সুখী মানুষ

আব্দুস সালাম

0
135

এক দেশে রত্ননিধি নামে এক শহর ছিল। সেই শহরে এক বণিক বাস করত। ব্যবসা-বাণিজ্য করে তার দিনগুলো ভালোভাবেই চলে যেত। কিন্তু তার মনে কোনো সুখ ছিল না। তিনি সুখী হবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করতেন। সুখ অন্বেষণের জন্য তিনি শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়াতেন। তার বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন তিনি ঠিক-ই সুখী হবেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে তার উত্তরোত্তর সাফল্য আসে। চারদিক থেকে আয়-রোজগার বাড়তে থাকে। যত পান ততই চান। তবুও তিনি সুখের নাগাল পান না। রাতের বেলায় ঘুমাতে গেলেও তার ঠিকমতো ঘুম আসে না। সারারাত জেগে থাকেন। তাই দিন-দিন তার হতাশা বাড়তেই থাকে। মনের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য তিনি উপায় খুঁজতে থাকেন। একদিন হঠাৎ তার মনে পড়ে এক সাধকের কথা। সাধক পার্শ্ববর্তী এক শহরে বাস করতো। বণিক মনে মনে বলেন, সুখী হওয়ার জন্য আমাকে ওই সাধকের শরণাপন্ন হতে হবে। নিশ্চয়ই উনি আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন। সাধকের পরামর্শ গ্রহণ করলে নিশ্চয়ই আমি সুখী হতে পারবো।
একদিন সময় করে বণিক সাধকের আস্থানায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। সাধকের সাথে দেখা করে তাকে সব ঘটনা খুলে বলেন। বণিকের সুখী হওয়ার বাসনার কথা শুনে সাধক তাকে একটা পরামর্শ দেন। তিনি বলেন- সুখী হতে হলে তোমাকে কঠিন একটা কাজ করতে হবে। মনের বাসনার কথা ব্যক্ত করে কয়েকজন সুখী মানুষের সঙ্গে তোমাকে সাক্ষাৎ করতে হবে। সাধকের কথা শুনে বণিক খুব খুশি হন। আর মনে মনে বলেন, এটা আর কী এমন কঠিন কাজ। আমি তো অনেক সুখী মানুষকে চিনি। তাদের সঙ্গে আমি দেখা করবো। সাধকের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বণিক মনের আনন্দে সুখী মানুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। বণিক মনে মনে ভাবেন- এই শহরে যার একাধিক সুউচ্চ অট্টালিকা আছে নিশ্চয়ই তিনি একজন সুখী মানুষ। আমি অট্টালিকার মালিকের সঙ্গে দেখা করব। তাহলে আমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। একদিন বণিক সেই অট্টালিকার মালিকের সঙ্গে দেখা করেন। বণিকের ইচ্ছার কথা শুনে অট্টালিকার মালিক বলেন, আমাকে সুখী মানুষ ভেবে আপনি ভুল করেছেন। আমি কেন সুখী হবো? আমার তো সামান্য কয়েকটা অট্টালিকা আছে। আমি আরো অট্টালিকা চাই। অনেক অনেক অট্টালিকা। শুধু এই শহরে কেন, সারা দেশেও যেন আমার মতো কারোর এত বেশি অট্টালিকা না থাকে। যেদিন আমার ইচ্ছা পূরণ হবে সেদিনই আমি সুখী হবো। তুমি এখন অন্য কোন সুখী মানুষের খোঁজ করো। অট্টালিকার মালিকের কথা শুনে বণিক ভারী অবাক হন।

বণিক এবার মনে মনে বলেন, আমাকে যেভাবেই হোক একজন সুখী মানুষ খুঁজে বের করতেই হবে। নইলে আমি কোনো দিন সুখী হতে পারব না। শুনেছি এক শহরে একজন জমিদার বাস করেন। নিশ্চয়ই তিনি সুখী মানুষ। আমি তার সঙ্গে দেখা করব। পরেরদিন সেই জমিদারের উদ্দেশ্যে বণিক বেরিয়ে পড়েন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বণিক জমিদারের প্রাসাদে উপস্থিত হন। অবশেষে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। বণিকের ইচ্ছার কথা শুনে জমিদার বলেন, কে বলেছে আমি সুখী মানুষ? আমি তো সামান্য ১০০০ বিঘা জমির মালিক। এই দেশে তো আরো অনেক জমিদার রয়েছে যাদের জমির পরিমাণ আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমার ইচ্ছা তাদের মতো জমিদার হওয়া। তাই আমার মনে অনেক দুঃখ। কেন আমি উনাদের মতো জমিদার হতে পারিনি? আমি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার জমির পরিমাণ বাড়াতে। কিন্তু আজো আমি সফল হতে পারিনি। জমিদার একটা টানা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, আমি জানি না কবে যে আমার দুঃখ ঘুচবে! কবে যে আমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে! যেদিন দেখব এদেশের সকল জমিদারের চেয়ে আমার জমির পরিমাণ বেশি সেদিনই মনে করব আমি একজন সুখী মানুষ। জমিদারের কথা শুনে বণিক খুব আশ্চর্যান্বিত হলেন। তিনি মনে মনে জমিদারকে ধিক্কার দিয়ে বলেন, এই জমিদার তো ভীষণ লোভী। এত জমি থাকার পরেও সে বলছে আমি সুখী নই? আমি মোটেও হতাশ হবো না। আমি এই দেশ থেকে একজন সুখী মানুষ খুঁজে বের করবোই। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন সুখী মানুষ খুঁজে না পাই ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হবো না। এরপর বণিক জমিদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

রত্ননিধি শহরে এক জহরী বাস করত। তার অনেকগুলো হীরা, মণি, মুক্তার দোকান ছিল। ওই জহরী ছিল অনেক টাকা-পয়সার মালিক। এবার বণিক ভাবল- নিশ্চয়ই উনি একজন সুখী মানুষ। আমি উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। একদিন বণিক জহরীর সঙ্গে দেখা করে মনের বাসনার কথা প্রকাশ করেন। সব কথা শোনার পর জহরী বলেন, আমি খুব সামান্য টাকা-পয়সার মালিক। আমার চেয়ে এই দেশে অনেক জহরী আছেন যাদের টাকার পরিমাণ আমার চেয়ে অনেক বেশি। আপনি তাদের কাছে যান। আমার ধনসম্পদ নিয়ে আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। আমি আরো টাকা-পয়সার মালিক হতে চাই। তাই আমি দিনরাত টাকার পেছনে অক্লান্ত ছুটছি। যেদিন এই দেশের সকলের চেয়ে বেশি টাকার মালিক হতে পারব সেদিনই আমি সুখী হবো। তার আগে নয়। আপনি অন্য একজন সুখী মানুষের সন্ধান করেন। এবারও বণিক হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন।

বণিক এবার মনে মনে ভাবলেন এই দেশের রাজা সুখী মানুষ হবেন নিশ্চয়ই। আমি যেভাবেই হোক রাজার সঙ্গে দেখা করবো। কিছুদিন পর বণিক রাজার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে তিনি রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে রাজার সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। রাজার অনুমতি পেয়ে বণিক রাজার সঙ্গে দেখা করেন। রাজা সব ঘটনা শোনার পর বণিককে বলেন, তুমি নিশ্চয় জানো যে আমার দেশটা খুব বেশি বড় নয়। ছোট একটা দেশ। আমি একটা ছোট্ট দেশের রাজা। আমার আশপাশের দেশগুলোর কথা একটু চিন্তা করে দেখ। এক একটা দেশ আমার দেশের চেয়ে কত বড়! আমি যদি এরকম একটা বড় দেশের রাজা হতে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো! অথচ আমার এই ছোট্ট দেশকে শাসন করতে আমাকে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। কত পেরেশান থাকতে হয়। দেশের চিন্তায়, জনগণের চিন্তায় আমি ঠিকমতো বিশ্রাম পর্যন্ত করতে পারি না। সবসময় একটা দুঃশ্চিন্তা আমার মধ্যে কাজ করে। তাই আমি মোটেও সুখী নই। তাই আমিও চাই তোমার মতো সুখী হতে।
দেশের একজন রাজা অসুখী হতে পারে তা বণিক ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। এবারও বণিক হতাশ হয়ে রাজপ্রাসাদ হতে বের হয়ে গেলেন। ভগ্ন মনোরথে বণিক মাথা নিচু করে একাকী হাঁটতে থাকেন। আকাশ-পাতাল ভাবছেন। এমন সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক অন্ধ ফকির তার স্ত্রীর কাঁধে ভর করে মনের আনন্দে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তার স্ত্রীও ঠিকমতো চোখে দেখেন না। বণিকের কৌতূহল হলো ফকির দম্পতির সঙ্গে কথা বলবেন। বণিক তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাদের কাছে জানতে চান, আপনরা এত খুশি কেন? কী হয়েছে?” অন্ধ ফকির উত্তরে বলে, “আজ আমাদের মহা খুশির দিন। একজন আমাদের ৫০০ টাকা দান করেছেন। এতে আমাদের বেশ কিছুদিন ভালোভাবে চলে যাবে। দুই-এক দিন বাসাতে বিশ্রাম করতে পারবো। ভিক্ষার জন্য বাইরে যেতে হবে না।”
– আপনারা কোথায় থাকেন?
– গ্রামের শেষ মাথায় একটা বাগান আছে। সেই বাগানের পাশে ছোট্ট একটা ভাঙা কুঁড়েঘর আছে। সেখানেই আমরা থাকি।
– আপনাদের কষ্ট হয় না? আপনাদের কি ইচ্ছা করে না পাকা ঘরে বাস করতে?
– কীযে বলেন ভাই? নিজের তো কোনো জায়াগা-জমি নেই। একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই পেয়েছি এটাই তো অনেক বড় বিষয়। আর আমাদের কেনই বা পাকাঘর থাকতে হবে? কুঁড়েঘরে থাকতে আমাদের তো কোনো সমস্যা হয় না। মাটির মানুষ মাটির বিছানাতেই শান্তি পাই।
– সুন্দর কোনো ঘরবাড়ি, সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ এগুলো কিছুই চান না?
– আমাদের কেন লজ্জা দিচ্ছেন? সুন্দর ঘরবাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে আমরা কী করবো? আমরা তো চোখে দেখি না। আমাদের কাছে সুন্দর-অসুন্দর, রাত-দিন সবই সমান।
– তাহলে কি আপনারা সুখী মানুষ?
– হ্যাঁ আমরা তো সুখী মানুষ। আমাদের কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। আল্লাহ আমাদের দয়া করে বাঁচিয়ে রেখেছেন এতেই আমরা খুশি।

অন্ধ ফকির দম্পতির কথা শুনে বণিক মনে মনে বলেন, কোনো নিঃস্ব, দরিদ্র ব্যক্তি যদি সুখী হতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না? আমার তো অনেক সম্পদ রয়েছে। আমি কালই সাধকের সঙ্গে দেখা করবো। পরের দিন বণিক সাধকের সঙ্গে দেখা করেন। বণিক গতকালের ঘটনা সাধকের কাছে হুবহু বর্ণনা করেন। সব কথা শুনে সাধক বলেন, কোনো ব্যক্তির যা আছে তাতেই যদি সে সন্তুষ্ট থাকে তাহলেই সে সুখী। নিজেকে অভাবমুক্ত রাখতে পারলেই মনের মাঝে সুখের জন্ম নেয়। নিজেকে সুখী মনে করলেই সুখী হওয়া যায়। এর জন্য ধনসম্পদ, টাকা-পয়সার দরকার হয় না। আর কেউ যদি অধিক পাওয়াকে সুখ মনে করে তাহলে সে কক্ষনো সুখী হবে না। যত পাবে ততই চাইবে। না পাওয়ার বেদনা তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াবে। অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সে সুখী হতে পারবে না। সাধকের মর্মবাণী বণিকের বুঝতে কষ্ট হয়নি। বণিকের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত হয়। তার অন্তর্চক্ষু খুলে যায়। তিনি বুঝতে পারেন ধনসম্পদ, টাকা-পয়সা সুখের একমাত্র উৎস নয়। মনের সুখই বড় সুখ। তিনি সাধককে বলেন আমিও আজ থেকে সুখী মানুষ। ভীষণ সুখী। সাধকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বণিক মনের আনন্দে বাড়িতে ফিরে যান।