সংগ্রাম

অগ্রপথিক মুসআব আব্দুল্লাহ

0
21

রিকশার প্যাডেলে পায়ের জোরটা যেন ঠিকঠাক পড়ছে না হামিদের। ঘর্মাক্ত শরীরের প্রতিটি জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা করছে। কোনোমতে রিকশাটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। পাশ দিয়ে আরও দুইটা রিকশা বেরিয়ে যেতেই পেছন থেকে আওয়াজ আসল,
Ñ ধুর ব্যাটা, তোর রিকশায় ওঠে ভুল করছি। দামড়া পোলা একটা রিকশা ঠিকঠাক চালাতে পারস না।
বকা শুনে আরেকটু শক্তি খরচ করার চেষ্টা করল হামিদ। কিন্তু কিছুতেই গতি বাড়াতে পারল না। চোখের কয়েকফোটা জল কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামের সাথে মিশে গেল বুঝতে পারার আগেই। সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলতেই থামিয়ে দিল রিকশাটা। যাক কিছুক্ষণ স্বস্তি পাওয়া গেল।

রিকশা চালানোটা হামিদের পেশা না। তার পেশা ছিল ছাত্রত্ব। ছিল বলাটা ঠিক মানায় না এখানে। ছাত্রই আছে এখনো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের ছাত্র সে। এসেছে এক মফস্বল এলাকা থেকে। মা মানুষের বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। বাবা দিনমজুর ছিল। এখন বিছানায়। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে হামিদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পেরে হামিদের বাবা রহিম মিয়া যারপরনাই খুশি হয়েছিল। কিন্তু বিধিবাম, এরপরই অসুস্থ হয়ে বিছানায় স্থায়ী হতে হলো তাকে। টাকার অভাবে চিকিৎসাও হচ্ছে না তার। বাবা-মা এর টাকায় পরিবার আর হামিদের টিউশনির টাকায় পড়াশোনার খরচ চলতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ঢাকা আসার পর আগের টিউশনি এখন আর নেই। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন আর নিজেরও টিউশনি নেই। মায়ের ছুটাবুয়ার কাজ করে কামানো টাকা দিয়ে কিছুতেই সংসার খরচ চলে না। ছোট ভাইটা প্রতি সপ্তাহেই চিঠি লিখে, সে এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। তারও অনেক খরচ দরকার। কি করবে হামিদ?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরদিন থেকেই টিউশনি খুজতে থাকে হামিদ। কিন্তু নতুন এ বিশাল অপরিচিত শহরে কে দেবে তাকে টিউশনি? কারও সাথে পরিচিতি নাই, শহরের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা নাই; কে তার সন্তানকে এমন কারও হাতে তুলে দেবে? চারমাস হয়ে যাচ্ছে খরচাপাতির টানাপোড়ন চলছে পকেটে। বাড়িতে খরচের জন্যে চিঠি লিখে সে, চিঠি লিখে পোস্ট করার আগেই তার কাছে মায়ের চিঠি আসে।

বাবা,
তোর বাবার অবস্থা খুব একটা ভাল না। অসুস্থতার এতদিন হয়ে গেল একটা ডাক্তার দেখাতে পারলাম না। সাহেবের কাছে গেছিলাম কিছু টাকা হাওলাত করব, সাহেব টাকা দেননি। বড়লোক সবাই কি এমন কিপটা হয়? জানিনা বাবা। শাহেদ এর পরীক্ষা সামনে। ওরও কিছু বই খাতা লাগত। তুই ছোটখাটো একটা চাকুরি পাস কিনা দেখিস। খুব টানাপোড়ন চলছে। টাকা পাঠাতে পারলাম না। মাফ করিস বাবা।

তোর মা।
(পুনশ্চ: তোর বাবা তোকে দেখতে চায়। পারলে এসে ঘুরে যাস ১দিনের জন্যে।)
সেদিন থেকে পাগলের মতো এর ওর কাছে সাহায্য চায় হামিদ। একটা সামান্য চাকুরির জন্যে। এই স্বার্থপর শহরে কেও তার দিকে করুনার দৃষ্টিতেও তাকায় না। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজেই কিছু একটা করবে। আজিমপুর গিয়ে রিকশার গ্যারেজ খুজে নেয়। নিজের জমানো সর্বশেষ সম্বল ৮হাজারটা টাকা জামানত দিয়ে রিকশা চালানোর কাজ নেয়।
প্রথমদিন খুব কষ্ট হয়। দুইদিন পর জ্বর উঠে যায় তার। সারা শরীরে ব্যাথা। বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল বকতে থাকে। একদিন পর জ্বর একটু নেমে আসলে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। সেরাতে স্বপ্নে দেখে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে হামিদ দেশের সেরা হাসপাতালগুলোর একটাতে। বাবার পাশে বসে আছে মা সুন্দর একটা শাড়ী পড়ে আর দরজা খুলে শাহেদ দৌড়ে এসে বলে ভাইয়া আমি মাধ্যমিকে গোল্ডেন এ-প্ল­াস পেয়েছি। শাহেদের ধাক্কায় ঘুম থেকে জেগে ওঠে সে।
নাহ্ শাহেদ না, রুমমেট জাগিয়ে দিচ্ছিল তাকে। সকাল হয়ে গেছে। জ্বরটাও নেই। তবে ব্যাথা কমেনি শরীরের। তবুও গামছাটা নিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে পড়ে হামিদ। আজ মঙ্গলবার, ক্লাস নেই। রিকশাটা গ্যারেজ থেকে বের করে রাস্তায় নেমে পড়ে। পেছনে বসা যাত্রীটা তার আজকের প্রথম যাত্রী। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুরছে এদিক ওদিক।
ভাবতে ভাবতে কখন যে সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে খেয়াল করেনি হামিদ। যাত্রীর তাগাদায় আবার প্যাডেলে পা চালানো শুরু করে হামিদ।

ফোটায় ফোটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাথা থেকে কিছু পানি কপালের ঘাম আর চোখের পানিতে মিশে কষ্টের এক বিশাল সাগর হয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল…।