর মাত্র একটি। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও আদিল রশিদ সপ্তম উইকেটে ১৭৭ রানের জুটি গড়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
রান তাড়া করতে নেমে সপ্তম উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটির বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশের এই দুই উদীয়মান তরুণ ব্যাটসম্যান। এর আগে ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও ক্রিস ওকস নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৮ রান করেছিলেন।
বিশ্বরেকর্ড গড়া না হলেও বাংলাদেশের হয়ে সপ্তম উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি হয়েছে। এর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইমরুল কায়েস ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন গড়েছিলেন ১২৭ রানের জুটি।
সাত নম্বর পজিশনে ব্যাটিংয়ে নেমে ৯৩ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেছেন আফিফ হোসেন যা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৩ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭৫ রানে অপরাজিত ছিলেন ম্যাচ উইনার ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। উক্ত ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন আফিফ। তবে মিরাজ ৮১ রানে ইনিংস খেলে পেয়েছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। এক্ষেত্রে তাকে এগিয়ে নিয়েছে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। বল হাতে ১০ ওভারে ৩ মেডেনে ২৮ রান দিয়েছেন এই ডানহাতি অফস্পিনার। তার ৮১ রানের ইনিংসও অষ্টম উইকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে নাঈম ইসলাম ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭৩ রান করেছিলেন। তবে তার এই ৮১ রান সফল রান তাড়ায় বিশ্বরেকর্ড বটে। এর আগে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের
হেথ স্ট্রিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৯ রানে অপরাজিত ছিলেন।
৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারানোর পর সপ্তম উইকেটে সর্বোচ্চ ১৭৪ রান তুলে জয়ের রেকর্ড হয়েছে বাংলাদেশের। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার গ্যারি গিলমোর ও ডগ ওয়ালটার্স ৫৫ রান করে দলকে জেতাতে ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া ৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারানোর পর আফিফ ও মিরাজের ১৭৪ রানের জুটিও সবচেয়ে বড়। এর আগে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে সংযুক্ত আবর আমিরাতের আমজাদ জাভেদ ও নাসির আজিজ ১০৭ রান করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
এছাড়া আফগানিস্তানকে এই হারের মধ্য দিয়ে ২৯তম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ যা দেশের মাটিতে বাংলাদেশের ২৩তম সিরিজ জয়। দেশের বাইরে আছে ৬টি সিরিজ জয়ের রেকর্ড। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ এর আগে ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে একটি। ২০১৬ সালে খেলা সেই সিরিজটি বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে জিতে ছিল। দ্বিতীয়বারের মতো খেলা সিরিজে এবারও ২-১ ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জেতে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটি ৩-২ ব্যবধানে জিতে নেয় বাংলাদেশ। এরপর সাফল্যের খাতায় একে একে নতুন সিরিজ যুক্ত হয়। তবে দেশের বাইরে প্রথম সিরিজ জেতে ২০০৬ সালে। কেনিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত সিরিজটিতে ৩-০ ব্যবধানে জয় পায় হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল। বিদেশের মাটিতে সবশেষ ওয়ানডে সিরিজ জয়লাভ করে ২০২১ সালের জুলাইয়ে। জিম্বাবুয়ের মাটিতে অনুষ্ঠিত সিরিজটিতে তাদেরকে ৩-০ ব্যবধানে হারায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন ম্যাচ উইনার ক্রিকেটার বার বার আসুক। বীরত্বগাথা ইতিহাস রচিত হোক একের পর এক। বিশ^দরবারে শির উড়ুক লাল-সবুজের পতাকা। প্রাণ উজাড় করে হাসুক সারা বিশে^ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো কোটি বাংলাদেশী। এই আমাদের প্রত্যাশা।