বন্ধুরা, তোমাদের মধ্যে কারো যদি যথেষ্ট পারিমান পানি পান করার পরও বারবার তৃষ্ণা পায়, গলা শুকিয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে সে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতায় ভূগছে। যখন শরীর থেকে বেশি পরিমানে পানি বেরিয়ে যায়, তখন পানিশূন্যতার সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। এটা শিশু থেকে শুরু করে সবারই হতে পারে।
বেশিরভাগ মানুষ দেহের পানিশূন্যতা তিন থেকে চার ভাগ পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। পাঁচ থেকে আট শতাংশ পানি হ্রাস পেলে ক্লান্তি এবং মাথা ঘুরতে পারে। শরীরের মোট পানির দশ শতাংশেরও বেশি হ্রাস হলে তীব্র তৃষ্ণার সাথে শারীরিক ও মানসিক অবনতি ঘটতে পারে। দেহের পানি হ্রাস থেকে পঁচিশ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
গরমে পানিশূন্যতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। কারণ এসময় অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরের প্রয়োজনীয় পানির অনেকটাই বের হয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণ না হলে দেখা দিতে পারে পানিশূন্যতা। তবে শুধু গরমের কারণেই নয়, ডায়রিয়া, বমি, জ্বর ইত্যাদি কারণেও দেখা দিতে পারে পানিশূন্যতা। অনেক সময় অতিরিক্ত শরীরচর্চার কারণে দেখা দিতে পারে এই সমস্যা। এছাড়া বিভিন্ন রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, কিডনিজনিত সমস্যা কিংবা আবহাওয়া অতিরিক্ত গরম বা ঠা-া হলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
পানিশূন্যতা হলে গলা শুকিয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত পিপাসা লাগা, প্রসারের পরিমান কমে যাওয়া, প্রসাবের রঙ গাঢ় হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, মাথা ঘোরা কিংবা চক্কর দেওয়া, দুর্বলতা, মাংসপেশীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, অচেতন হয়ে পড়া, বুক ধড়ফড়, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
বন্ধুরা, এবার এসো আমরা জেনে নিই, এ গরমে পানিশূন্যতা দূর করতে যা খাওয়া উচিত। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে পানির পাশাপাশি দেখা দেয় খনিজ পদার্থের ঘাটতিও। তাই এসময় ডাবের পানি, লাচ্ছি, ঘোল ইত্যাদি খাওয়া ভালো। পটাশিয়ামের অভাব পূরণের জন্য নিয়মিত পাকা কলা খাওয়া যেতে পারে। অনেকের বারবার কফি খাওয়ার অভ্যাস। অতিরিক্ত কফি পান করলে তা শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি করে। গরমে কফি, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
পানি : সারা দিনে ১০-১২ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পাশাপাশি লেবু বা ফলের শরবত খেতে পারো। শরীরে অতিরিক্ত পানিশূন্যতা দেখা দিলে ডাবের পানিও পান করতে পারো। ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমানে সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম থাকে। এটা প্রাকৃতিক উপায়ে দেহে পানির ঘাটতি পূরণ করে। এসব পানীয় খুব সহজেই শরীরের পানির চাহিদা পূরণ করবে। ডাবের পানি ও ফলের শরবত খেলে পানির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় খনিজ লবণের চাহিদাও পূরণ হবে। ঘরে তৈরি স্যালাইনও পানির চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে।
সবজি : ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, লাউ, পেঁপে ও পালংশাকে পানির পরিমাণ ৯০ শতাংশের বেশি থাকে। পানিশূন্যতা দূর করতে এই খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় রাখতে পারো।
স্যুপ : বিভিন্ন প্রকার সবজি ও মুরগির মাংস দিয়ে রান্না করা স্যুপ খেতে পারো। সবজি ও মুরগির মাংস দুটিই সহজপাচ্য। এগুলোয় পানির পরিমাণ বেশি থাকায় (প্রায় ৯২ শতাংশ) পানিশূন্যতাও দূর করে।
তরমুজ : গরমে স্বস্তি পেতে খেতে পারো এ সময়ের সুস্বাদু ও জনপ্রিয় ফল তরমুজ। এটি শরীরে পানির অভাব পূরণ করে। তরমুজের প্রায় ৯২ শতাংশই পানি। গরমে পানিশূন্যতা দূর করতে তাই তরমুজের ভূমিকা অপরিসীম। ফল হিসেবে অথবা জুস কিংবা স্মুদি, যেকোনো উপায়ে তরমুজ খাওয়া যায়। এতে খুব সহজেই পানিশূন্যতা দূর হয়। এই ফলে আছে ফাইবার, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, পটাশিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট লাইকোপিন ও ম্যাগনেসিয়াম। যে কারণে এটি তীব্র গরমেও তোমাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। তরমুজ ফ্রিজে রেখেও খেতে পারো। তবে, এটি খাওয়ার পরপরই পানি পান করবে না।
কলা : কলায় প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল আছে। পানিশূন্যতা ও দুর্বলতা দূর করতে কলার বিকল্প নেই। সকালের নাশতায় কিংবা ব্যায়ামের আগে কলা খেয়ে নিলে যেমন শক্তি পাওয়া যায়, তেমনি শরীরের পানির চাহিদা পূরণ হয়। ডায়রিয়ার কারণে শরীরে পটাশিয়ামের যে ঘাটতি হয় তা পূরণ করতে সাহায্য করে কলা। আপেল, কমলা কিংবা ক্যানবেরি জুসও শরীরে পানিশূন্যতা দূর করতে দারুনভাবে সাহায্য করে।
শসা : গরমের সময়ে আরেকটি সেরা খাবার হলো শসা। এটি পানিশূন্যতা রোধ করতে সাহায্য করে। শসায় আছে ভিটামিন কে, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম। শসার প্রায় ৯৬ শতাংশই পানি। সবচেয়ে উপকারী দিক হলো, এতে ক্যালোরি থাকে খুবই কম। এটি ডিটক্স হিসেবেও ভালো কাজ করে। নিয়মিত শসা খেলে দূর হয় শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ। এটি ত্বককে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখে। তাই এ গরমে প্রতি বেলায় সালাদ হিসেবে শসা খাবে। সালাদে শসার সঙ্গে লেটুসপাতাও খেতে পারো। লেটুসপাতায়ও ৯৬ শতাংশ পানি থাকে। শসার জুস করেও খেতে পারো। স্ন্যাকস হিসেবেও নাশতায় শসা যোগ করা যায়। এতে সহজেই সতেজ ভাব আসে।
টমেটো : টমেটোর প্রায় ৯৪ শতাংশ পানি। সালাদ, স্যুপ, জুসসহ বিভিন্নভাবে টমেটো খাওয়া যেতে পারে। টমেটোর তরকারিও পানির চাহিদা পূরণে সহায়ক। নিয়মিত টমেটো খেলে পানির পাশাপাশি শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদাও পূরণ হয়। টমেটো প্রায় সব মৌসুমেই পাওয়া যায়। টমেটো রান্না করে কিংবা কাঁচা খাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি উপকার পাবে কাঁচা খেলে। টমেটোর সালাদ বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। টমেটোতে আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ২, ভিটামিন সি, ক্রোমিয়াম, ফোলেট, ফাইবার, পটাশিয়াম এবং ফাইটোকেমিক্যাল জাতীয় পুষ্টি। নিয়মিত টমেটো খেলে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অটোইমিউন ডিসঅর্ডারের ঝুঁকি কমে।
আম : আমকে বলা হয় ফলের রাজা। পুষ্টিগুণে ভরা এই ফল শরীরের জন্য নানাভাবে উপকার বয়ে আনে। আমে প্রচুর ক্যালোরি থাকে। উপকারী এই ফলে আছে ভিটামিন এ এবং সি, ফাইবার, সোডিয়ামসহ ২০টিরও বেশি খনিজ। নিয়মিত আম খেলে বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থুলতা ইত্যাদি সমস্যা প্রতিরোধেও সাহায্য করে। আমের প্রায় ৮৮ শতাংশই পানি। যে কারণে গরমে আম খেলে পানিশূন্যতা দূর হয় অনেকটাই।
লেবু : এই গরমে লেবুর চেয়ে উপকারী আর কী হতে পারে! ভিটামিন সি যুক্ত এই ফলের রস তোমাকে সারাদিন সতেজ অনুভূতি দেবে। লেবুর শরবত হতে পারে গরমে সবচেয়ে সুস্বাদু পানীয়। তবে শরবতে খুব বেশি চিনি মেশাবে না। লেবুতে থাকা পটাশিয়াম শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ঘামের কারণে শরীরে খনিজের যে ঘাটতি তৈরি হয় তার অনেকটাই পূরণ করে লেবু। লেবুর প্রায় ৮৮ শতাংশ পানি। এতে আরও আছে ক্যালসিয়াম ও ফাইবার।
দই : দই হলো প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার। এতে প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ৮৮ শতাংশ পানি থাকে, যা এ গরমে পানিশূন্যতা দূর করার পাশাপাশি পেট ঠান্ডা রাখে, হজমেও সাহায্য করে।
গ্রিন টি : পানিশূন্যতা দূর করতে গ্রিন টি-ও বেশ কার্যকরী। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে।
বন্ধুরা, এছাড়া নি¤েœর বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে। যেমন- চা, কফি দু’বারের বেশি পান না করাই উচিত। কারণ এইসব পানীয় এক ধরনের ডাইউরেটিক যা প্রস্রাবের সাথে শরীর হতে পানির নির্গমন বাড়িয়ে দেয়। তাই চা-কফির বদলে স্ট্যু, স্যুপ, গরম দুধ হতে পারে ভালো বিকল্প। এছাড়াও ফলের রসও খেতে পারো। ভাজা-পোড়া জাতীয় খাবার না খেয়ে সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন ২০০ মিলিলিটারের মতো লো ফ্যাট মিল্ক বা ননিবিহীন দুধ খেতে হবে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি বা কর্মক্ষেত্র; গন্তব্য যাই হোক, ব্যাগে পানির বোতল রাখবে। যাতে প্রয়োজনবোধে হাতের কাছেই পানি পেতে পারো।
রমজানে পানিশূন্যতা : এ বছর রমজান মাস পড়েছে গরমকালে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পানি পান না করার কারণে অনেকের শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এই সময়ের পানিশূন্যতা এড়াতে জেনে নাও কিছু তথ্য।
শরীরে আর্দ্রতা বজায় রাখতে পানির বিকল্প নেই। সেহরি ও ইফতার মিলিয়ে কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে। এছাড়া ইফতারে শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে যেসব ফল এবং শাকসবজিতে প্রচুর পানি আছে যেমন- শসা, তরমুজ এবং আঙ্গুর ইত্যাদি খেতে পারো। সেহরি বা ইফতারে অতিরিক্ত মসলা ও লবণযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলবে। কারণ এসব খাবার শরীরে অতিরিক্ত পানির চাহিদা তৈরি করে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডোনাট, পেস্ট্রি বা এই ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার শরীরে পানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। সেহরিতে মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে শরীরের শক্তি কমে যেতে পারে। এ কারণে রোজার সময় অতিরিক্ত চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকবে। বরং এর পরিবর্তে মিষ্টি ফল খাবে। যতটা সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলবে। কারণ অতিরিক্ত ঘামে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়ে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে।