গত সংখ্যার পর
চৌদ্দ
জাফর আঙ্কেলের জামিন হয়েছে। এই দেশে থাকার বৈধ কোনো কাগজপত্র না থাকায় ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। গেলবার ছোট মামীর সাথে রাজশাহী এসে বড় উকিলের সাথে কথা বলে গিয়েছিল ইফতু। ছোট খালুর পরিচিত উকিল। তিনি বলেছিলেন, উচ্চ আদালত করতে পারলে সহজেই জামিন করানো যাবে। তবে এজন্য বেশ খরচাপাতি করতে হবে। খরচ ইফতু পাঠিয়েছিল এবং কাজও হয়েছে। দিলরুবার আম্মুকেও কিছু টাকা পাঠিয়েছে ইফতু আর বলে দিয়েছে, জাফর আঙ্কেল যেন খুব দ্রুত তার পাসপোর্টটা করে ফেলেন।
আজ ওরা এসেছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। উদ্ধারকৃত স্বর্ণগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে ওরা এসেছে তার সাথে কথা বলতে। ডিসি সাহেব এষাকে দেখেই চিনে ফেললেন। সেদিন পুরস্কার নিতে গিয়ে স্কেটিং করে পুরো ক্রীড়া কমপ্লেক্স কাঁপিয়েছিল এষা। ইউসুফপুর ইউনিয়নের চৌধুরী বাড়ির কথাও তার কানে এসেছে সেদিনের ডাকাতির ঘটনার পর।
ডিসি সাহেব অত্যন্ত ভালো মানুষ। নীতিবান এবং সৎ প্রশাসক হিসেবে পুরো রাজশাহী বিভাগে তার সুনাম রয়েছে। গুপ্তধনের বিষয়টা শুনে তিনি নড়েচড়ে বসলেন। এখন কি এইসব বিষয়ে কেউ ডিসিকে জানাতে আসে? কেউ গুপ্তধন পেলে নিজেরাই মেরে দেয়। আর জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশ গিয়ে ক্রোক করে নিয়ে আসে সব। তবে গুপ্তধনের একটা সুন্দর আইন কিন্তু আছে। সবাইকে চা-বিস্কুট দিতে বলে তিনি ১৮৭৮ সালের গুপ্তধন আইনটি ব্যাখ্যা করলেন।
প্রথম কথা হচ্ছে গুপ্তধন পেলে তা অবশ্যই প্রশাসনকে জানাতে হবে। কেউ যদি তা না জানায় তবে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য তার এক বছরের কারাদ-ও হতে পারে।
দ্বিতীয় কথা হলো, গুপ্তধন পাবার পর যদি এর মালিককে খুঁজে পাওয়া যায় তবে উদ্ধারকারী এবং সম্পদের প্রকৃত মালিকের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে এটা ভাগাভাগি হতে পারে। জমির মালিক অন্য কেউ হলে সে-ও এর থেকে ভাগ পাবে।
যদি সমঝোতা না হয় কিংবা সম্পদের মালিকানা নিয়ে সন্দেহ থাকে তবে সরকার চাইলে উদ্ধারকারীকে চার ভাগের তিন ভাগ সম্পদ দিয়ে দিতে পারে। তবে গুপ্তধন অবশ্যই প্রথমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।
– সরকারি কোষাগারে একবার কোন সম্পদ জমা হলে সেটা কি আর জনগণ ফিরে পায় কখনো? সেই সম্পদ উদ্ধার তো গুপ্তধন উদ্ধারের চাইতেও কঠিন কাজ, সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল এষা। হা-হা করে হেসে ফেললেন ডিসি সাহেব।
– তুমি ঠিকই বলেছো মা মণি। সরকার বা প্রশাসন সম্পর্কে জনগণ এরকমই ভাবে। অথচ গুপ্তধনের ব্যাপারে আইনের বিধান হলো তা অবশ্যই এর প্রকৃত মালিক এবং উদ্ধারকারীর মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বন্টন করে দিতে হবে। অবশ্য বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে একটা কথা বলা আছে,
‘বাংলাদেশের যেকোনো মাটির অন্তঃস্থ সব খনিজ ও মূল্যবান সামগ্রীর মালিক প্রজাতন্ত্র।’
এই ধারার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অনেকে গুপ্তধনকেও পুরোপুরি রাষ্ট্রের সম্পদ মনে করে ফেলে। আসলে এই কথাটা প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন তেল-গ্যাস-কয়লা প্রভৃতি। কেউ তার ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ কেবল মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছে এই অজুহাতে সেটা সরকারের হয়ে যেতে পারে না।
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ থেকে চার পাঁচজন সুদক্ষ মিস্ত্রি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ইফতুর নানার নতুন চরে প্রবেশ করেছেন মৃণাল সেন। প্রকল্পের অবস্থা বুঝে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছেন তিনি। আহাদ আঙ্কেলের বদলে চারঘাট থানায় যিনি এসআই হয়ে এসেছেন, মানে ইউসুফপুর ইউনিয়নের ডিউটি অফিসারকে মোটা অংকের টাকা খাইয়েছেন। এলাকার মাসলম্যানরা যাতে কোনো উটকো ঝামেলা তৈরি করতে না পারে সে জন্য আশেপাশে তার নিজস্ব বাহিনী ফিট করে রেখেছেন। নানা ভাইয়া শেষবারের মতো সতর্ক করেছিলেন, রেজিস্ট্রি হবার আগে যেন জমি নিয়ে কোনো কা- না করে মৃণাল সেন। কিন্তু সে কথা কানে তোলেননি জনাব সেন। নানাভাইকে বরং উল্টো দাওয়াত করেছেন চরের ভেতরে পিকনিক হচ্ছে বলে। দক্ষিণ প্রান্তে প্রস্তুত রেখেছেন দ’টো স্পিডবোট। যেন গুপ্তধন উদ্ধার হলে সেটা নিয়ে সহজেই সটকে পড়তে পারেন। লোকটা বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া দুটো দেশেরই পাসপোর্ট এবং ন্যাশনাল আইডি কার্ড বানিয়েছেন বলে মনে হয়।
লোহা কাটার মিস্ত্রিরা এক দুপুর পরিশ্রম করে লোহার ভারী বক্সটার কেবল একটা পাল্লা খুলেছে অমনি পুরো চরটা ঘিরে ফেলল রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ, নৌ-পুলিশ এবং বিজিবি। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঢুকলো জঙ্গলের ভেতর। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাথে ইফতু আর সাজিদও আছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল পরিত্যক্ত নৌ-যানটার কাছে। ভেতরে আবার লোহা কাটার কাজ শুরু হয়েছিল। বাইরে পুলিশের তীব্র হুইসেলের শব্দ শুনে ধরমর করে উঠে এলেন মৃণাল সেন।
– স্যার, আপনারা! সবগুলো দন্ত বিকশিত করে বললেন মৃণাল সেন।
– এখানে কি করছেন?
– এটা আমি কিনে নিয়েছি চৌধুরী সাহেবের কাছ থেকে। কি ব্যাপার খোকারা, বল বল! তোমাদের নানা ভাইয়ের কাছ থেকেই তো কিনেছি ।
– জি, বায়না করেছেন। এখনো রেজিস্ট্রেশন হয় নাই।
– ওই হলো। এখানে একটা পিকনিক স্পট করতে চাই আমি। একটা বাংলোর মতন তুলব। জায়গাটা খুঁড়তে গিয়ে দেখি লোহা-লক্কড়।
– লোহা লক্কর মানে? চলুন দেখি ভেতরে। গুহার অভ্যন্তরে ঢুকলো ম্যাজিস্ট্রেটসহ দুজন পুলিশ। সাথে ইফতু এবং সাজিদ ।
– স্যার এটাই হচ্ছে সেই লোহার সিন্দুক, যার ভেতরে রয়েছে মোঘল রাজপরিবারের স্বর্ণমুদ্রা।
থতমত খেয়ে গেলেন মৃণাল সেন ।
– এ তুমি কি বলছ খোকা? এটা সিন্দুক হলে এর পাল্লা কোথায়, ডালা কোথায়?
পাল্লাও আছে ডালাও আছে। সে ম্যাকানিজম জানা থাকলে অনেক আগেই আপনি এর ভেতরকার সব সম্পদ হাওয়া করে দিতেন।
– তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কি করে খোকা?
– নিশ্চিত আপনিও কম কিসে? ভল্টটা খোলার একটা নির্দেশিকা আমার কাছে আছে এই সন্দেহে পুরো বাড়িতে ডাকাতি করিয়েছেন।
– স্যার, এরা যা বলছে সব অসত্য। কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না।
– কাগজটা না পেয়ে এই আগাছা জঙ্গলে ভরপুর চরটা নানা ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক দামে কেনার জন্য বায়না করেছেন।
– স্যার, আপনি এই বাচ্চা দুটো ছেলের কথা শুনে এত কষ্ট করে এই জঙ্গলে এসেছেন?
– বাচ্চা হলেও ওরা যা করেছে সেটা প্রশংসনীয়। এই ভল্ট থেকে স্বর্ণ উদ্ধার করে ওরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে, আর আপনি সেটা জানেন না বলে এটা ভাঙার চেষ্টা করছেন। তোতলাতে শুরু করল মৃণাল সেন।
– তো.. তোমরা উদ্ধার ক…করেছো সোনা?
– হ্যাঁ। নানাবাড়িতে যেদিন ডাকাতি করছিল আপনার লোকজন, উদ্ধারকৃত সোনাগুলো তাদের চোখের সামনেই ছিল। ধানের বস্তার মধ্যে। ওরা বুঝতেই পারেনি। এত বোকা লোক নিয়ে আপনি গ্যাং চালান কিভাবে?
কারো মুখে কোনো কথা নেই। ইফতু বলে যাচ্ছে
– একটা পাল্লা খুলতে আপনাদের কত সময় লেগেছে?
– প্রায় সারাদিন। মিস্ত্রিদের একজন বলল।
– দেখুন স্যার, আমি কয় মিনিটে খুলি। ঘড়ি দেখুন স্যার।
প্রতিটা পাল্লা খুলতে ৩০ সেকেন্ড সময় নিল ইফতু। মাত্র ২ মিনিটে চারটে পাল্লা খুলে ভেতর থেকে স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটা রুপার রেকাবি এনে মৃণাল সেনের চোখের সামনে তুলে ধরল ও। চোখের সামনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন মৃণাল সেন। সবাইকে অ্যারেস্ট করার হুকুম দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। নিরীহ মিস্ত্রীদেরকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে গুহা থেকে বের হয়ে এলো ওরা।
ইফতুর স্কুল খুলেছে এক সপ্তাহ। নতুন ক্লাস, নতুন বই ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাবার সাথে বাড়ি আসার পর মা আর ঢাকা যাননি। বলা যায় যাবার অবকাশ পাননি। বাড়িতে এখন নানা ভাইয়ের নেতৃত্বে নানান সংস্কার কাজ চলছে। গুপ্তধনের বিষয়টা এলাকায় একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে তবে এই সম্পদে ইফতুর নানাবাড়ির কতটুকু ভাগ আছে তা কেউ জানেনা। এমনকি নানা ভাই আর ছোট মামী ছাড়া গুপ্তধন আবিষ্কারের বিষয়টা সবার কাছে ধোঁয়া ধোঁয়াই। পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে মাত্র দশটা মুদ্রা ওরা রেখে দিয়েছে। সে তথ্য জেলা প্রশাসনে জানানো আছে। তবে এই মুদ্রার একটি বিক্রয় করেই যে আড়াই কোটি টাকা পাওয়া গেছে সেটা সম্ভবত বললেও বিশ্বাস করবে না কেউ। টাকাগুলো ছোট মামীর একাউন্টেই আছে। দরকার মতো খরচ করা হচ্ছে। কুসুম আপুর পরীক্ষা বলে অর্থ ব্যবস্থাপনাটা ইফতু , নানাভাই আর ছোট মামীর ওপর ন্যস্ত।
কুসুম আপুর আম্মু এ বাড়িতে স্থায়ী হয়েছেন। তার জন্য আলাদা ঘর তোলা হচ্ছে। তবে সেজো মামীকে ছেড়ে অন্য কোনো ঘরে থাকবে না বলে সাফ সাফ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে কুসুম আপু । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকগুলো টিচার এসে পড়িয়ে যায় কুসুমদের। কুসুমের ক্লাসের যাদের স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য নেই তাদের সবাইকে আসতে বলেছে কুসুম। রীতিমত কোচিং সেন্টার হয়ে গেছে নানা ভাইয়ের কাচারী ঘরটা।
সাজিদ ওর বাবার ব্যবসায় সময় দেয়া শুরু করেছে। বাবার সাথে বার দুই গোদাগাড়ীও গিয়েছে। একটা মানুষ সারা জীবন লোকসান দিতে পারে না। বাদামের দর তলানীতে ঠেকলে আরো কিছু বাদাম রাখা হয়েছে সাজিদের পরামর্শে, নানা ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা এনে। সব মিলিয়ে এখন লাভে আছে। ছেলের এহেন ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে ওর বাবাও খুব খুশি।
মৃণাল সেনের এক বছরের কারাদ- হয়েছে। তবে মাদক পাচারের সঙ্গে তার কিছু সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আরো একটি মামলা দেয়া হয়েছে তার নামে। সরকার বাদী মামলা। দোষ প্রমাণিত হলে সাজার মেয়াদ আরো বাড়বে। আফসোস কেবল একটাই, রাজশাহী কারাগারে দেখা হলো না দুজনের, ভাবছে ইফতু। জাফর আঙ্কেলের জামিন আর কটা দিন পরে, মৃণাল সেনের চোখের সামনে দিয়ে হলেও মন্দ হ তো না।
ইফতুর বিদায়ের দিন সবাই কাঁদলো। সবচেয়ে বেশি কাঁদলেন সেজো মামী। একটা মাস যেন উজ্জ্বল করে রেখেছিল সারা বাড়ি ছেলেটা। নানা ভাইকে বলে সেজো মামীর জন্য সমস্ত গয়না নতুন করে গড়ে দেয়া হয়েছে। এ গয়নাগুলোই নানা ভাইয়ের দুর্দিনে তথা সংসারের প্রয়োজনে অবলীলায় উজাড় করে দিয়েছিলেন সেজো মামী। ইফতুর বিদায়ের আগের রাতে তাই অনেকটা নাটকীয়ভাবে যখন সেজো মামীর হাতে গয়নাগুলো তুলে দেওয়া হলো, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তার সে অশ্রুজলের প্রত্যেকটা ফোটার মর্ম পরিবারের অন্য সদস্যরা অনুধাবন করতে পেরেছিল।
চলবে…