সাজিদের আনন্দ

মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

0
53

বাবা মায়ের একমাত্র ভালোবাসার ধন সাজিদ। সবেমাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। সাজিদ তার বাবা মাকে অনেক দিন ধরে বলে আসছিলো গ্রামে দাদুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু স্কুল খোলা থাকায় বাবা তার কথায় রাজি হননি। এতে তার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সাজিদের মা তা বুঝতে পেরে তাকে বুঝিয়ে বলে, কয়দিন পর তো তোমার স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তোমাকে নিয়ে দাদুর বাড়ি বেড়াতে যাবো। সাজিদ সেই দিনগুলির অপেক্ষা করতে লাগলো।
সাজিদ গ্রামের মনোহর সবুজ দৃশ্যগুলো দেখতে খুব ভালোবাসে। গ্রামে গেলে ছোট চাচ্চুর সাথে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। দাদা-দাদী পরম ভালোবেসে তাকে আগলে রাখে। এসব সাজিদের খুব ভালো লাগে।
প্রতিদিনের মতো সাজিদ আজও স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর মাকে বলছে-
-আম্মু! আজ আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে কখন যাবো?
-তুমি স্কুল থেকে এসো তারপর বলবো। পরম ¯েœহে মা উত্তর দিলেন।
মায়ের কথা শুনে সাজিদ স্কুলের পথে পা বাড়ালো। সেইসাথে ভাবতে লাগলো ছুটির দিনে দাদুর বাড়ি গিয়ে কী কী করবে। কোথায় কোথায় ঘুরবে। সাজিদের বড়ই ইচ্ছা যেদিকে মন চায় সেদিকেই ঘুরে বেড়াবে। গাঁয়ে রয়েছে সাজিদের পরম স্বাধীনতা। নির্মল আনন্দ। দাদা-দাদীর সামনে সাজিদ অন্যায় কিছু করলেও বাবা মা বকাঝকা দিতে পারে না। একটু কিছু বললেই দাদা-দাদী চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। বলে, তোরা আমার একমাত্র নাতিকে বকা দিতে দিতে শুকিয়ে ফেলেছিস। দাদা-দাদীর এমন ভালোবাসা পেয়ে সাজিদও আপ্লুত হয়। সাজিদের আশা সে নদীর তীরে কাশবন দেখতে যাবে। ফড়িংয়ের পিছুপিছু দৌড়াবে। কাশবনে চুপটি করে বসে থাকা কুঁচবকের সাথে ভাব জমাবে। এসব ভাবতে ভাবতে স্কুলে পৌঁছায় সাজিদ।
অন্যদিকে সাজিদের মা গ্রামে যাওয়ার জন্য কাপড়-চোপড় আর ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। অনেকদিন পর গ্রামে বেড়াতে যাবে তাই তার বাবাও দাদা-দাদীর জন্য শপিং করতে বের হলো।
সাজিদ স্কুলে বসে বসে বন্ধুদের সাথে কে কোথায় যাবে আর কোথায় বেড়াবে তা নিয়ে আলোচনা করছিল। এমন সময় রমিজ স্যার ক্লাসে প্রবেশ করলেন। একে একে প্রত্যেকের হাজিরা ডাকলেন। তারপর বন্ধের ঘোষণা দিলেন। তখনই ছাত্ররা চিৎকার আর হইচই শুরু করে দিলো। ছাত্রদের চিৎকার আর হইচই শুনতে শুনতে রমিজ স্যার হেসে হেসে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই সাজিদ দৌড়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় চলে আসলো। দেখল মা সব গুছিয়ে বসে আছে। সাজিদের যেন আর ত্বর সইছে না। সে অস্থির হয়ে বলল,
– গ্রামে কখন যাবো আম্মু?
– এই তো একটু পরেই রওনা হবো। তোমার আব্বু আসতে আসতে তুমি গোসলটা সেরে নাও।
সাজিদ খুব তাড়াতাড়ি গোসল করে নতুন কাপড় পরে নিলো। তখনই তার আব্বু এলো। তারপর ব্যাগ আর দাদাদের জন্য কেনা উপহার সামগ্রী নিয়ে রওনা দিলো গ্রামের উদ্দেশে।
সাজিদ বাসে জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্যগুলো দেখছে আর একটু পরপর বাবাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছে। ওর আব্বুও সব প্রশ্নের উত্তর সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে তার দাদা-দাদী আদরের একমাত্র নাতি গ্রামে আসছে সেই সংবাদ শুনে নাতির জন্য কী করবে ভেবে কূল পাচ্ছেন না।
সাজিদের ছোট চাচ্চু নারিকেল গাছ থেকে তাদের জন্য কচিকচি ডাব পেড়ে ঠা-া করতে পানিতে ডুবিয়ে রাখল।
দাদা বাজার থেকে লাউ কিনে আনলো মুরাব্বা তৈরির জন্য। তাদের আদরের নাতি মুরাব্বা খেতে খুব পছন্দ করে তা দাদুর আগে থেকেই জানা ছিল।
ছোট চাচ্চুর ডাবপাড়া আর দাদুর মুরাব্বা বানানো শেষ হতে না হতেই সাজিদরা এসে পৌঁছাল। সাজিদকে দেখে দাদু জড়িয়ে ধরে বলল-
– ওমা! আমার সাজিদ দাদুভাই তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ।
– বড় হয়েছি বলেই তো সবার আগে আদর পেতে তোমার কাছে ছুটে এসেছি।
– তাই নাকি দাদুভাই?
– তা নাহলে আগে ছোট চাচ্চুর কাছে ছুটে যেতাম।
– এতো দেখছি আমার দাদুভাই অনেক পাক্কা হয়ে গেছে।
– হুমম পাক্কা হয়েছি!
সাজিদের উত্তর শুনে দাদু মৃদু হেসে উঠল। সাজিদ তার দাদুর সাথে কথা বলতে বলতে আর হাসাহাসি করতে করতে দু’জন কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
এদিকে তার ছোটচাচ্চু ডাবের পানি এনে তার আব্বু আম্মুকে পান করতে দিলো। তারপর তার জন্যেও নিয়ে আসলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে তার ছোট চাচ্চু। সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। একটু পর ছোটচাচ্চু সাজিদকে ডাকল,
– সাজিদ! এই সাজিদ!!
ছোটচাচ্চুর ডাকে সাজিদের কোনো খেয়াল নেই। সে দাদুর সাথে কথা বলছে আর হাসছে। তখন চাচ্চু পেছনে গিয়ে সাজিদকে একটা চিমটি কাটল। তখন সাজিদ ‘উউউ!’ করে চিৎকার দিলো। তারপর পেছনে ফিরতেই চাচ্চুকে দেখে বলল-
– চাচ্চু তুমি?
– হ্যাঁ, আমি।
– চিমটি কাটলে কেন?
– অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তোমাদের দাদা-নাতির কিচ্ছা শুনতেছি। আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছ না, তাই চিমটিটা তোমার পাওনা ছিল!
– হুমমম! আচ্ছা চাচ্চু বল কী বলবে?
– এই নাও তোমার পানি।
– কিসের পানি?
– ডাবের পানি। তোমরা আসবে জেনে পেড়ে রেখেছিলাম।
– তাই নাকি চাচ্চু? আচ্ছা চাচ্চু তোমার সঙ্গে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে?
– না।
– কেন?
– তুমি যে দাদুর সঙ্গে গল্পে বসেছ আমার কথা এক্কেবারে ভুলেই গেছ।
– না না চাচ্চু। তোমার কথা ভুলে যাইনি। বল না চাচ্চু তোমার সঙ্গে আমায় নিয়ে যাবে!
– আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে যাবো। এখন খাওয়া-দাওয়া করে একটু রেস্ট নাও। বিকেলে আমরা বের হবো। এ বলে ছোট চাচ্চু চলে গেল। সাজিদ বিকেলে বেড়াতে বের হবে, নদী দেখবে, কাশফুল দেখবে, আরো কত কী তা তার মাথায় আনন্দে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সময়টা কখন ফুরিয়েছে তা সে টেরও পায়নি। বিকেল হতে না হতেই ছোটচাচ্চু এসে হাজির। ছোটচাচ্চু সাজিদকে নিয়ে বের হলো বেড়াতে। চাচ্চুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে সাজিদ হারিয়ে যায় আনন্দের মোহনায়। ক্ষেতের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা আইল পেরিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। চার দিকে সবুজ আর সবুজ।
ঝিরিঝিরি দক্ষিণা বাতাস সাজিদের মন কেড়ে নিচ্ছে। গ্রামের এমন রূপে ভরা প্রাকৃতিক শীতল পরিবেশ দেখে সাজিদ খুবই মুগ্ধ।
হাঁটতে হাঁটতে চাচ্চুর সাথে চলে যায় নদীর তীরে কাশবনে। কাশবনে কাশফুলের শোভা দেখে সাজিদের আরো বেশি ভালো লাগছে। এদিকে ছোটচাচ্চু তার বন্ধুদের দেখে বলল-
– চল, আমরা ফুটবল খেলব।
– কিন্তু আমি কী করবো? বলল সাজিদ।
– তুমি বসে বসে আমাদের খেলা দেখবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে, চল।
সাজিদ বসে বসে চাচ্চুদের খেলা দেখছিল। খেলায় তাদের চিৎকার আর চেচামেচি সাজিদের আর ভালো লাগছিল না। তাই চাচ্চুকে না বলে চলে গেছে নদীর তীরে কাশবনে। কাশবনে বসে বসে কাঁশের ঢেউ, ফড়িং-প্রজাপতির উড়াউড়ি দেখছে। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। খেলা শেষে ছোটচাচ্চু সাজিদকে না দেখে চিন্তিত হয়ে তাকে খুঁজতে লাগল। অন্য দিকে সাজিদ আনন্দের সাথে বসে বসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল তার পাশেই একটা সাপ ফণা তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সাজিদ চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালাতে যেতেই সাপটি ছোবল মারল সাজিদের পায়ে। সাজিদের চিৎকার শুনে ছোটচাচ্চু দৌড়ে কাশবনের দিকে আসলো। দেখল সাজিদ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। চাচ্চু সাজিদের কাছে এসে দেখল পায়ে দু’টি দাগ। ছোটচাচ্চু তখনই বুঝতে পারল সাপের কামড় ছাড়া আর কিছু নয়। তৎক্ষণাৎ নিজ গেঞ্জি ছিঁড়ে তার পায়ে ক্ষতস্থানের ওপরে শক্ত করে বেঁধে দিলো। তারপর তাড়াতাড়ি সাজিদকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে এলো। সাজিদের আব্বু ছোটচাচ্চুর কোলে সাজিদের এমন অবস্থা দেখে আঁৎকে উঠলেন। তার আত্মা যেন শুকিয়ে গেল। তড়িঘড়ি এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে আমার সাজিদের? ততক্ষণে সাজিদের আম্মু আর দাদী হাউমাউ করে এসে পড়ল সাজিদের পাশে। ছোটচাচ্চু সব খুলে বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সবাই। সাজিদের দাদু ছুটল উত্তরপাড়ার মল্লিক ওঝার বাড়ি। তৎক্ষণাৎ ওঝা এসে সাজিদের শুশ্রƒষা শুরু করল। সাজিদের কোনো নড়াচড়া নেই। তার আম্মা অন্দরঘরে গিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদায় পড়ে সন্তানের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দু’চোখে পানি ছেড়ে দিলো। সাজিদের দাদীও কেঁদে কেঁদে আল্লাহ্র দরবারে ফরিয়াদ জানাতে লাগল। এদিকে মল্লিক ওঝা তার সবরকম মন্ত্র, তদবীর, গাছড়া ওষুধসহ তার সমস্ত প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে লাগল সাজিদের ওপর। এভাবে অনেকক্ষণ পর সাজিদের জ্ঞান ফিরল। সাজিদ চোখ মেলে তাকাতেই সকলের অশ্রু সিক্ত নয়নে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। সাজিদের দাদু আল্লাহ্র শুকরিয়া স্বরূপ দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন।
এরপর কেটে গেল কয়েকটা দিন। সাজিদ এখন অনেকটা সুস্থ। আজ তারা শহরে চলে যাচ্ছে। তার ছোটচাচ্চু অশ্রুসিক্ত চোখে সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাজিদও ভেজা চোখে চেয়ে রইল তার দাদা-দাদী আর ছোটচাচ্চুর দিকে।