ঋতু পরিবর্তনের অসুখ

ডা: আশরাফ হোসেন

0
28

বন্ধুরা, তোমরা হয়তো ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করে থাকবে যে, বাতাসে খানিকটা হিমের পরশ লেগেছে! ভোরের দিকে বেশ ঠা-া-ঠা-া ভাব। এ রকম আবহাওয়া উপভোগ্য হলেও, এই ঋতু পরিবর্তনের সময় কিন্তু তোমাদের নানারকম অসুখ হতে পারে। এ সময়ের বিভিন্ন রোগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে দরকার সাবধানতা, সতর্কতা, কিছু সুরক্ষাব্যবস্থা এবং সঠিক চিকিৎসা।
কী কী হতে পারে? শীতের শুরুতে ঠা-া লেগে সর্দি, কাশি ও জ্বর হলো শিশুদের খুবই সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। তাছাড়া, যাদের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রয়েছে, বা যাদের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেশি হয়, তাদেরও এই সমস্যা শীতকালে বেড়ে যায়। এর কারণ, শীতকালে দূষণের মাত্রা অনেকটা বেশি থাকে। এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তবে সাধারণ অসুখ ব্রঙ্কিওলাইটিস, এটাও একধরনের শ্বাসতন্ত্রের অসুখ। আর ডায়রিয়া বা উদরাময়ের সমস্যা যেকোনো ঋতু পরিবর্তনের সময়ই হতে পারে।
এই অসুখগুলো প্রতিরোধ করতে চাইলে কী করবে? সর্দি-কাশি-জ্বরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঠা-া না লাগানো। শিশুরা অনেক সময়ই সরাসরি ফ্রিজ থেকে বের করে পানি বা জুস খেয়ে নেয়। এটা বন্ধ করতে হবে। এই সময় তোমাদের কোল্ড ড্রিঙ্কসও খাওয়া উচিত নয়। হঠাৎ করে তাপমাত্রার পরিবর্তন অর্থাৎ ঠা-া-গরম হবার ফলেই ঠা-া লেগে যায়। তাই খুব গরম থেকে খুব ঠা-ায় যাওয়া এড়াতে হবে। একদম ছোট শিশুরা ভিজে পোশাকে থাকলে বা অনেকক্ষণ ভিজে ডায়াপার পরে থাকলে তাদের সেই ভিজে ভাব থেকে ঠা-া লেগে যায়। নিউমোনিয়াও হতে পারে। তাই ছোট শিশুদের সবসময় ডায়াপার পরিয়ে রাখতে হবে এবং সময়মতো তা বদলেও দিতে হবে।
ডায়রিয়া হওয়া আটকাতে দু’বছরের কম বয়সী শিশুদের বাড়িতে ফোটানো পানি ও তার চেয়ে বড় শিশুদের ফিল্টারের পানি খাওয়াতে হবে।
ব্রঙ্কিওলাইটিস এই সময় খুব সাধারণ অসুখ, আর সেটা কিন্তু বড়দের থেকেই শিশুদের হয়। তাই বাড়িতে কারো ঠা-া লেগে থাকলে, তাকে এবং শিশুকে, দু’জনকেই বাড়িতেও মাস্ক পরে থাকতে হবে। যে মায়েরা ব্রেস্টফিড করান, তাঁরাও যেন মাস্ক পরে শিশুকে খাওয়ান।
বন্ধুরা, এবার জেনে নাও এসব অসুখের চিকিৎসা কী? দু’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ব্রঙ্কিওলাইটিস হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা, কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে এতে কাজ হয় না। এই সময় শিশুরা বেশি খেতে পারে না। যেহেতু এটা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, তাই একবারে বেশি খেলে ওদের পেটে চাপ পড়ে, আর বমি হয়ে যায়। তাই কিছুক্ষণ পরপর অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে। খুব বেশি সমস্যা হলে হাসপাতালে ভর্তি করে নেবুলাইজেশন করাতে হবে। এ ছাড়া, ইনহেলারও দেওয়া যেতে পারে। যদি রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কমে গিয়ে অবস্থা মারাত্মক হয়ে যায়, তখন ভেন্টিলেশনে রাখতে হবে। এর সঙ্গে জ্বর থাকলে প্রয়োজনে তার ওষুধ দিতে হবে। তিন-চার দিনেও জ্বর না কমলে তখন রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে তখন প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বন্ধুরা, ঋতু বদলের সময় শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জি অতি সাধারণ ব্যাপার। বড়দের তুলনায় ছোটদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অ্যালার্জির প্রকোপ বেশি, কেননা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম। অ্যালার্জি কিন্তু কখনোই পুরোপুরি সারে না, তবে অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী অ্যালার্জেনকে এড়িয়ে চললে অ্যালার্জির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে শিশুর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করা সম্ভব। সাধারণত শিশুরা যেসব অ্যালার্জিতে ভোগে সেগুলোর বেশিরভাগই বায়ুবাহিত এবং খাদ্যবাহিত। অবশ্য ওষুধ, কেমিক্যাল বা পোকামাকড়ের কামড় থেকেও অনেক সময় অ্যালার্জি হয়ে থাকে। যেসব কারণে শিশু অ্যালার্জির কবলে পড়তে পারে, সেগুলো সম্পর্কে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর, প্রয়োজন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর অ্যালার্জি টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। এই টেস্টের মাধ্যমে অ্যালার্জির কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়।

অ্যালার্জির কারণ ও সমস্যা : বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যালার্জির প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে থাকে হাঁচি, নাকে অস্বস্তি বা গলা খুশখুশ করা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কাশি, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এবং চোখ থেকে পানি বেরোনো, মাথাব্যথা ইত্যাদি। শিশুদের মধ্যে সর্দিকাশি তো প্রায় লেগেই থাকে। সর্দিকাশি থেকে জ্বরও হয়। তবে এক-দু’সপ্তাহের মধ্যে ঠা-া লাগা সেরে যাবার পরেও যদি সমস্যাগুলো থেকে যায়, তাহলে সেগুলো অ্যালার্জির উপসর্গ হতে পারে। সাধারণত কোল্ড ভাইরাস শিশুর গলা, ব্রঙ্কিয়াল টিউব এবং কানে বেশি প্রভাব ফেলে। অনেক সময় এসবের সঙ্গে শিশুর ডায়েরিয়াও হতে পারে। তবে ঠা-া লাগা সেরে যাবার পরেও ক্রমাগত হাঁচি, কাশি, নিঃশ্বাস নেয়ার সময় নাক দিয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ হওয়া নিঃসন্দেহে অ্যালার্জির লক্ষণ। এগুলো সাধারণত পোলেন অ্যালার্জি থেকে হয়। পোলেন অ্যালার্জি একটি মওসুমি সমস্যা। এটি সাধারণত বসন্তকালেই বেশি হয়।
বন্ধুরা, বাড়ির মধ্যেও নানা বস্তু থেকে তোমাদের মধ্যে অ্যালার্জি হতে পারে, যেমন ধুলো বা পোকা (মাইটস)। এই মাইটস জাতীয় ক্ষুদ্র পোকা সাধারণত খাটের ম্যাট্রেসের মধ্যে থাকে। তাই এ বিষয় যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। ম্যাট্রেস নিয়মিত ভাল করে পরিষ্কার করা একান্ত আবশ্যক। আরশোলা বা ইঁদুরের মতো জীব থেকেও অনেক সময় শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এতেও শেষ নয়। বাড়িতে যদি পাখি, কুকুর বা বিড়ালের মতো পোষা প্রাণী থাকে, তাহলেও সেগুলোর সঙ্গে সময় কাটানোর ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। কেননা এগুলোর লোম থেকে শিশুদের অ্যালার্জি হতে পারে। হাঁচি, কাশি ইত্যাদি ছাড়া গা চুলকানোও কিন্তু অ্যালার্জির লক্ষণ হতে পারে। এটা অনেক সময়ই একজিমা, হাইভস বা কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসের কারণে হয়ে থাকে।

এসব অ্যালার্জি ছাড়াও মাঝে মাঝে খাবারেও শিশুদের অ্যালার্জি হতে পারে। শিশুদের মধ্যে ফুড অ্যালার্জির কারণের মধ্যে অন্যতম হল দুধ, ডিম, চিনেবাদাম, গম, সয় বা ট্রি নাটস। এই ট্রি নাটসের মধ্যে পড়ে কাজু, পেস্তা, আমন্ড, আখরোট, হেজেলনাট ইত্যাদি। তাই সমস্যা থাকলে তোমাদের এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
কী করবে? সব রকম কার্বনেটেড ড্রিঙ্কস, যেমন সোডা বা কোল্ড ড্রিঙ্কস এড়িয়ে চলবে। কার্বনেটেড ড্রিঙ্কের থেকে ফলের রস অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ঠিকই, তবে তা যে টাটকা, তরতাজা ফল থেকেই তৈরি করা হয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তার পরেই খাবে, অন্যথায় নয়। প্যাকেজড জুস পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ সাধারণত এগুলোয় প্রিজারভেটিভস ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আইসক্রিম খেতে পারো, তবে অতিরিক্ত পরিমাণে নয়।